ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

তিস্তার চরে নারী শিক্ষা

তাহমিন হক ববী

প্রকাশিত: ০০:১৩, ২৬ মে ২০২৩

তিস্তার চরে নারী শিক্ষা

.

বন্যা, খরা, নদীভাঙনে দিশাহারা ছিল তিস্তা নদীর কালিকাপুর চর গ্রামটির মানুষজন। তিস্তার পারের কালিকাপুর চরবাসীরা পিছিয়ে ছিল নারী শিক্ষায়। চরে মাধ্যমিক স্কুল না থাকায় সেখানকার মেয়েরা শিক্ষায় পিছিয়ে পড়েছিল। আজ সেটি ঘুচিয়ে সেখানকার মেয়েরা এখন ছুটছে স্কুলে। যার মাধ্যমে অন্ধকার চরে তাদের ফিরেছে আলোকিত জীবন।

মেয়েদের সার্বিক উন্নতির জন্য শিক্ষা গ্রহণকেই সর্বাগ্রে জোর দিয়েছিলেন নারী জাগরণের অগ্রদূত রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেন। কলকাতার লর্ড সিনহা রোডে বেগম রোকেয়ার প্রতিষ্ঠিত সাখাওয়াত মেমোরিয়াল সরকারি বালিকা বিদ্যালয় আজও গৌরব ঐতিহ্য বহন করে চলছে। তাই বেগম রোকেয়াকে স্মরণ করেই তিস্তা নদীর দুর্গম চরে নারী শিক্ষায় ভূমিকা রাখছেনদী জীবন বিদ্যালয় তিস্তার চরের মেয়েদের শিক্ষার আলো ঘরে ঘরে পৌঁছে দিতেই কালিকাপুর চরে নদী জীবন নি¤œ মাধ্যমিক বিদ্যালয়টি প্রতিষ্ঠিত হয়।

২০০৮ সালে উক্ত তিস্তার চরে পূর্বে নারী শিক্ষার্থীরা প্রাথমিক বিদ্যালয়ের পর পড়াশোনার তেমন একটা সুযোগ পেতেন না। তবে কিছু সচ্ছল পরিবারের মেয়েরা আত্মীয়ের বাড়ি থেকে মাধ্যমিক স্কুলে পড়াশোনা করতেন।

২০০৮ সালে কালিকাপুর চরেনদী জীবননিম্ন মাধ্যমিক বিদ্যালয়টি প্রতিষ্ঠিত হয়। এটি তিস্তা নদীর বুকে দুর্গম চরে প্রথম মাধ্যমিক বিদ্যালয়। এই বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা হওয়ায় এখন দুর্গম চরের নারী শিক্ষার্থীরা মাধ্যমিক স্কুলে পড়ার সুযোগ পাচ্ছে।

কালিকাপুর চরের লোকজন বলেন, একটি বেসরকারি সংস্থারনদী জীবননামে একটি অনুষ্ঠানে কালিকাপুর চরে এসেছিলেন বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর . আতিউর রহমান। তিনি বেগম রোকেয়ার কথা স্মরণ করিয়ে দিয়ে চরের মেয়েদের লিখাপাড়ার জন্য স্থানীয় লোকজনকে একটি মাধ্যমিক বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করতে অনুপ্রেরণা যোগান। এটি প্রতিষ্ঠায় এলাকার মোছলেম উদ্দিন শ্রম দিয়েছিলেন তার সহায়তায় চরের লোকজন গড়ে তোলেন বিদ্যালয়টি। এটির নাম দেওয়া হয়নদী জীবননি¤œ মাধ্যমিক বিদ্যালয়।

কালিকাপুর চরের কৃষক নাজির হোসেন (৬৭) বলেন, ‘নদী জীবনবিদ্যালয়টি প্রতিষ্ঠার পর থেকে চরের  মেয়েরা মাধ্যমিকে পড়ার সুযোগ পাচ্ছে। বিশেষ করে চরের মেয়েদের শিক্ষিত করতে বিদ্যালয় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে। আগে এই চরের মেয়েরা সর্বোচ্চ পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত পড়াশোনা করার সুযোগ পেত।নদী জীবনবিদ্যালয়টি হওয়ার পর চরের অনেক মেয়ে উচ্চ শিক্ষিত হয়েছে। বিদ্যালয়টি দুর্গম চরে শিক্ষার প্রদীপ জ্বালিয়েছে।

আমাদের চরের এই স্কুলে সরকার যদি একটু চোখ তুলে তাকান তাহলে পুরো স্কুলটি মডেলে পরিণত হতে পারে। তারা জানায় স্কুলে আগে তিনজন ম্যাডাম ছিলেন। তারা এখন আসেন না। তবে আমাদের কোনো সমস্যা হয় না। মোছলেম দাদুসহ অন্য শিক্ষকরা আমাদের শিক্ষাদান করেন।

এই স্কুলের একজন শিক্ষক মোছলেম উদ্দিন। বয়স প্রায় ৮০ ছুঁই ছুঁই। তিস্তার চর কালিকাপুর গ্রামের বাসিন্দা তিনি। ১৯৬৯ সালে ২৩ বছর বয়সে মোসলেম উদ্দিন এসএসসি পাস করেন। সে সময় শৌলমারী কালিকাপুর চরে তিনি ছিলেন একমাত্র এসএসসি পাস ব্যক্তি। আত্মীয়ের বাড়িতে থেকে তিনি লেখাপড়া করেছিলেন। চরে একসময় মাধ্যমিক বিদ্যালয় না থাকায় তিনি তার দুই ছেলে চার মেয়েকে উচ্চশিক্ষিত করতে পারেননি। তাই তিনি ২০০৮ সালে চর কালিকাপুর নিম্ন মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে বিনা বেতনে ১৫ বছর ধরে চরের মেয়েদের মা বাবা, স্যার, ম্যাডামের ভূমিকায় শিক্ষিত করে তুলছেন। তাঁর ম্প বলতে দুই বিঘা জমি ছাড়া কিছু নেই। দুই ছেলে বিয়ে করে আলাদা থাকেন। মেয়েরা স্বামীর সংসারে। স্ত্রী বেনোয়ারা বেগমকে নিয়ে সুখ-দুঃখের জীবন মোসলেম উদ্দিন।

তাকে দেখা গেল চোখে চশমা, হাতে ঘড়ি, সাদা রঙের পায়জামা আর পাঞ্জাবির সঙ্গে কালো রঙের কোট পড়ে ক্লাস নিতে। পড়া। মোছলেম উদ্দিন বলেন, তিস্তাপারের দুর্গম এই চরে মাত্র একটি নিম্নমাধ্যমিক বিদ্যালয়। এখানে বেশিরভাগ শিক্ষার্থীই দরিদ্র পরিবারের সন্তান। বিদ্যালয়টি এখনো এমপিওভুক্ত হয়নি। এখানে একজন ইংরেজি শিক্ষক থাকলেও তিনি নিয়মিত আসতে পারেন না। তাই এই বিদ্যালয়ে ইংরেজি বিষয়ের পাঠদান করেন শিক্ষানুরাগী এই ব্যক্তি। তাঁর পাঠদানের আন্তরিকতায় মুগ্ধ শিক্ষার্থী অভিভাবকেরা। বেতন-ভাতা ছাড়াই ১৫ বছর ধরে তিনি বিদ্যালয়ে পাঠদান করাচ্ছেন।

শিক্ষার্থী জানায় মোছলেম স্যার সবার আগে আসেন, বিদ্যালয় ছুটি হওয়ার পর সবার শেষে চলে যান। তিনি চরের শিক্ষার্থীদের জীবন শিক্ষার আলোয় আলোকিত করতে নিবেদিত। এই শিক্ষকের চরের মধ্যে অল্প জমিতে চাষাবাদ করেন।

সপ্তম শ্রেণির ছাত্রী সুমাইয়া আক্তার, আল্পনা আক্তার জানায়, মোসলেম উদ্দিন স্যার সুন্দর করে ইংরেজি  পড়ান। আমরা বুঝতে না পারলে আবার পড়ান, কখনো রাগ করেন না। উনি তো চাকরি করেন না, মনের টানে স্কুলে আসেন, উনি আমাদের মা, বাবা স্যার দাদু।

বিদ্যালয়টির প্রধান শিক্ষক মাহবুবুর রহমান বলেন, ‘বিদ্যালয়টি এমপিওভুক্ত না হওয়ায় প্রতিষ্ঠাকালীন অনেক শিক্ষক চাকরি ছেড়ে দিয়েছেন। নতুন কিছু শিক্ষক যোগদান করেছেন। বিনা পারিশ্রমিকে আমরা শিক্ষার্থীদের পড়াচ্ছি। চরে নারী শিক্ষার বিস্তার ঘটানো আমাদের উদ্দেশ্য। বিদ্যালয়টি এমপিওভুক্ত হলে এটি দুর্গম চরে নারী শিক্ষা বিস্তারে আরও বেশি ভূমিকা রাখবে।

×