ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

ঈদ আনন্দ সংখ্যা ২০২২

রানী এলিজাবেথের সঙ্গে উইলিয়াম শেক্সপিয়ার

অপূর্ব কুমার কুন্ডু

প্রকাশিত: ২২:২৪, ৭ জুলাই ২০২২

রানী এলিজাবেথের সঙ্গে উইলিয়াম শেক্সপিয়ার

.

ইংল্যান্ডের রানী প্রথম এলিজাবেথের রাজত্বকালে রাজনীতি বিদেশনীতি অর্থনীতি ইত্যাদির সমান্তরালে শিল্প সাহিত্য ও সংস্কৃতির ক্ষেত্রেও বৈপ্লবিক উন্নতি সাধিত হয়। ইংল্যান্ডে তখন ক্রিস্টোফার মার্লো, রবার্ট গ্রিন, টমাস কিড, বেনজনসন, উইলিয়াম শেক্সপিয়ারদের মতো নাট্যকার অভিনেতাদের উপস্থিতি ধ্রুবতারার মত জ্বলজ্বলে। রানী এলিজাবেথ মৃত্যুর কিছুদিন আগে তার প্রসাদে উইলিয়াম শেক্সপিয়ারকে অতিথি হিসেবে আমন্ত্রণ করেন। তাদের মধ্যে হৃদয়স্পর্শি সংলাপ বিনিময় হয়। ঐতিহাসিক সেই ঘটনাকে আশ্রয় করে রচিত হয়েছে কাল্পনিক এ সংলাপ।

রানী এলিজাবেথ : মাস্টার শেক্সপিয়ার, আমি টক দইয়ের সাথে কালো জাম মিশিয়ে খেতে পছন্দ করি। আজ এর সাথে বাড়তি যোগ করেছি ভুট্টার ছাতু। এই কেক আমি নিজে পছন্দ করি। আর পছন্দ করি বলেই পছন্দের মানুষদের এই কেকই দিতে চাই।
উইলিয়াম শেক্সপিয়ার    : ইওর ম্যাজেস্ট্রি, আমি পরম সৌভাগ্যবান।
রানী এলিজাবেথ    : সৌভাগ্যবান কেকে না আমাকে দেখে।  
উইলিয়াম শেক্সপিয়ার     : সৌভাগ্যবান কেকের ঘ্রাণে, আপনাকে দর্শনে।
রানী এলিজাবেথ : যদি বলি এ আপার মিথ্যা ভাষণ, কারণ, আমি অসুস্থ।
উইলিয়াম শেক্সপিয়ার     : অসুস্থ বলেই বরাবরের মতো আত্মীয়, আমরা এই মুহূর্তে পরম আত্মীয়। পরম আত্মীয়তাকে সৌভাগ্যবান ভাবছি।
রানী এলিজাবেথ : সুস্থ থাকলে কি নিজেকে দুর্ভাগা ভাবতেন?
উইলিয়াম শেক্সপিয়ার     : যথার্থ সুস্থ থাকতে আপনি এভাবে আমাকে কখনো ডাকেননি। ফলে, সত্যিই সেটা আমার জন্য দুর্ভাগ্য।
রানী এলিজাবেথ : আপনার কথায় জাদু আছে মাস্টার উইলিয়াম শেক্সপিয়ার।
উইলিয়াম শেক্সপিয়ার     : আপনার কথায় জাদুকর হয়ে ওঠা আছে ইওর ম্যাজেস্ট্রি রানী এলিজাবেথ।
রানী এলিজাবেথ : উদাহরণ দিন।
উইলিয়াম শেক্সপিয়ার     : ক্যাাপ্টেন ড্রেককে দিয়ে স্পেনিশ যুদ্ধ জাহাজ ভেনিশ করা এবং সমুদ্র বিশ্ব জয় করা।
রানী এলিজাবেথ : আমি মানুষটা কেমন?
উইলিয়াম শেক্সপিয়ার     : আলো আঁধারির কুহেলিকা। ট্রয় নগরীর হেলেনের রহস্যের ব্যাখ্যাও শেষ পর্যন্ত সৌন্দর্যে। কিন্তু আপনি ব্যাখ্যাতীত। মানুষ আপনকে ভালবাসে এবং ভয় পায়, কেন তা সে জানে না।
রানী এলিজাবেথ : কিন্তু আমি কেন এমন?
উইলিয়াম শেক্সপিয়ার     : কারণ, আপনার চারিপাশ রাজনৈতিক পরিম-ল।
রানী এলিজাবেথ : আমার রাজনীতি কি রকম?
উইলিয়াম শেক্সপিয়ার    : আপনি কাউকেই অবিশ্বাস করেন না, আবার বিশ্বাসও করেন না। আপনি জানেন, আপনি ক্ষতি করতে পারেন, আপনি বৃদ্ধি করতে পারেন এবং সেটিই আপনি করেন। এটাই আপনার রাজনীতি।
রানী এলিজাবেথ : আমার রাজনীতি কি আপনাকে ছুঁয়েছে।
উইলিয়াম শেক্সপিয়ার     : এর উত্তর মিলবে শ্রুতিতে, স্মৃতিতে এবং ইতিহাসে। রাজরহস্য সাধারণের অগম্য।
রানী এলিজাবেথ : আপনিতো সাধারণ নন, মাস্টার উইলিয়াম শেক্সপিয়ার।
উইলিয়াম শেক্সপিয়ার     : অসামান্য বললেন, অনুগ্রহ করে যদি উদাহরণ দিন ইওর মেজেস্ট্রি রানী এলিজাবেথ।
রানী এলিজাবেথ : ইংল্যান্ডের সাধারণ মানুষ ইংল্যান্ডের ইতিহাস জেনেছে আপনার ষষ্ঠ হেনরি, তৃতীয় রিচার্ড, দ্বিতীয় রিচার্ড, কিংজন, চতুর্থ হেনরি, পঞ্চম হেনরি ইত্যাদি নাটক দেখে। যে নাট্যকারের নাটক একটা জাতির ইতিহাসকে জীবন্ত করে তোলে সে তো অসামান্যই।
উইলিয়াম শেক্সপিয়ার     : অসামান্যই যদি হয়, তবে তার মর্মমূলে আপনি। আপনি দিয়েছেন সামাজিক স্থিতিশীলতা এবং ব্যক্তি স্বাধীনতা। যা যা করণীয় তা করবার স্বাধীনতা। নৌবহরকে পাঠিয়েছেন বাণিজ্যে, সৈন্যদের পাঠিয়েছেন বিদ্রোহ দমনে, শ্রমিকদের পাঠিয়েছেন কলকারখানার চাকা ঘোরাতে, সাহিত্যিকদের উৎসাহ দিয়েছেন ইংরেজী সাহিত্যের বল বাড়াতে। আমি এক সামান্য নাট্যকার আর আপনি রানী সমগ্র্য ইংল্যান্ডের। তবু আপনি ডিকটেটর হয়ে ডিকটেশন দিয়ে লেখাচ্ছেন না। কেক, কফি নিজ হাতে বানিয়ে খাওয়াচ্ছেন যেন আমার বৃহত্তর নাট্য সাম্র্যাজ্যে আপনি এক কৃপাপ্রার্থী, অনুরাগী।
রানী এলিজাবেথ : যদি বলি আমি তাই।
উইলিয়াম শেক্সপিয়ার     : তবে অস্বীকার করবো না। বলবো এ আপনার মৌমাছির রানী হয়ে চাক বাঁধার ব্যক্তিক ক্ষমতা। এই ক্ষমতা ক্যাথলিক চার্চের পোপের ক্ষমতার হ্রাস টেনে মনুষত্বের স্বকীয়তা প্রতিষ্ঠাতে, ইউরোপের ক্ষমতার ভরসাম্য আনতে, বিশ্ব বণিজ্যের বিস্তার ঘটাতে, নৌপথে আধিপত্য বিস্তার করতে, কৃষি শিল্প সম্পদের সমৃদ্ধি ঘটাতে, নাট্যাঙ্গনকে বিশ্বজনীন করে তুলতে। ইওর মেজেস্ট্রি রানী এলিজাবেথ, আপনি আছেন বলেই ক্রিস্টোফার মার্লো, রবার্ট গ্রীন, টমাস কিড, বেন জনসন, আমি শেক্সপিয়ারসহ আরো অনেকে মিলেমিশে পেরেছি এবং পারছি ফুল থেকে মধু সংগ্রহ করে শক্তিশালী ও সমৃদ্ধ চাক বাঁধতে। বাড়িয়ে না বললেও একথা সত্য, রানী মৌমাছি না থাকলে চাক শুকিয়ে যায়, শুকিয়ে যেতে বাধ্য হয়।
রানী এলিজাবেথ : মাস্টার শেক্সপিয়ার আমি অসুস্থ, আমি ভীত। আমি গত একমাস ধরে বিছানায় শয্যা পাতি না। আমার ভয় হয়, আমি যদি ঘুমিয়ে পড়ে আর না উঠি। সত্যিই আমার ভয় হয় মাস্টার উইলিয়াম শেক্সপিয়ার, আমার ভয় হয়।
উইলিয়াম শেক্সপিয়ার     : এ ভয়তো স্বাভাবিক ইওর ম্যাজেস্ট্রি রানী এলিজাবেথ। যেদিন থেকে রাজনৈতিক সিদ্ধান্তে আপনি আপনার গর্ভধারিণী মাকে রাজরানী হওয়া সত্ত্বেও মৃত্যুদ-ে দ-িত হতে দেখলেন, সেদিন থেকে আপনার এই ভীতি শুরু। আপনি রাজা অষ্টম হেনরির মতো প্রতাপশালী পিতার ক্যাথলিকবিরোধী অভিযান এবং গীর্জা থেকে সম্পদ আহরণ দেখে বুঝলেন, ভীতি ছড়াতে না জানলে সম্পদও হয় না আর রাজ্যও চালানো যায় না। স্পেনিশ জাহাজ ডুবিয়ে বুঝলেন, ভীতি ছড়িয়েই সমুদ্র বিশ্বজয় করতে হয়। আমেরিকায় শিল্প-বাণিজ্য সম্পদ আহরণের জন্য আফ্রিকার থেকে ভীতি দেখিয়েই মানুষকে দাস বানিয়ে দলে দলে আনতে হয়। আপনি জানেন, সম্মানিত ব্যক্তি হয়ে বিন্যস্ত আসনে বসা চলে কিন্তু সা¤্রাজ্যের আসন চালাতে গেলে ভীতি প্রদর্শনের কোন বিকল্প নেই। ফলে, রাষ্ট্রীয় সর্বোচ্চ ক্ষমতাধর মানুষ হিসাবেই ভীতিকে জিইয়ে রাখতে হয়েছে রানী এলিজাবেথকে আর ব্যক্তি- সহানুভূতিশীল- মানবতাবাদী- শিল্পানুরাগী রানী এলিজাবেথকে সর্বদা অযাচিত শত্রুর হাত থেকে আক্রমণের শঙ্কায়-আশঙ্কায় হতে হয়েছে ভীতু থেকে ভীতুতর। আগুনের তাপে ফুলও তো শুকিয়ে যায়।  সূর্যমুখী ফুলকেও তো ঢলে পড়তে হয়।
রানী এলিজাবেথ  : এই জন্যই কি জুলিয়াস সিজার নাটকে জুলিয়াস সিজারের প্রতি আপনার এত মমতা, এত দরদ দিয়ে জুলিয়াস সিজারকে সাজিয়ে তোলা!
উইলিয়াম শেক্সপিয়ার     : তবুতো জুলিয়াস সিজারকে বাঁচানো গেল না। ক্যাসিয়াস- ব্রুটাসদের সাথে তো পারা যায় না ইওর মেজেস্ট্রি রানী এলিজাবেথ।
রানী এলিজাবেথ : কিন্তু তোমার ব্রুটাসতো বলেছিলো, ‘মার্ক অ্যান্টনির জন্য ভেবো না। কারো মাথা কাটা হলে তার হাত যেমন নিষ্প্রাণ ও নিস্ক্রিয় হয়ে যায়, তেমনি সিজারের মৃত্যুর পর অ্যান্টনিও নিষ্প্রাণ ও নিষ্ক্রিয় হয়ে যায়’। কিন্তু তাই কি হলো। মৃত সিজারতো আরো আরো বেশি জীবন্ত হয়ে মার্ক অ্যান্টনিওর মধ্য দিয়ে ফিরে এলো।
উইলিয়াম শেক্সপিয়ার     : এ কথার অর্থ কি ইওর মেজেস্ট্রি রানী এলিজাবেথ?
রানী এলিজাবেথ  : মাস্টার উইলিয়াম শেক্সপিয়ার। আমার যাবার সময় আসন্ন। আজ মনের কথা বলে যেতে আপত্তি নেই। ক্রিস্টোফার মার্লো এত এত বড় বিদ্রোহী নাট্যকার তবু মাত্র দুজনের দ্বন্দ্বযুদ্ধে টিকলো না। রবার্ট গ্রীন উচ্চাভিলাষী, ধনী বৌয়ের অত্যাচারে মুচির ঘরে শেষ শয্যা পাতলো। টমাস কিড লন্ডনের মঞ্চে অযাচিত রক্তারক্তি আমদানি করলো। বেন জনসন নাটকে কাল্পনিক চরিত্রের আড়ালে স্বচরিত্রের আত্মগৌরব বলে চললো। আমার সময়কালের সব নাট্যকার শিল্পোতীর্ণ কিন্তু মানবসৃষ্ট। কিন্তু মাস্টার উইলিয়াম শেক্সপিয়ার, আপনি ব্যক্তি জীবন এবং শিল্প জীবনে বরাবরই ধরে রেখেছেন নিরপেক্ষতা এবং ভারসাম্য। আপনি নাটক রচনাকে স্বপ্ন পূরণের সিঁড়ি করেননি, আপনার নাটক রচনাটাই আপনার স্বপ্ন। এবং সে স্বপ্ন বাস্তব। উপরন্তু আপনার অহঙ্কার নেই। আপনার রচনায় এক অবিশ্বাস্য বিভূতি, মানব মনের সপ্তরঙ্গ। আপনি পুরস্কৃত হতে চাননি, আপনি উদ্দেশ্য নিয়ে নাটক লেখেননি। আপনি যেন বৃক্ষ থেকে ঝরে পড়া ফুলকে, আকাশ থেকে নেমে আসা বরফ গলা জলকে, সূর্য থেকে উৎসারিত আভাকে, বয়ে চলা মলয় বাতাসকে, মহাশূন্যতা থেকে মানব মনের পূর্ণতাকে করজোরে ধারণ করে নাটকীয় নাটক রচনার মধ্য দিয়ে তুলে ধরেছেন মানব তীর্থযাত্রীর অগণিত মানবেরই সামনে। এখানে যেন আপনি নির্লিপ্ত, আপনি মহাবিশ্বের ইঙ্গিত মাত্র। ফলে, মাস্টার উইলিয়াম শেক্সপিয়ার, আজ আপনি লন্ডনে পরিচিত সামান্য কিন্তু এই সামান্য পরিচয়ই ক্রমান্বয়ে লন্ডন ডিঙ্গিয়ে ইংল্যান্ডে, ইংল্যান্ড ছাড়িয়ে ইউরোপে, ইউরোপ ছাড়িয়ে সারাবিশ্বে ছড়িয়ে পড়বে কাল থেকে কালে মহাকালে। আপনার সমকালে যদি আমি রানী হয়ে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা দিয়ে থাকি, সামাজিক শান্তি প্রতিষ্ঠা করে থাকি, আপনার নাটক দেখে, মঞ্চায়ন দেখে আমি রানী হয়ে যদি আপনার রচনার ক্ষেত্র নির্মাণে সামান্য ভূমিকা রেখে থাকি, তবে মাস্টার উইলিয়াম শেক্সপিয়ার, আমারও ইচ্ছা হয় আপনার নাট্যাকাশে, আপনার রচনার প্রসাদগুণে, আপনার চরিত্রের ভিড়ে চরিত্র হয়ে আমিও বেঁচে থাকি। এই আবদারে এই অনুরোধে রাজনীতি নেই, রাষ্ট্রিক ক্ষমতা প্রয়োগ নেই, কৌশলগত অবস্থান নেই। আছে রূপলোক থেকে অরূপলোকে রূপান্তরিত হবার তীব্র ব্যাকুলতা। নশ্বর দেহ হারিয়ে মাস্টার উইলিয়াম শেক্সপিয়ারের অবিনশ্বর অমৃত নাট্যসমুদ্র অবগাহন করে নাট্যকার সৃষ্ট অমৃত চরিত্র হয়ে মিলিয়ে যাওয়া। এটুকু দাবি কি আমি করতে পারি মাস্টার উইলিয়াম শেক্সপিয়ার।
উইলিয়াম শেক্সপিয়ার     : ইউর মেজেস্ট্রি রানী এলিজাবেথ। আপনার মূল্যায়নে আমি তৃপ্ত, আমি আনন্দিত, আমি আপ্লুত। কোনদিন বলার সাহস পাইনি তাই বলিনি। আজ বলছি। সন্তানের প্রশাংসা করলে যেমন মা খুশি হয়, তেমনি আমার সব ঐতিহাসিক চরিত্র ষষ্ঠ হেনরি, দ্বিতীয় রিচার্ড, কিংজন, পঞ্চম হেনরি রচনার প্রেরণায় ইউর মেজেস্ট্রি রানী এলিজাবেথ আপনার মনোযোগ পাওয়ার তীব্র তাড়না, তীব্র ব্যাকুলতা। সে ব্যাকুলতা আমার পূর্ণ হয়েছে। আপনার স্নেহের দৃষ্টি লাভ আমি করেছি। দিনে দিনে আমার সাহস, আমার মনোবল বেড়েছে। আমি চেয়েছি আপনাকে জানতে, আপনাকে বুঝতে, আপনাকে নাটক রচনার ভালবাসার বন্ধনে বাঁধতে। উপায় খুঁজতে খুঁজতে বুঝেছি সমকালে জীবন্ত চরিত্রকে নাটকে বাঁধলে সে নাটক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত, দর্শক ভাবনায় ব্যর্থ হবার সমূহসম্ভাবনা। তাহলে কি করণীয়! ভাবি আর ভাবি। উত্তর খুঁজে পাই না। হঠাৎ একদিন পেয়ে গেলাম সে উত্তর। সে উত্তর তীরের বাণ ছুড়তে বাণকে পিছনে টেনে নিয়ে ছাড়ার উত্তর। রাজা অষ্টম হেনরি আপনার পিতা, তিনি সফল রাষ্ট্রনায়ক এবং আপনি তার কন্যা। তাকে নিয়ে লিখলেই অনিবার্যভাবে এসে পড়বেন আপনি। আর সেই আপনিই হবেন আমার প্রণতির আপনি, বিদ্রোহীর আপনি, ইংল্যান্ডেশ্বরী আপনি। নাটক রাজা অষ্টম হেনরিকে নিয়ে লিখবো পুরো নাটকটা। কি লিখবো কিভাবে লিখবো সে সবই আমার ইতোমধ্যে ভাবা। সব থেকে বেশি ভাবা নাটকটির সমাপ্তির দৃশ্যায়ন। ইউর মেজিস্ট্রি রানী এলিজাবেথ, আমি ইতোমধ্যে যত নাটক লিখেছি সে সব নাটকের রচনার শুরুতে আমি গবেষণা, জানা-শোনার মধ্য দিয়ে আগে নিশ্চিত হয়েছি আমার নাটকের শেষটা কি। আমি রোমে যেতে চেয়েছি, চলতি পথে ক্লান্ত হলে হাঁটার বদলে ঘোড়ায় চড়েছি, ঘোড়ার বদলে নৌকায় উঠেছি, নৌকার বদলে জাহাজে উঠেছি কিন্তু রোমে পৌঁছাতে চেয়ে রোমেই পৌঁছেছি। রাজা অষ্টম হেনরি নাটক রচনা করতে চেয়েছি ভবিতব্যের ইউর মেজেস্ট্রি রানী এলিজাবেথের আগমনকে স্বাগত জানাতে, রানী এলিজাবেথের প্রতি শ্রদ্ধা প্রকাশ করতে, একটা রেঁনেসার আলোকবর্তিকাকে ধ্রুবসত্য হিসাবে জানতে আর জানাতে। আর এটা করতে যেয়ে রানী এলিজাবেথ প্রতিষ্ঠিত ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির অভিমুখ ভারতবর্ষের বৌদ্ধধর্মের প্রবক্তা বুদ্ধদেবের শৈশবে, বুদ্ধদেবের পিতা রাজা শুদ্ধধন যে পথ অবলম্বন করেছে সেই পথ অবলম্বন করে। পিতা রাজা শুদ্ধধন রাজসভায় রাজ জ্যোতিষীকে এনে বুদ্ধদেবের কুষ্টি গণনা করে তার ভবিষ্যত জানেন। জানেন ভবিষ্যতে এ গৌতম হয়ে শ্রেষ্ঠ রাজা হবেন, নচেৎ শ্রেষ্ঠ সন্ন্যাসী হবেন। আমিও তদ্রুপ নাটকের শেষ দৃশ্যে রাজা অষ্টম হেনরির রাজসভায় রাজা অষ্টম হেনরির আমন্ত্রণে রাজযাজক আর্কবিশপ ক্র্যানমারকে দিয়ে নব শিশু এলিজাবেথের সম্বন্ধে ভবিষ্যতবাণী প্রদানের মধ্য দিয়ে আজকের ইউর মেজেস্ট্রি রানী এলিজাবেথকে শিল্পের রঙে অঙ্কন করব বলে মনস্থির করেছি। মন শুধু স্থিরই করিনি শিশু এলিজাবেথকে দেখে আর্কবিশপ ক্র্যানমার কি ভবিষ্যতবাণী করবে তার খসড়া আমি লিখে ফেলেছি এবং মনের ইচ্ছা ছিল যদি আপনার সামনে পড়ে শোনানোর সুযোগ পাই। সে কথা ভেবে লেখার খসড়াটা নিয়েও এসেছি ইউর মেজেস্ট্রি। আপনার সম্মতি পেলে আমি পড়ে শোনাতে আকুল ইউর মেজিস্ট্রি রানী এলিজাবেথ।
রানী এলিজাবেথ : মাস্টার উইলিয়াম শেক্সপিয়ার। আমি সারাজীবন ধরে এই ইংল্যান্ডকে শিল্পে-বাণিজ্যে সম্পদে সাজিয়ে তুলেছি। আর আপনি সাহিত্যে-কাব্যে-গানে-ছন্দে-নাটকে ইংল্যান্ডকে সমৃদ্ধ করেছেন। আমাদের দুজনের পথ ভিন্ন কিন্তু উদ্দেশ্য এক আর তাহলো দেশ মাতৃকার সেবা করা। আমি ইংল্যান্ডের সাম্রাজ্যের সম্রাজ্ঞী আর আপনি নাট্য সাম্রজ্যের সম্রাট। আমার আসন পৃথিবী ভূখ-ে আমি রানী, আপনার আসন মানব মনে আপনি শিল্পী। আপনার রচিত নাটকের মধ্য দিয়ে আমি হতে চলেছি পৃথিবী ভূখন্ড এবং মানব মনের অখ- সত্তার হৃদয়মণি। তবে আর দেরি কেন মাস্টার উইলয়াম শেক্সপিয়ার? আপনার লেখা শুনতে আমি অধীর আগ্রহী।
উইলিয়াম শেক্সপিয়ার     : রাজপর্যদ পরিবৃত রাজা অষ্টম হেনরির অনুরোধে শিশু এলিজাবেথকে দীক্ষা প্রদান শেষে লর্ড আর্কবিশপ ক্র্যানমার বললেন, ‘এই মুহূর্তে আমি যেটা বলতে চলেছি সেটি কারো কারো কাছে মনোরঞ্জন বলে মনে হলেও ভবিষ্যত এ কথা সত্য বলেই প্রমাণিত হবে। আজ যে শিশু দোলনায় বসা, ভবিষ্যতে সে হবে সমস্ত রানীর আদর্শ স্থান। জ্ঞান ও ন্যায় বিচারের দিক থেকে সে সকল রানীকে ছাড়িয়ে। সততা, চারিত্রিক পবিত্রতা এবং রাজকীয় মহিমা তার সম্বল। তাকে জনগণ ভালবাসবে আবার ভয় করবে। তার মিত্ররা তাকে উচ্ছ্বাসে আশীর্বাদ করবে আর শত্রুরা ভয়ে পদদলিত দুর্বার  মাথা নত হয়ে থাকবে। তার রাজত্বে মানুষ পেট পুরে খাবে, নিশ্চিন্তে নিদ্রা যাবে। মানুষ সামরিক কৃতিত্ব না দেখিয়েও বড় হবে। পার্থিব এবং আধ্যাত্মিক শক্তি জাগরণ ঘটবে। তিনি যোগ্য উত্তরাধিকারী নির্বাচন করেই চোখ বুজবেন। তিনি চিরদিনই কুমারী থাকবেন এবং তার কুমারী জীবন অনাঘাত অস্পৃষ্ঠ ফুলের মতো নিষ্কলঙ্ক ও পবিত্র থেকে যাবে। তিনি জীবদ্দশায় এবং মৃত্যু পরবর্তী সময়েও প্রবল প্রতাপ রানী হিসেবেই মানুষের মনে বিরাজ করবেন। বংশ পরম্পরায় নতুন নতুন বংশধররা রানী এলিজাবেথকে দেখেশুনে জেনে এক অপার্থিব মুগ্ধ বিস্ময় আনন্দে নিজেদের মধ্যে ধারণ করবে। ইংল্যান্ড এবং রানী এলিজাবেথ সমার্থক ও সদার্থক শব্দ হয়ে মহাকালে প্রবাল প্রতাপে জ্বলজ্বল করে জ্বলবে এবং বিচরণ করবে’।
রানী এলিজাবেথ : আপনার লেখনি চিরন্তন হোক মাস্টার শেক্সপিয়ার।
উইলিয়াম শেক্সপিয়ার     : কালে কালে আমার মতো নাটকের মানুষেরা যেন আপনার মতো মানুষের কাছে আশ্রয় পায় ইউর মেজেস্ট্রি রানী এলিজাবেথ।
রানী এলিজাবেথ : আপনি আশ্রয় পেলেন আমার রাজত্বে আর আমি আশ্রয় পেলাম আপনার অমর নাট্যসাহিত্যে মাস্টার উইলিয়াম শেক্সপিয়ার।
উইলিয়াম শেক্সপিয়ার     : আপনি রানী আমি বাণী, আমাদের উভয়ের পথ ভিন্ন কিন্তু উদ্দেশ্য এক মাই মেজেস্ট্রি, আর তা হলো...........।  
রানী এলিজাবেথ ও উইলিয়াম শেক্সপিয়ার [সমস্বরে] : দেশ ও দশের সেবায় আমরা করতে পেরেছি আমাদের সর্বস্ব অর্পণ।
উইলিয়াম শেক্সপিয়ার     : ইউর মেজেস্ট্রি এলিজাবেথ, তবে আমি আসি।
রানী এলিজাবেথ : মাস্টার উইলিয়াম শেক্সপিয়ার, শ্রুতিতে-স্মৃতিতে এবং ইতিহাসে আপনার সাথে আমিও যেন পুনঃ ফিরে ফিরে আসি।

 

 

×