ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

অমিতাভ পাল, স্মৃতি ও সাহিত্যপ্রসঙ্গ

সরকার মাসুদ

প্রকাশিত: ২৩:৫৫, ২১ জুলাই ২০২২

অমিতাভ পাল, স্মৃতি ও সাহিত্যপ্রসঙ্গ

.

উনিশ শছিয়াশি সালটা আমার জীবনের এক গুরুত্বপূর্ণ বছরওই বছর আমি উন্নত জীবিকা ও লেখক হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন নিয়ে ঢাকায় আসিধানমন্ডি ১৫ ও নিউ মার্কেটের কাছাকাছি কোন এক মহল্লায় কিছুদিন থাকার পর আমি চলে গিয়েছিলাম বাগবাড়ি গাবতলীর বিউটি সিনেমার (অধুনালুপ্ত) পেছনের এক মহল্লায়কারণ আমিনবাজার হাইস্কুল এ্যান্ড কলেজে আমি চাকরি পাই৮৬র অক্টোবর/নবেম্বর নাগাদ পরিচয় হয় কবি রিফাত চৌধুরীর সঙ্গে, আজিমপুরেগোরস্তানের মেইন গেটের কাছে একটা ছোট টি-স্টলে ওদের আড্ডা ছিলঅচিরেই ওই আড্ডার একজন হয়ে যাই আমিরিফাত তখন থাকতো বকশিবাজারের ওদিকটায়

১৯৮৭র ফেব্রুয়ারিতে বেরোল আমার দ্বিতীয় কাব্যগ্রন্থ আবহমান উলুধ্বনিঅল্পদিনের ভেতর পরিচয় হয় কবি আবিদ আজাদের সঙ্গেআবিদ ভাই তখন দিলকুশা বাণিজ্যিক এলাকায় কী একটা কাজ করতেনরিফাত একদিন আমাকে নিয়ে যান তার অফিসেখুব মনে আছে, আবিদ ভাই বাঁকানো হস্তাক্ষরে আমার নাম লিখে উপহার দিয়েছিলেন তার সদ্য প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থ বনতরুদের মর্মপরে বুঝেছি, ওটা তার এক শ্রেষ্ঠ গ্রন্থ যেখানে চা, বিমানবালার মতো ব্যতিক্রমী থিম নিয়ে অসাধারণ কয়েকটি কবিতা আছেসত্তরের প্রজন্মের কবিতার কথা উঠলে অনেকেই সর্বাগ্রে রুদ্রের কথা বলেনকিন্তু আমি মনে করি রুদ্র নয়, আবিদই সত্তরের প্রধানতম কবি

এক অজর শুভবোধ ও প্রতিবাদে চেতনা নিয়ে আত্মপ্রকাশ ঘটেছিল রুদ্র মুহম্মদ শহীদুল্লাহরপ্রথম কাব্যগ্রন্থ উপদ্রুত উপকূলনামটির মধ্যেই সেই পরিচয় বিধৃতকবির তেজ, কবিসুলভ লাইফস্টাইল এগুলোও ছিলকিন্তু আমার সব সময়েই মনে হয়েছে, রুদ্রের কবিতা আধুনিক কবি তার ভাষাকে ধারণ করতে পেরেছে সামান্যইআধুনিক কাব্য তো আড়ালপ্রিয় শিল্প

রুদ্রের কবিতা কোন কিছু আড়াল করে নাবেশিরভাগ ক্ষেত্রেই প্রায় সবটাই বলে দেয়প্রতীক ও চিত্রকল্পের প্রয়োগও অত্যন্ত সীমিতঅন্যদিকে আবিদ আজাদের কবিতা প্রতীক ও চিত্রকল্পের নিজত্বপূর্ণ ব্যবহার নিয়ে অনেক আধুনিক, যদিও প্রগলভতা ও পুনরোক্তিদোষ তার কবি ইমেজকে খানিকটা খাটো করেছেলক্ষ্য করুন, তার প্রথম কাব্যগ্রন্থের নাম ঘাসের ঘটনা

যাই হোক, আগের প্রসঙ্গে ফিরে আসিলেখা ছাপানোর উদ্দেশ্যে পত্রিকা অফিসে ঘোরাঘুরি, স্কুলের ১০টা-৩টা চাকরি, সন্ধ্যায় আজিমপুরের আড্ডাÑ এভাবেই দিন কাটছিলইতোমধ্যে রিফাতের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা হয়েছেওই আজিমপুরেই পরিচয় হয়েছে কবি কিশওয়ার ইবনে দিলওয়ার, আহমেদ মুজিব এদের সঙ্গেমুজিব সে সময় দ্রষ্টব্যনামে একটা কাগজ করছেনমনে পড়ে, এক সন্ধ্যায় ওই পত্রিকার জন্য আমি তার হাতে দিয়েছিলাম স্রোতের বিরুদ্ধে কচ্ছপনামে একটা গদ্যরিফাত দিয়েছিলেন তার নতুন কবিতাসে সময় নেশার প্রতি খুব টান ছিল রিফাতেরফলে আমিও তার খপ্পরে পড়ে যাইনানারকম নেশা তো ওই নেশারই টানে আমরা শেখ সাহেব বাজারের অলি-গলি, কামরাঙ্গিরচরের কুঁড়েঘর, নীলক্ষেতের বস্তি- এরকম কত জায়গায় যে গেছি তার হিসাব নাইতখন প্রায়ই আমরা দুজন একসঙ্গে থাকতামপরিচিত লোকজন আমাদের দেখে বলতো মানিকজোড়

১৯৮৭র মাঝামাঝি কবি আবিদ আজাদ তার প্রেস বসান বাংলা মোটরের কাছাকাছি কাঁঠাল বাগানের ঢালেশিল্পতরু প্রেসকয়েক মাসের মধ্যে বেরুতে শুরু করে তার সম্পাদিত সাহিত্য পত্র শিল্পতরুউপদেষ্টা ছিলেন আল মাহমুদ, আবদুল মান্নান সৈয়দশিল্পতরুও তার সামনের চায়ের দোকান হয়ে ওঠে আমাদের আড্ডার নতুন জায়গাএখানেই আসতেন অমিতাভ পালপ্রতি সপ্তাহেই তিন-চার দিন আসতেনআরও আসতেন কাজল শাহনেওয়াজ, পুলক হাসান, শশী হক, শামসেত তাবরেজী প্রমুখআমাদের সঙ্গে অমিতাভের ঘনিষ্ঠতা হতে বেশি সময় লাগেনিকেননা শুধু লাইফস্টাইলে নয়, শিল্প সাহিত্য ভাবনার দিক থেকেও মিল ছিল বেশির ভাগ ক্ষেত্রেইবয়সে উনি আমাদের চেয়ে বছর দেড়েকের ছোট ছিলেনফলে কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়াশোনা শেষ করে ঢাকায় এসেছিলেন ১৯৮৮র মাঝামাঝি নাগাদঅল্পদিনের মধ্যেই আমি বুঝতে পারি, এই ছেলে আমাদেরই মতো কবিতাপ্রাণতার যাবতীয় সাহিত্য ভাবনার কেন্দ্রে আছে কবিতাঅমিতাভ সম্ভবত তখন গল্প লিখতে আরম্ভ করেননি

আমরা এ ঘাট থেকে ও ঘাটে ভেসে বেড়াচ্ছিলাম শ্যাওলার মতোঅনেক নেশার আখড়া ছিল বটেওসব জায়গায় তো আর সাহিত্যালাপের সুযোগ ছিল নাআমাদের নিজের মতো একটা জায়গার অভাব খুব টের পাচ্ছিলামরিফাত একদিন বললেন, সরকার এভাবে তো আর চলে নাআসেন আমরা একটা ঘর নিইআমি সম্মতি জানাইনীলক্ষেত হাইস্কুলের উল্টোদিকে বাবুপুরা এলাকায় একটা বস্তি ছিলওই বস্তিতেই একটা ঘর ভাড়া নিয়েছিলেন রিফাতওই ঘরটা ছিল আমাদের পানি তামাক খাওয়ার নিজস্ব আস্তানা

একটা ছোট চৌকিও ছিল একপাশেওখানেও আসতেন অমিতাভ পালবলা যায়, ওই বেড়ার ঘর’-এর আড্ডার নিয়মিত সদস্য ছিলেন তিনিঅমিত সে সময় মানিকগঞ্জে কর্মরতএনজিও প্রশিকারএকজন কর্মকর্তামানিকগঞ্জ তো খুব একটা দূরে নাফলে প্রায়ই আমরা তাকে পেতাম

আমি, ততদিনে ঢাকার অদূরে বিক্রমপুর আদর্শ কলেজে ইংরেজীর অধ্যাপকমাঝেমধ্যে আড্ডায় পড়ে গিয়ে বেশি রাত হয়ে গেলে ওই ঘরেই থাকতামঅমিতাভও রাত কাটিয়েছেন ওখানেরিফাত অবশ্য থাকতে চাইতো নাকখনও কখনও নিতান্ত আমার অনুরোধে রাতে থেকেছেন বেড়ার ঘরেএ নামটা তারই দেয়াআমাদের পছন্দের লোকদের অনেকেরই পা পড়েছিল ওই ঘরেওই ঘরটা পরে রিফাতের সম্পাদিত বিভিন্ন ছোট কাগজের অলিখিত দফতর হয়ে উঠেছিলএকদিন দেখি, অমিতাভ পালের হাতে একটা পত্রিকাকাগজের নাম ব্রহ্মপুত্রএক-দেড় ফর্মার পত্রিকাসম্পাদক অমিতাভ নিজেইলক্ষ্য করে দেখি, খুব পরিচ্ছন্ন কাগজকয়েকজন লেখকের অল্প কয়েকটি রচনা ছাপা হয়েছেসম্পাদনায় সুরুচির ছাপ স্পষ্টহ্যাঁ, কবি অমিতাভ, গল্পকার অমিতাভের মতো লিটল ম্যাগাজিন সম্পাদক অমিতাভও উন্নত মানসিকতার পরিচয় রেখেছিলেনআর লেখা ছাপাছাপির বিষয়ে রিফাত, কাজল, শশী হকÑসকলেই উন্নত চিত্তপ্রবৃত্তির স্বাক্ষর রেখেছেন

আমার প্রথম কাব্যগ্রন্থ বেরিয়েছিল রাজশাহী থেকে, বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র থাকার সময়েকাজল শাহনেয়াজ ও রিফাত চৌধুরীর প্রথম বইয়ের প্রকাশক আবিদ আজাদঅবশ্য শিল্পতরু প্রেসথেকে ছাপা হয়ে বেরিয়েছিল নতুন বাল্বের আলো- অমিতাভ পালের প্রথম কাব্যগ্রন্থ২৪ পৃষ্ঠার চটি বইবইয়ের নামটা আমার খুব ভাল লেগেছিল; কবিতাগুলোওগ্রন্থটির শেষ কভারে অমিতের কবিতা নিয়ে সংক্ষেপে উসাহব্যঞ্জক ও আশাপ্রদ কিছু কথা লিখেছিলেন আবদুল মান্নান সৈয়দ

অমিতাভ পাল, আমি মনে করি, বাংলাদেশের আশির প্রজন্মের প্রথম সারির একজন কবিপ্রথম সারির চার/পাঁচ জনের একজন তিনিআশির প্রজন্মের কবিতা যে ধরনের ভাবুকতা ও সৃষ্টিবৈচিত্র্য জোগান দিয়েছে সেক্ষেত্রে তার অবদান ব্যতিক্রমীরিফাত চৌধুরী, শশী হক প্রমুখের মতো ছোট ছোট কবিতা লিখতেনসংক্ষিপ্ততা ও সারগর্ভতা তার কবিতার দুই উল্লেখ্য বৈশিষ্ট্যএ্যাপ্রোচ বা কথা বলার ধরন একেবারে নিজের মতোসেভাবেই তিনি দেখতেন ও দেখাতেননতুন বাল্বের আলোর প্রকাশকাল ১৯৮৯এই বইটির মাধ্যমেই হয়েছিল অমিতাভ পালের দীপ্তিঋদ্ধ আত্মপ্রকাশআধুনিক কবিতার অগ্রসর পাঠকবৃন্দ এই চটি বইটিকে স্বাগত জানিয়েছিলআমরা বুঝতে পেরেছিলাম, আমাদের দলে যুক্ত হয়েছেন আরও একজন প্রতিভাবান যুবক যার মাধ্যমে বাংলা কবিতা আরও খানিকটা সমৃদ্ধ হবেপরবর্তী প্রায় তিন দশকে অমিতের কবিতা আরও সংবেদী আরও পরিণত মনস্ক হয়ে উঠেছিলসুস্পষ্ট হয়ে উঠেছিল তার কবিতার চরিত্রআলোর আলোচনা’ (১৯৯২), ‘আমার আত্মীয়-স্বজন (১৯৯৮), ‘গণবেদনার গাথা’ (২০০৪) প্রভৃতি গ্রন্থে তার উজ্জ্বল স্বাক্ষর বর্তমান

কথাসাহিত্যিক অমিতাভ পালের কথা না বললে অসম্পূর্ণ থেকে যাবে এই রচনানব্বই দশকের কোন এক সময়ে, খুব সম্ভব ১৯৯২/৯৩-এর দিকে অমিতাভ গল্পকার হিসেবে আবির্ভূত হনকিন্তু তিনি যে গল্প লিখছেন, হয়তো আরও লিখবেনÑ এ বিষয়টি আমি বুঝতে পেরেছিলাম লিটল ম্যাগাজিনে তার ছোট গল্প প্রকাশিত হতে দেখেখুব বেশি গল্প লিখতে পারেননি তিনিরেখে গেছেন রাতপঞ্জিঅসচরাচরনামে দুটি গল্পের বইছোট গল্পকার হিসেবেও অমিতাভ পাল ছিলেন ব্যতিক্রমীএক্ষেত্রে বিষয়বস্তু ও লিখনরীতি- উভয় দিকেই নিজস্বতা দেখাতে পেরেছেনতার ছোট গল্পগুলোর চৌদ্দ আনাই আক্ষরিক অর্থে ছোটদেড়/দুই/তিন পৃষ্ঠার ভেতর শেষ হয়েছেতিনের বেশি পৃষ্ঠা ব্যবহৃত হয়েছে, তার এমন গল্পের সংখ্যা খুবই কমতবে সেটা বড় কথা নয়গুরুত্বপূর্ণ যা তা ইচ্ছে, উল্লিখিত বই দুটিতে অন্তর্ভুক্ত গল্পসমূহে তিনি কথাসাহিত্যিক সুলভ সামর্থ্য অনেকখানি দেখাতে পেরেছেননিটোল গল্প, বিনোদী সংলাপ কিংবা কোন ধরনের দার্শনিকতা তার গল্পে পাওয়া যাবে নাপাওয়া যাবে পরিস্থিতির অন্যরকম বয়ান এবং সেখান থেকে জাত প্রতিক্রিয়া যা আধুনিক ছোট গল্পের অনন্য বৈশিষ্ট্য বলেই মনে করিসংলাপ বিরল এসব ছোটগল্প বাংলাদেশের কথাসাহিত্যে উজ্জ্বল সংযোজন হয়ে থাকবে

অমিতাভের একটি কবিতা দিয়ে শেষ করছি এই লেখাচ্যাপলিনের নীরব সিনেমাশিরোনামের কবিতাটি পত্রস্থ হয়েছিল প্রথম আলোঅন্য আলোপাতায় গত ২২ অক্টোবরকবি হিসেবে অমিতাভ পালের যে অর্জন হয়ত তার প্রতিনিধি নয় এই লেখা কিন্তু তার কবি স্বভাবটি ঠিকই ফুটে উঠেছে এখানে- ‘বহুতল বাড়িটার কোলাপসিবল গেট খুলছে আর বন্ধ হচ্ছে- মালপত্র নিয়ে আসছে- যাচ্ছে ভাড়াটিয়ার দল/ফ্ল্যাটগুলোর সঙ্গে ভাল করে তাদের বন্ধুত্বও হচ্ছে না/ঠিকানা আটকাচ্ছে না কোন ফ্রেমে/তাদের জুতাগুলো পরিশ্রান্ত/বহুতল বাড়িগুলো স্টেশনের প্ল্যাটফর্মের মতো

 

 

×