ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

মাইকেল মধুসূদন দত্ত -প্রথম সাহিত্যিক দ্রোহী

জান্নাতুল যূথী

প্রকাশিত: ০০:০০, ১৫ জুলাই ২০২২

মাইকেল মধুসূদন দত্ত -প্রথম সাহিত্যিক দ্রোহী

.

বাংলা সাহিত্যে তেজস্বী ও প্রখর মেধার পরিচয় দিয়ে আজও মহাকাব্যের ইতিহাসে রাজ-সিংহাসন যিনি দখল করে আছেন, তিনি মাইকেল মধুসূদন দত্ত (১৮২৪-১৮৭৩)। তিনি বাল্মীকির ‘রামায়ণ’ থেকে স্বল্প পরিমিত কাহিনী গ্রহণ করে আধুনিকতার রূপায়ণে রচনা করেছেন ‘মেঘনাদবদকাব্য’। মূলত এই মহাকাব্যের মাধ্যমে তিনি আঙ্গিকে-বিষয়ে-ভাবনায় প্রথম সাহিত্যিক দ্রোহ করেছেন। মহাকাব্যটির রচনাকাল ১৮৬১।
মাইকেল সম্পর্কে কবি-সমালোচক মোহিতলাল মজুমদার তার রচিত ‘শ্রী মধুসূদন’ গ্রন্থে বলেছেন  ‘মধুসূদনের দুর্ভাগ্যই এই যে, এতবড় কবিশক্তির অধিকারী হইয়াও তিনি বাংলার কাব্যসাহিত্যে কেবল খ্যাত-খনন, সেতু নির্মাণ ও সোপান রচনাই করিয়া গিয়াছেন। এক দুঃসাহসিক অভিযানের পথিকৃৎ হিসেবেই তিনি এ যুগের সর্বোচ্চ স্থান অধিকার করিয়া আছেন; যত বড় প্রতিভা তত বড় সৃষ্টির নিদর্শন রাখিয়া যান নাই।’ কিন্তু ‘মেঘনাদবধকাব্য’র মাধ্যমে সাহিত্যজগতে তিনি যে বিদ্রোহ ঘটিয়েছেন, তা যে নবজাগরণের সৃষ্টি করেছে,  সে কথা মোহিতলাল মজুমদার বলেননি।
মাইকেল তার ‘মেঘনাদবধকাব্য’ রচনার প্রয়াস পেয়েছেন হোমার, ভার্জিল, দান্তে, ট্যাসো, মিলটন, বাল্মীকি, কালিদাস প্রমুখ  সাহিত্যিকের প্রত্যক্ষ-পরোক্ষ প্রভাবে।  এতে তিনি রামায়ণের কাহিনীকে পুঞ্জীভূত করে নিজের কল্পলোকের বাস্তবরূপ দান করেছেন। যার মূলে ছিল নতুনতর বোধ, নতুনতর বাণীভঙ্গি ও স্টাইল, ভাষা ও ছন্দের অপূর্ব ঝংকার। ফলে ‘মেঘনাদবধকাব্য’ হয়ে উঠেছে কবির মৌলিক রচনা। বীরবাহুর নিহত হওয়ার সংবাদ থেকে মেঘনাদ-হত্যা ও প্রমীলার চিতারোহণ পর্যন্ত তিন দিন দুই রাতের কাহিনী বর্ণিত হয়েছে এতে। মহাকাব্যটি নয় সর্গের। প্রত্যেকটি সর্গের নামও চমকপ্রদ। সর্গগুলো যথাক্রমে অভিষেকো, অস্ত্রলাভো,  সমাগমো, অশোকবনং, উদ্যোগো, বধে, শক্তিনির্ভেদো,  প্রেতপুরী, সংস্ক্রিয়া। প্রত্যেকটি অধ্যায় শেষে নাম যোজনা সাহিত্যের ধারায় নবতর ধারণা। কাহিনী নবায়ণ থেকে শুরু করে যে বিদ্রোহীচেতনা দেখিয়েছেন, তার স্বাক্ষর কাব্যের পরতে-পরতে ছড়ানো।
মূল ‘রামায়ণ’ রচনা করেছেন বাল্মীকি। আর বাংলায় প্রচলিত কৃত্তিবাসী ‘রামায়ণ’। দুই রামায়ণেই রামকে দেবতারূপে পূজনীয় করে তোলা হয়েছে। কিন্তু মাইকেল ‘মেঘনাদবধকাব্যে’ রামকে দেবতা বলে স্বীকার করেননি। বরং কাব্যের বর্ণনায় তিনি রামকে নয় বরং রাবণের পক্ষে কথা বলেছেন। তাতে তিনি রাবণকে নায়কোচিত রূপ দিয়েছেন। বীরবাহুর মৃত্যুর পর মেঘনাদ কর্তৃক সেনা অধিকার গ্রহণ এবং নিকুম্ভিলা যজ্ঞাগারে লক্ষ্মণের হাতে নিরস্ত্র মেঘনাদের মৃত্যু। ক্রুব্ধ রাবণের যুদ্ধযাত্রা, লক্ষ্মণের আহত হওয়া, আহত লক্ষ্মণকে ওষুধাদি দিয়ে জীবনদান ও মেঘনাদের সৎকারই মহাকাব্যটির মূল বিষয়। কাহিনীর পরিসরভেদে মাইকেলের বিদ্রোহী সত্তা বোঝা যায়, বাল্মীকির রামায়ণের রামকে যখন মাইকেল দেবত্বের আসন থেকে বিচ্যুত করেছেন, তখন তার কাব্যে রাম আদর্শ পুরুষ, ব্যক্তিত্ববাদী, ভগবানের অবতার নয়, বরং রামের দুর্বলচিত্ত দেখিয়েছেন।   
আবহমান বাঙালীর মন ও মননকে নাড়িয়ে দিয়েছিলেন মাইকেল মধুসূদন দত্ত। কারণ তার ‘মেঘনাদবধকাব্য’ প্রচলিত কাহিনীর গন্ডি পেরিয়ে এক নতুন ধারা নির্মাণ করে। তিনি প্রথা ও  চেতনাকে ভাঙার দুঃসাহস দেখিয়েছিলেন। কারণ কৃত্তিবাসী বা বাল্মীকির রামায়ণে রাম দেবতা। কিন্তু মধুসূদন দত্ত নতুন যুগের নতুন ভাবনার মানুষ। ইয়ংবেঙ্গল গোষ্ঠীভুক্ত। এসব চেতনাকে কাজে লাগিয়ে তিনি রামায়ণের কাহিনী থেকে মূল চেতনাকে গ্রহণ করলেও আধুনিক মানুষ ও সাহিত্যের বৈশিষ্ট্য অনুযায়ী তিনি রামকে দেবত্ব আরোপ করেননি। কারণ আধুনিক মানুষের বৈশিষ্ট্য মানবতাবাদী চিন্তার প্রকাশ ঘটানো। একই ব্যক্তিত্ব,  দেশপ্রেম, রুচিবোধের সমন্বয় ঘটানো। তাই রাবণ কর্তৃক সীতাহরণেও রামের প্রতি করুণাধারা না এসে রাবণের প্রতি সৃষ্টি হয়েছে প্রেমময়তা। সীতাকে উদ্ধারার্থে কূটকৌশল অবলম্বন করেছেন রাম। লক্ষ্মণ বীর মেঘনাদকে নিরস্ত্র অবস্থায় হত্যা করেছেন। আর সেই শোক রাবণকে যতটা বিচলিত করেছে, তার  চেয়ে খোদ লেখককেই বেশি শোকার্ত করেছে।
রামায়ণের দুষ্কৃতকারী রাক্ষস হয়ে থাকেননি রাবণ। বরং পিতার স্নেহ-মমতা, স্বদেশ, স্বজাতিকে রক্ষার তাগিদ তাকে করে তুলেছে মহিমান্বিত। মাইকেল মধুসূদনের এখনে প্রথার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করেছেন। রাবণকে মাইকেল আধুনিক চেতনাসম্পন্ন মানুষ হিসেবে গড়ে তুলতে সমর্থ হয়েছেন। রাবণ শুধু রাক্ষসরাজ নয় বা সীতাহরণ করেই গুটিসুটি মেরে কাব্যে অবস্থান করেননি, বরং সন্তানের মৃত্যুতে প্রতিশোধে গর্জে উঠেছেন। লঙ্কাপুরীতে হনুমান ও রাম আক্রমণ করলে সদর্পে রাজ্যকে রক্ষার চেষ্টা করেছেন। বিপুল শক্তি ও বীরত্বের সাক্ষাত ঘটেছে মাইকেলের চরিত্র নির্মাণকৌশলে।
রাবণের পরাজয় ঘটেছে হৃদয়ের মণিকোঠায়। বাইরে রাবণ বীরোচিত। পুত্রহত্যার প্রতিশোধ নিতেই অস্ত্র ধারণ করেছেন। একদিকে পুত্রশোক, অন্যদিকে আপন ভাই বিভীষণের বিরুদ্ধপক্ষ অবলম্বন। সেখানেও রাবণের হৃদয়পীড়া বেড়েছে। ‘মেঘনাদবধকাব্যে’ তাই রাবণের বীরোচিত মহিমা ব্যক্ত হলেও ট্র্যাজেডির ভাষ্য হয়ে উঠেছে। রাবণ চরিত্রে যে বীরত্বগাথা রচিত হয়েছে, তা যুদ্ধে অংশগ্রহণে নয় বরং তার ব্যক্তিত্বের প্রতিফলনে। মহাকাব্যটি পাঠ করলে বোঝা যায়, শুধু রাবণের চরিত্র পরিপূর্ণ করে গড়ে তুলতে  রামকেও কল্পনায় সাজিয়েছেন মাইকেল। লক্ষ্মণের প্রতি রামের যে ভাতৃত্ব, সেখানে বাঙালী জাতিসত্তার পরিচয় লেখকহৃদয়কে বিগলিত করেছে। ইন্দ্রজিৎ মেঘনাদ ও লক্ষ্মণের যুদ্ধকালে বানর ও বিভীষণের সৈন্য নিষ্ক্রিয় নয় বরং ইন্দ্রজিতের সঙ্গেও যুদ্ধরত দেখিয়েছেন কবি। মাইকেল যুদ্ধের বর্ণনায় বাল্মিকীর রামায়ণের কাহিনী অনুসরণ করলেও হোমারের প্রভাব চোখে পড়ার মতো।
নতুন বিষয়কে মহাকাব্যে উপস্থাপন করায় মাইকেল প্রথম এবং একমাত্র সাহিত্যিক দ্রোহী। তার বিদ্রোহ সাহিত্যেও প্রচলিত রীতির বিরুদ্ধে। তিনি চরিত্র নির্মাণে প্রচলিত রীতির তোয়াক্কা করেননি। রাবণকে নায়কোচিত গুণে গুণান্বিত করেছেন। আবার রামকে প্রতিনায়ক বা ভিলেন বানিয়েছেন। রাবণ স্বদেশপ্রেমী অন্যদিকে রাম পরদেশ আক্রমণকারী। এমন নতুনতর ধারণায় পাঠককে বিগলিত করেছেন এবং কাব্য নির্মাণে প্রথাগত পয়ার-অক্ষরবৃত্তের ধারণা ভেঙে অমৃত্রাক্ষর ছন্দ প্রবর্তন করেছেন।
১৮৬০ সালে ‘তিলোত্তমাসম্ভব কাব্য’র মধ্যে দিয়ে কবির প্রথা প্রতিকূলে চলা শুরু হয়। ১৮৬১ সালে ‘মেঘনাদবধকাব্য’-এ অক্ষরবৃত্তের প্রয়োগ আরও ত্বরান্বিত হয়। ‘মেঘনাদবধকাব্য’র ষষ্ঠ সর্গে বলেছেন,
‘এতক্ষণে’-অরিন্দম কহিলা বিষাদে
জানিনু কেমনে আসি লক্ষ্মণ পশিল
রক্ষঃপুরে! হায়, তাত, উচিত কি তব
একাজ, নিকষ সতী তোমার জননী।
প্রথাগত চরিত্র,  কাহিনী,  কাব্য কোন কিছুই মাইকেল মধুসূদন দত্ত গ্রহণ করেননি। ‘মেঘনাদবধকাব্য’র গঠনরীতি কাব্যসাহিত্যের ইতিহাসে অভিনব। আখ্যানকাব্য হিসেবে ‘তিলোত্তমাসম্ভবকাব্য’টিতে নানা ত্রুটি-বিচ্যুতি আমরা লক্ষ্য করি। যে ত্রুটির অন্যতম হলো রসের অনুপস্থিতি। কিন্তু ‘মেঘনাদবধকাব্য’ গঠনের নিপুণতার পাশাপাশি রসের সঠিক ব্যবহার ঘটেছে। বীর রস, শৃঙ্গার রস, করুণ রস সবই এসেছে এই কাব্যে। ফলে মধুসূদন দত্তের শিল্পবোধেরও পরিচয় সুস্পষ্ট হয়ে উঠেছে তাতে। চিত্রকল্প রচনায়ও কবি তেজস্বী।
বলেছেন, ‘একাকিনী বসি দেবী, প্রভা আভাময়ী তমোময় ধামে যেন।’  আবার বলেছেন,  ‘হীন-প্রাণা হরিণীরে রাখিয়া বাঘিনী।’ তার এই চিত্রকল্পের ব্যবহারে কখন ভাষা নতুন প্রাণ-রূপ পেয়েছে। আবার উপমা-উৎপ্রেক্ষার ব্যবহারও করেছেন। বীরাঙ্গনা,  ‘ব্রজাঙ্গনা কাব্য’-এ আত্মভাব বর্জিত হলেও ‘মেঘনাদবধকাব্য’টিতে কবি তা পূর্ণমাত্রায় তুলে ধরেছেন। গীতিকবিতার মতো তাই লালিতপূর্ণ বা মাধুর্যময় হয়ে উঠেছে মহাকাব্যটি। ‘মেঘনাদবধকাব্য’র নির্মাণক্ষমতা তাই প্রাণ পেয়েছে সবদিক থেকেই। মধুসূদনের বিদ্রোহী সত্তার পূর্ণ প্রতিফলন কাহিনী নির্মাণ, বর্ণনাভঙ্গি, ভাষা, ছন্দ, অলঙ্কারের প্রতিটি  সেক্টরে।
 ছাত্রজীবনের বালকসুলভ জিজ্ঞাসা,  আবেগবশে কবি তার ‘তিলোত্তমাসম্ভবকাব্য’ রচনা করেছিলেন ১৮৬০ সালে। এই কাব্যে ব্যক্তিগত অভিমতকে প্রতিষ্ঠিত করার সর্বোচ্চ চেষ্টা লক্ষণীয়। মূলত এই কাব্যটিই কবির সৃষ্টির তোরণদ্বার উন্মোচন করেছিল, যার পূর্ণ প্রকাশ ঘটেছে ‘মেঘনাদবধকাব্য’টিতে। ‘তিলোত্তমাসম্ভবকাব্য’টিতে লেখক মানবতাবোধ দ্বারা মানুষকে সন্তুষ্ট করতে পারেননি। কিন্তু ‘মেঘনাদবধকাব্যে’ সেই প্রচেষ্টায় যেন তাকে বেশি করে পীড়িত করেছিল। তাই রাম হয়ে উঠেছে ভিলেন, অন্যদিকে রাবণ মমত্ববোধ,   প্রেমময়ী। সন্তানের মৃত্যুতে হাহাকার তাকে জয়ী করেছে। ‘ব্রজাঙ্গনা’য় কবিপ্রতিভা কিছুটা ক্লান্ত, হালকা হয়ে উঠেছে। মনে হয়, যেন কবি তিলোত্তমা,   ‘মেঘনাদবধকাব্য’ সৃষ্টির পর কিছুটা ঝিমিয়ে পড়েছিলেন। কিন্তু সেই মন্দাভাব কেটেছে ‘চতুর্দশীকবিতাবলী’ রচনার মধ্য দিয়ে।  ‘চতুর্দশকবিতাবলী’তেও কবি অমিত্রাক্ষর ছন্দ ব্যবহার করেছেন সুনিপুণভাবে। তেমনি ‘ব্রজাঙ্গনা’য় ব্যবহার করেছেন পয়ার ও ত্রিপদীর সাধারণ কাঠামো।
 মাইকেল মধুসূদন দত্ত মহাকাব্যের ধারায় প্রথম অভিষেক ঘটালেও এই ধারার তিনিই সর্বশ্রেষ্ঠ স্রষ্টা। আজও তার সমকক্ষ কেউ হতে পারেননি। কাব্যনির্মাণের যত নতুনত্ব সবই যেন তিনি একাই ধারণ করেছেন। কবির কাজ সৃষ্টি করা। মধুসূদন দত্ত তাই সেই পথেই হেঁটেছেন। সৃষ্টি করেছেন মাইলফলক।  শব্দসজ্জায়, পয়ার, অনুপ্রাস, যমকের ব্যবহার,  ভাষা-ছন্দের এই অপূর্ব মিলন শুধু মধুসূদনেরই কীর্তি।  তার প্রতিভা তাই সর্বজনবিদিত এবং অমর। ‘তিলোত্তমাসম্ভবকাব্য-টিতে  যে ঘাটতি ছিল, পরবর্তী কাব্যেই তা শুধরে নিয়েছেন।  ‘ব্রজাঙ্গনা’,  ‘বীরঙ্গনা’, ‘চতুর্দশকবিতাবলী’ সবকিছু ছাপিয়ে তাই কবি হয়ে উঠেছেন মহাকাব্যের সর্থক স্রষ্টা। সৃষ্টির জগতেও ঘটিয়েছিলেন বিপ্লব। সাহিত্যিক জগতে মাইকেলই প্রথম সাহিত্যিক দ্রোহের সাহস দেখিয়েছেন রামকে নয়। বরং রাবণকে নায়কোচিত রূপ দিয়ে তৈরি করেছেন। আর সেই বিপ্লব মানুষের মনকে ছুঁয়ে আছে আজও কারণ মানবধর্মের জয়গান, সেখানে উচ্চকিত। রাবণের স্নেহ-মমতা-স্বদেশপ্রেম হয়ে উঠেছে সব মানুষের হৃদয়ের কথা।

×