‘আচারকন্যা’ মঞ্জু
গোপালগঞ্জের টুঙ্গিপাড়ার বাংলাদেশের স্থপতি-বাঙালী জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সমাধি সৌধে শ্রদ্ধাঞ্জলি নিবেদন, পদ্মা সেতু পরিভ্রমণ এবং বঙ্গবন্ধুর জন্মভূমি গোপালগঞ্জ প্রেস ক্লাবের নেতৃবৃন্দের সঙ্গে মতবিনিময়ের উদ্দেশ্যে যাত্রা করি। এর সঙ্গে বাড়তি একটি বিনোদনেও মনোযোগী হয়েছিলাম। তা হলো গোপালগঞ্জের হিরণ্যকান্দি গ্রামের শতবর্ষী আমগাছের ও এক ‘আচারকন্যা’র দর্শন।
তখন বেলা সাড়ে ১১টা। খোঁজ পেলাম একটি শতবর্ষী আমগাছের (তাছাড়া দেখলাম হিরণ্যকান্দি বাসস্ট্যান্ডের পাশেও ‘শতবর্ষী আমগাছ’ লিখে তীর চিহ্ন দিয়ে একটি সাইনবোর্ড টানানো)। সময় নষ্ট না করে পড়িমড়ি করে দলবেঁধে ছুটলাম হিরণ্যকান্দিতে সেই ঐতিহ্যবাহী আ¤্রবৃক্ষ পরিদর্শন করতে।
গোপালগঞ্জ জেলা সদর থেকে ৪০ কিলোমিটার দূরে হিরণ্যকান্দি গ্রাম। এটা কাশিয়ানী থানার অন্তর্গত। ঢাকা-খুলনা মহাসড়কে হিরণ্যকান্দি বাসস্ট্যান্ডে নেমে পূর্বদিকে মেঠোপথ ধরে প্রায় মিনিট পাঁচেক হাঁটলেই দেখা মিলবে এই গাছের। রোজ গাছটি দেখতে শত শত লোক ভিড় করে। ঈদ, পূজা, পহেলা বৈশাখসহ বিশেষ দিনগুলোতে হাজারো মানুষের সমাগম ঘটে। এছাড়া বনভোজন মৌসুমে এখানে পিকনিক পার্টি এসে সবুজ বনানীর ছায়াতলে নিরিবিলি পরিবেশে বনভোজনেও মাতেন। ক্লান্ত দুপুরে অনেকেই একটু প্রশান্তি পেতে আমগাছের নিচে বিশ্রাম নেন। এ আমগাছ তলায় পহেলা বৈশাখ ও দুই ঈদে মেলা বসে।
জানা যায়-কিনু শেখ প্রায় ১৫০ বছর আগে নিজের জমিতে এই আমগাছ রোপণ করেন। বর্তমানে তার বংশধর বাচ্চু শেখ ও তার দুই ভাইয়ের প্রায় ৫৭ শতাংশ জমির ওপর শতবর্ষী এই আমগাছটি এখনও দাঁড়িয়ে আছে কালের সাক্ষী হয়ে। গাছটির বয়স নিয়ে এলাকার মানুষের নানা মত। কেউ বলেন, এর বয়স ১০০’র বেশি। কেউ বলেন দেড়শো। কেউবা আবার বলেন ২০০! তবে যে যাই বলুক, এই গাছের বয়স যে কমপক্ষে ১০০, তাতে কোন সন্দেহ নেই। বাংলাদেশের আমগাছের গড়পড়তা আয়ুষ্কাল ১০০ বছর। কখনও এর বয়স ১২৫ হতে পারে। কাজেই ২০০ বছরের ধারণাকে মেনে নেয়ার পক্ষে যুক্তি দুর্বল।
হিরণ্যকান্দির এ গাছে প্রচুর আম ধরে। বিশালকায় গাছটির বিশালতা দেখার মতো। গাছের নয়টি কাণ্ড বটগাছের কাণ্ডের মতো মাটি ছুঁয়ে রয়েছে। গাছের নিচে অন্য কোন গাছ বা আগাছা নেই। সবমিলিয়ে এক নয়নাভিরাম দৃশ্য।
এই গাছ দেখতে গিয়েই দেখা পেলাম ৩৫ বছর বয়সী ‘আচার কন্যা’ মঞ্জু আরার। এই গাছের সামান্য দূরেই (স্থানটাকে সবাই আমতলী নামেই চেনে) স্বল্প আয়তনের এক উন্মুক্ত টিনের চালায় আচারের পসরা সাজিয়ে বসেছেন (তার দোকানের কোন সাইনবোর্ড নেই) একেবারেই সহজ-সরল মাটির মানবী। তবে তার কথার মাঝে ঝাঁজ আছে।
একটা কথাও মাটিতে পড়তে দেন না। বলেন, ‘পদ্মা সেতু আমার কপাল খুইলে দিছে। আপনেরা সরকারী চাকরি করে কত টাকা কামান। মাসে এখন আমার ইনকাম আপনাদের চাইতেও বেশি। আমি আপনাদের মত শিক্ষিত না এটা ঠিক, তবে মূর্খও না।’
আত্মবিশ্বাসী ও স্বাবলম্বী মঞ্জু নিজ হাতে বানিয়ে ২৮ পদের আচার বিক্রি করেন। এ কাজে তার স্বামী তাকে সাহায্য করেন। তবে এত পদের আচার দোকানে আনা সম্ভব হয় না। কারণ তার লোকবল নেই। তাই ৯/১০ পদের বেশি আনতে পারেন না।
এক যুগেরও বেশি সময় ধরে এই আচার ব্যবসা করছেন সংগ্রামী মঞ্জু। আচারের ব্যবসার লাভের অর্থ দিয়ে তিল তিল করে গড়ে তুলেছেন নিজের থাকার পাা মেঝের টিনের ঘর। কিনেছেন জমি (আট দফায় প্রায় ১৪৭ শতাংশ)। অথচ ধারের টাকা দিয়ে ব্যবসাটা শুরু করেছিলেন! তখন তার স্বামী অসুস্থ। তার প্রথম চালান ছিল মাত্র দেড় শ’ টাকার।
আর এখন পাঁচ লাখ টাকার চালান তার! পদ্মা সেতুর তৈরির আগে তার আচার বিক্রি থেকে দৈনিক আয় ছিল এক থেকে দেড় হাজার টাকা। পদ্মা সেতু চালুর পরে সেটা প্রায় দ্বিগুণ হয়ে গেছে। তবে একদিন তিনি সর্বোচ্চ ৮ হাজার টাকার আচার বিক্রি করেছিলেন।
মমতাময়ী ও দায়িত্বশীল মা-ও মঞ্জু, ব্যবসা বাড়ানো নিয়ে ভাবেন না। বলেন, ‘যেভাবে চলতাছে চলুক। ছেলেমেয়েরে মানুষ করা, তাগো ভাল বিয়া দিতে পারলেই আমি খুশি।’ ২০০৪ সালে বিয়ে করা মঞ্জু ও হাসমত মোল্লার ১৬ বছরের ছেলে হাসিব ও ১০ বছরের মেয়ে ফাতেমা দুজনেই এখন মাদ্রাসায় লেখাপড়া করে। এই এলাকায় তিনিই একমাত্র নারী-আচার ব্যবসায়ী।
তার আচারের অনেক সুনাম। দূর-দূরান্ত থেকে লোকজন এসে আচার কিনে খায় ও বাড়ির জন্য নিয়েও যায়। মঞ্জু আরার এই সফল জীবন-সংগ্রাম অনুপ্রেরণার উৎস হতে পারে অন্য নারীদের।