.
উনিশ শ’ ছিয়াশি সালটা আমার জীবনের এক গুরুত্বপূর্ণ বছর। ওই বছর আমি উন্নত জীবিকা ও লেখক হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন নিয়ে ঢাকায় আসি। ধানমন্ডি ১৫ ও নিউ মার্কেটের কাছাকাছি কোন এক মহল্লায় কিছুদিন থাকার পর আমি চলে গিয়েছিলাম বাগবাড়ি গাবতলীর বিউটি সিনেমার (অধুনালুপ্ত) পেছনের এক মহল্লায়। কারণ আমিনবাজার হাইস্কুল এ্যান্ড কলেজে আমি চাকরি পাই। ’৮৬’র অক্টোবর/নবেম্বর নাগাদ পরিচয় হয় কবি রিফাত চৌধুরীর সঙ্গে, আজিমপুরে। গোরস্তানের মেইন গেটের কাছে একটা ছোট টি-স্টলে ওদের আড্ডা ছিল। অচিরেই ওই আড্ডার একজন হয়ে যাই আমি। রিফাত তখন থাকতো বকশিবাজারের ওদিকটায়।
১৯৮৭’র ফেব্রুয়ারিতে বেরোল আমার দ্বিতীয় কাব্যগ্রন্থ আবহমান উলুধ্বনি। অল্পদিনের ভেতর পরিচয় হয় কবি আবিদ আজাদের সঙ্গে। আবিদ ভাই তখন দিলকুশা বাণিজ্যিক এলাকায় কী একটা কাজ করতেন। রিফাত একদিন আমাকে নিয়ে যান তার অফিসে। খুব মনে আছে, আবিদ ভাই বাঁকানো হস্তাক্ষরে আমার নাম লিখে উপহার দিয়েছিলেন তার সদ্য প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থ ‘বনতরুদের মর্ম।’ পরে বুঝেছি, ওটা তার এক শ্রেষ্ঠ গ্রন্থ যেখানে চা, বিমানবালার মতো ব্যতিক্রমী থিম নিয়ে অসাধারণ কয়েকটি কবিতা আছে। সত্তরের প্রজন্মের কবিতার কথা উঠলে অনেকেই সর্বাগ্রে রুদ্রের কথা বলেন। কিন্তু আমি মনে করি রুদ্র নয়, আবিদই সত্তরের প্রধানতম কবি।
এক অজর শুভবোধ ও প্রতিবাদে চেতনা নিয়ে আত্মপ্রকাশ ঘটেছিল রুদ্র মুহম্মদ শহীদুল্লাহর। প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘উপদ্রুত উপকূল’ নামটির মধ্যেই সেই পরিচয় বিধৃত। কবির তেজ, কবিসুলভ লাইফস্টাইল এগুলোও ছিল। কিন্তু আমার সব সময়েই মনে হয়েছে, রুদ্রের কবিতা আধুনিক কবি তার ভাষাকে ধারণ করতে পেরেছে সামান্যই। আধুনিক কাব্য তো আড়ালপ্রিয় শিল্প।
রুদ্রের কবিতা কোন কিছু আড়াল করে না। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই প্রায় সবটাই বলে দেয়। প্রতীক ও চিত্রকল্পের প্রয়োগও অত্যন্ত সীমিত। অন্যদিকে আবিদ আজাদের কবিতা প্রতীক ও চিত্রকল্পের নিজত্বপূর্ণ ব্যবহার নিয়ে অনেক আধুনিক, যদিও প্রগলভতা ও পুনরোক্তিদোষ তার কবি ইমেজকে খানিকটা খাটো করেছে। লক্ষ্য করুন, তার প্রথম কাব্যগ্রন্থের নাম ‘ঘাসের ঘটনা’।
যাই হোক, আগের প্রসঙ্গে ফিরে আসি। লেখা ছাপানোর উদ্দেশ্যে পত্রিকা অফিসে ঘোরাঘুরি, স্কুলের ১০টা-৩টা চাকরি, সন্ধ্যায় আজিমপুরের আড্ডাÑ এভাবেই দিন কাটছিল। ইতোমধ্যে রিফাতের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা হয়েছে। ওই আজিমপুরেই পরিচয় হয়েছে কবি কিশওয়ার ইবনে দিলওয়ার, আহমেদ মুজিব এদের সঙ্গে। মুজিব সে সময় ‘দ্রষ্টব্য’ নামে একটা কাগজ করছেন। মনে পড়ে, এক সন্ধ্যায় ওই পত্রিকার জন্য আমি তার হাতে দিয়েছিলাম ‘স্রোতের বিরুদ্ধে কচ্ছপ’ নামে একটা গদ্য। রিফাত দিয়েছিলেন তার নতুন কবিতা। সে সময় নেশার প্রতি খুব টান ছিল রিফাতের। ফলে আমিও তার খপ্পরে পড়ে যাই। নানারকম নেশা তো ওই নেশারই টানে আমরা শেখ সাহেব বাজারের অলি-গলি, কামরাঙ্গিরচরের কুঁড়েঘর, নীলক্ষেতের বস্তি- এরকম কত জায়গায় যে গেছি তার হিসাব নাই। তখন প্রায়ই আমরা দুজন একসঙ্গে থাকতাম। পরিচিত লোকজন আমাদের দেখে বলতো ‘মানিকজোড়’।
১৯৮৭র মাঝামাঝি কবি আবিদ আজাদ তার প্রেস বসান বাংলা মোটরের কাছাকাছি কাঁঠাল বাগানের ঢালে। শিল্পতরু প্রেস। কয়েক মাসের মধ্যে বেরুতে শুরু করে তার সম্পাদিত সাহিত্য পত্র ‘শিল্পতরু’। উপদেষ্টা ছিলেন আল মাহমুদ, আবদুল মান্নান সৈয়দ। ‘শিল্পতরু’ ও তার সামনের চায়ের দোকান হয়ে ওঠে আমাদের আড্ডার নতুন জায়গা। এখানেই আসতেন অমিতাভ পাল। প্রতি সপ্তাহেই তিন-চার দিন আসতেন। আরও আসতেন কাজল শাহনেওয়াজ, পুলক হাসান, শশী হক, শামসেত তাবরেজী প্রমুখ। আমাদের সঙ্গে অমিতাভের ঘনিষ্ঠতা হতে বেশি সময় লাগেনি। কেননা শুধু লাইফস্টাইলে নয়, শিল্প সাহিত্য ভাবনার দিক থেকেও মিল ছিল বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই। বয়সে উনি আমাদের চেয়ে বছর দেড়েকের ছোট ছিলেন। ফলে কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়াশোনা শেষ করে ঢাকায় এসেছিলেন ১৯৮৮’র মাঝামাঝি নাগাদ। অল্পদিনের মধ্যেই আমি বুঝতে পারি, এই ছেলে আমাদেরই মতো কবিতাপ্রাণ। তার যাবতীয় সাহিত্য ভাবনার কেন্দ্রে আছে কবিতা। অমিতাভ সম্ভবত তখন গল্প লিখতে আরম্ভ করেননি।
আমরা এ ঘাট থেকে ও ঘাটে ভেসে বেড়াচ্ছিলাম শ্যাওলার মতো। অনেক নেশার আখড়া ছিল বটে। ওসব জায়গায় তো আর সাহিত্যালাপের সুযোগ ছিল না। আমাদের নিজের মতো একটা জায়গার অভাব খুব টের পাচ্ছিলাম। রিফাত একদিন বললেন, সরকার এভাবে তো আর চলে না। আসেন আমরা একটা ঘর নিই। আমি সম্মতি জানাই। নীলক্ষেত হাইস্কুলের উল্টোদিকে বাবুপুরা এলাকায় একটা বস্তি ছিল। ওই বস্তিতেই একটা ঘর ভাড়া নিয়েছিলেন রিফাত। ওই ঘরটা ছিল আমাদের পানি তামাক খাওয়ার নিজস্ব আস্তানা।
একটা ছোট চৌকিও ছিল একপাশে। ওখানেও আসতেন অমিতাভ পাল। বলা যায়, ওই ‘বেড়ার ঘর’-এর আড্ডার নিয়মিত সদস্য ছিলেন তিনি। অমিত সে সময় মানিকগঞ্জে কর্মরত। এনজিও ‘প্রশিকার’ একজন কর্মকর্তা। মানিকগঞ্জ তো খুব একটা দূরে না। ফলে প্রায়ই আমরা তাকে পেতাম।
আমি, ততদিনে ঢাকার অদূরে বিক্রমপুর আদর্শ কলেজে ইংরেজীর অধ্যাপক। মাঝেমধ্যে আড্ডায় পড়ে গিয়ে বেশি রাত হয়ে গেলে ওই ঘরেই থাকতাম। অমিতাভও রাত কাটিয়েছেন ওখানে। রিফাত অবশ্য থাকতে চাইতো না। কখনও কখনও নিতান্ত আমার অনুরোধে রাতে থেকেছেন ‘বেড়ার ঘরে’। এ নামটা তারই দেয়া। আমাদের পছন্দের লোকদের অনেকেরই পা পড়েছিল ওই ঘরে। ওই ঘরটা পরে রিফাতের সম্পাদিত বিভিন্ন ছোট কাগজের অলিখিত দফতর হয়ে উঠেছিল। একদিন দেখি, অমিতাভ পালের হাতে একটা পত্রিকা। কাগজের নাম ‘ব্রহ্মপুত্র’। এক-দেড় ফর্মার পত্রিকা। সম্পাদক অমিতাভ নিজেই। লক্ষ্য করে দেখি, খুব পরিচ্ছন্ন কাগজ। কয়েকজন লেখকের অল্প কয়েকটি রচনা ছাপা হয়েছে। সম্পাদনায় সুরুচির ছাপ স্পষ্ট। হ্যাঁ, কবি অমিতাভ, গল্পকার অমিতাভের মতো লিটল ম্যাগাজিন সম্পাদক অমিতাভও উন্নত মানসিকতার পরিচয় রেখেছিলেন। আর লেখা ছাপাছাপির বিষয়ে রিফাত, কাজল, শশী হকÑসকলেই উন্নত চিত্তপ্রবৃত্তির স্বাক্ষর রেখেছেন।
আমার প্রথম কাব্যগ্রন্থ বেরিয়েছিল রাজশাহী থেকে, বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র থাকার সময়ে। কাজল শাহনেয়াজ ও রিফাত চৌধুরীর প্রথম বইয়ের প্রকাশক আবিদ আজাদ। অবশ্য ‘শিল্পতরু প্রেস’ থেকে ছাপা হয়ে বেরিয়েছিল ‘নতুন বাল্বের আলো’ও- অমিতাভ পালের প্রথম কাব্যগ্রন্থ। ২৪ পৃষ্ঠার চটি বই। বইয়ের নামটা আমার খুব ভাল লেগেছিল; কবিতাগুলোও। গ্রন্থটির শেষ কভারে অমিতের কবিতা নিয়ে সংক্ষেপে উৎসাহব্যঞ্জক ও আশাপ্রদ কিছু কথা লিখেছিলেন আবদুল মান্নান সৈয়দ।
অমিতাভ পাল, আমি মনে করি, বাংলাদেশের আশির প্রজন্মের প্রথম সারির একজন কবি। প্রথম সারির চার/পাঁচ জনের একজন তিনি। আশির প্রজন্মের কবিতা যে ধরনের ভাবুকতা ও সৃষ্টিবৈচিত্র্য জোগান দিয়েছে সেক্ষেত্রে তার অবদান ব্যতিক্রমী। রিফাত চৌধুরী, শশী হক প্রমুখের মতো ছোট ছোট কবিতা লিখতেন। সংক্ষিপ্ততা ও সারগর্ভতা তার কবিতার দুই উল্লেখ্য বৈশিষ্ট্য। এ্যাপ্রোচ বা কথা বলার ধরন একেবারে নিজের মতো। সেভাবেই তিনি দেখতেন ও দেখাতেন। ‘নতুন বাল্বের আলো’র প্রকাশকাল ১৯৮৯। এই বইটির মাধ্যমেই হয়েছিল অমিতাভ পালের দীপ্তিঋদ্ধ আত্মপ্রকাশ। আধুনিক কবিতার অগ্রসর পাঠকবৃন্দ এই চটি বইটিকে স্বাগত জানিয়েছিল। আমরা বুঝতে পেরেছিলাম, আমাদের দলে যুক্ত হয়েছেন আরও একজন প্রতিভাবান যুবক যার মাধ্যমে বাংলা কবিতা আরও খানিকটা সমৃদ্ধ হবে। পরবর্তী প্রায় তিন দশকে অমিতের কবিতা আরও সংবেদী আরও পরিণত মনস্ক হয়ে উঠেছিল। সুস্পষ্ট হয়ে উঠেছিল তার কবিতার চরিত্র। ‘আলোর আলোচনা’ (১৯৯২), ‘আমার ‘আত্মীয়-স্বজন (১৯৯৮), ‘গণবেদনার গাথা’ (২০০৪) প্রভৃতি গ্রন্থে তার উজ্জ্বল স্বাক্ষর বর্তমান।
কথাসাহিত্যিক অমিতাভ পালের কথা না বললে অসম্পূর্ণ থেকে যাবে এই রচনা। নব্বই দশকের কোন এক সময়ে, খুব সম্ভব ১৯৯২/৯৩-এর দিকে অমিতাভ গল্পকার হিসেবে আবির্ভূত হন। কিন্তু তিনি যে গল্প লিখছেন, হয়তো আরও লিখবেনÑ এ বিষয়টি আমি বুঝতে পেরেছিলাম লিটল ম্যাগাজিনে তার ছোট গল্প প্রকাশিত হতে দেখে। খুব বেশি গল্প লিখতে পারেননি তিনি। রেখে গেছেন ‘রাতপঞ্জি’ ও ‘অসচরাচর’ নামে দুটি গল্পের বই। ছোট গল্পকার হিসেবেও অমিতাভ পাল ছিলেন ব্যতিক্রমী। এক্ষেত্রে বিষয়বস্তু ও লিখনরীতি- উভয় দিকেই নিজস্বতা দেখাতে পেরেছেন। তার ছোট গল্পগুলোর চৌদ্দ আনাই আক্ষরিক অর্থে ছোট। দেড়/দুই/তিন পৃষ্ঠার ভেতর শেষ হয়েছে। তিনের বেশি পৃষ্ঠা ব্যবহৃত হয়েছে, তার এমন গল্পের সংখ্যা খুবই কম। তবে সেটা বড় কথা নয়। গুরুত্বপূর্ণ যা তা ইচ্ছে, উল্লিখিত বই দুটিতে অন্তর্ভুক্ত গল্পসমূহে তিনি কথাসাহিত্যিক সুলভ সামর্থ্য অনেকখানি দেখাতে পেরেছেন। নিটোল গল্প, বিনোদী সংলাপ কিংবা কোন ধরনের দার্শনিকতা তার গল্পে পাওয়া যাবে না। পাওয়া যাবে পরিস্থিতির অন্যরকম বয়ান এবং সেখান থেকে জাত প্রতিক্রিয়া যা আধুনিক ছোট গল্পের অনন্য বৈশিষ্ট্য বলেই মনে করি। সংলাপ বিরল এসব ‘ছোট’ গল্প বাংলাদেশের কথাসাহিত্যে উজ্জ্বল সংযোজন হয়ে থাকবে।
অমিতাভের একটি কবিতা দিয়ে শেষ করছি এই লেখা। ‘চ্যাপলিনের নীরব সিনেমা’ শিরোনামের কবিতাটি পত্রস্থ হয়েছিল ‘প্রথম আলো’র ‘অন্য আলো’ পাতায় গত ২২ অক্টোবর। কবি হিসেবে অমিতাভ পালের যে অর্জন হয়ত তার প্রতিনিধি নয় এই লেখা কিন্তু তার কবি স্বভাবটি ঠিকই ফুটে উঠেছে এখানে- ‘বহুতল বাড়িটার কোলাপসিবল গেট খুলছে আর বন্ধ হচ্ছে- মালপত্র নিয়ে আসছে- যাচ্ছে ভাড়াটিয়ার দল/ফ্ল্যাটগুলোর সঙ্গে ভাল করে তাদের বন্ধুত্বও হচ্ছে না/ঠিকানা আটকাচ্ছে না কোন ফ্রেমে/তাদের জুতাগুলো পরিশ্রান্ত/বহুতল বাড়িগুলো স্টেশনের প্ল্যাটফর্মের মতো।’