ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

‘আচারকন্যা’ মঞ্জুর জীবন সংগ্রাম

রুমেল খান

প্রকাশিত: ০১:১৫, ২ আগস্ট ২০২২

‘আচারকন্যা’ মঞ্জুর জীবন সংগ্রাম

‘আচারকন্যা’ মঞ্জু

গোপালগঞ্জের টুঙ্গিপাড়ার বাংলাদেশের স্থপতি-বাঙালী জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সমাধি সৌধে শ্রদ্ধাঞ্জলি নিবেদন, পদ্মা সেতু পরিভ্রমণ এবং বঙ্গবন্ধুর জন্মভূমি গোপালগঞ্জ প্রেস ক্লাবের নেতৃবৃন্দের সঙ্গে মতবিনিময়ের উদ্দেশ্যে যাত্রা করিএর সঙ্গে বাড়তি একটি বিনোদনেও মনোযোগী হয়েছিলামতা হলো গোপালগঞ্জের হিরণ্যকান্দি গ্রামের শতবর্ষী আমগাছের ও এক আচারকন্যার দর্শন

তখন বেলা সাড়ে ১১টাখোঁজ পেলাম একটি শতবর্ষী আমগাছের (তাছাড়া দেখলাম হিরণ্যকান্দি বাসস্ট্যান্ডের পাশেও শতবর্ষী আমগাছলিখে তীর চিহ্ন দিয়ে একটি সাইনবোর্ড টানানো)সময় নষ্ট না করে পড়িমড়ি করে দলবেঁধে ছুটলাম হিরণ্যকান্দিতে সেই ঐতিহ্যবাহী আ¤্রবৃক্ষ পরিদর্শন করতে

গোপালগঞ্জ জেলা সদর থেকে ৪০ কিলোমিটার দূরে হিরণ্যকান্দি গ্রামএটা কাশিয়ানী থানার অন্তর্গতঢাকা-খুলনা মহাসড়কে হিরণ্যকান্দি বাসস্ট্যান্ডে নেমে পূর্বদিকে মেঠোপথ ধরে প্রায় মিনিট পাঁচেক হাঁটলেই দেখা মিলবে এই গাছেররোজ গাছটি দেখতে শত শত লোক ভিড় করেঈদ, পূজা, পহেলা বৈশাখসহ বিশেষ দিনগুলোতে হাজারো মানুষের সমাগম ঘটেএছাড়া বনভোজন মৌসুমে এখানে পিকনিক পার্টি এসে সবুজ বনানীর ছায়াতলে নিরিবিলি পরিবেশে বনভোজনেও মাতেনক্লান্ত দুপুরে অনেকেই একটু প্রশান্তি পেতে আমগাছের নিচে বিশ্রাম নেনএ আমগাছ তলায় পহেলা বৈশাখ ও দুই ঈদে মেলা বসে

জানা যায়-কিনু শেখ প্রায় ১৫০ বছর আগে নিজের জমিতে এই আমগাছ রোপণ করেনবর্তমানে তার বংশধর বাচ্চু শেখ ও তার দুই ভাইয়ের প্রায় ৫৭ শতাংশ জমির ওপর শতবর্ষী এই আমগাছটি এখনও দাঁড়িয়ে আছে কালের সাক্ষী হয়েগাছটির বয়স নিয়ে এলাকার মানুষের নানা মতকেউ বলেন, এর বয়স ১০০র বেশিকেউ বলেন দেড়শোকেউবা আবার বলেন ২০০! তবে যে যাই বলুক, এই গাছের বয়স যে কমপক্ষে ১০০, তাতে কোন সন্দেহ নেইবাংলাদেশের আমগাছের গড়পড়তা আয়ুষ্কাল ১০০ বছরকখনও এর বয়স ১২৫ হতে পারেকাজেই ২০০ বছরের ধারণাকে মেনে নেয়ার পক্ষে যুক্তি দুর্বল

হিরণ্যকান্দির এ গাছে প্রচুর আম ধরেবিশালকায় গাছটির বিশালতা দেখার মতোগাছের নয়টি কাণ্ড বটগাছের কাণ্ডের মতো মাটি ছুঁয়ে রয়েছেগাছের নিচে অন্য কোন গাছ বা আগাছা নেইসবমিলিয়ে এক নয়নাভিরাম দৃশ্য

এই গাছ দেখতে গিয়েই দেখা পেলাম ৩৫ বছর বয়সী আচার কন্যামঞ্জু আরারএই গাছের সামান্য দূরেই (স্থানটাকে সবাই আমতলী নামেই চেনে) স্বল্প আয়তনের এক উন্মুক্ত টিনের চালায় আচারের পসরা সাজিয়ে বসেছেন (তার দোকানের কোন সাইনবোর্ড নেই) একেবারেই সহজ-সরল মাটির মানবীতবে তার কথার মাঝে ঝাঁজ আছে

একটা কথাও মাটিতে পড়তে দেন নাবলেন, ‘পদ্মা সেতু আমার কপাল খুইলে দিছেআপনেরা সরকারী চাকরি করে কত টাকা কামানমাসে এখন আমার ইনকাম আপনাদের চাইতেও বেশিআমি আপনাদের মত শিক্ষিত না এটা ঠিক, তবে মূর্খও না

আত্মবিশ্বাসী ও স্বাবলম্বী মঞ্জু নিজ হাতে বানিয়ে ২৮ পদের আচার বিক্রি করেনএ কাজে তার স্বামী তাকে সাহায্য করেনতবে এত পদের আচার দোকানে আনা সম্ভব হয় নাকারণ তার লোকবল নেইতাই ৯/১০ পদের বেশি আনতে পারেন না

এক যুগেরও বেশি সময় ধরে এই আচার ব্যবসা করছেন সংগ্রামী মঞ্জুআচারের ব্যবসার লাভের অর্থ দিয়ে তিল তিল করে গড়ে তুলেছেন নিজের থাকার পাা মেঝের টিনের ঘরকিনেছেন জমি (আট দফায় প্রায় ১৪৭ শতাংশ)অথচ ধারের টাকা দিয়ে ব্যবসাটা শুরু করেছিলেন! তখন তার স্বামী অসুস্থতার প্রথম চালান ছিল মাত্র দেড় শটাকার

আর এখন পাঁচ লাখ টাকার চালান তার! পদ্মা সেতুর তৈরির আগে তার আচার বিক্রি থেকে দৈনিক আয় ছিল এক থেকে দেড় হাজার টাকাপদ্মা সেতু চালুর পরে সেটা প্রায় দ্বিগুণ হয়ে গেছেতবে একদিন তিনি সর্বোচ্চ ৮ হাজার টাকার আচার বিক্রি করেছিলেন

মমতাময়ী  ও দায়িত্বশীল মা-ও মঞ্জু, ব্যবসা বাড়ানো নিয়ে ভাবেন নাবলেন, ‘যেভাবে চলতাছে চলুকছেলেমেয়েরে মানুষ করা, তাগো ভাল বিয়া দিতে পারলেই আমি খুশি২০০৪ সালে বিয়ে করা মঞ্জু ও হাসমত মোল্লার ১৬ বছরের ছেলে হাসিব ও ১০ বছরের মেয়ে ফাতেমা দুজনেই এখন মাদ্রাসায় লেখাপড়া করেএই এলাকায় তিনিই একমাত্র নারী-আচার ব্যবসায়ী

তার আচারের অনেক সুনামদূর-দূরান্ত থেকে লোকজন এসে আচার কিনে খায় ও বাড়ির জন্য নিয়েও যায়মঞ্জু আরার এই সফল জীবন-সংগ্রাম অনুপ্রেরণার উস হতে পারে অন্য নারীদের

×