ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

ডিজিটাল যুগের পথে-২

মোস্তাফা জব্বার

প্রকাশিত: ২০:৩৪, ৪ জুলাই ২০২২

ডিজিটাল যুগের পথে-২

কম্পিউটার প্রয়োগ

আশির দশকে কার্যত সরকারের নিষ্ক্রিয়তার মাঝেও আমরা কিছুটা ঘুরে দাঁড়াই সেই দশকের শেষের দিকে১৯৮৭ সালের ১৬ মে কম্পিউটারে বাংলা প্রয়োগ করে পত্রিকা বের করার আগ পর্যন্ত আমাদের পিসিচর্চা ছিল খুবই সীমিতবিশেষজ্ঞ কিছু মানুষ পিসির জগতে নড়াচড়া করতেনখুব স্বল্পসংখ্যক লোক এগুলো ব্যবহার করত

এই প্রযুক্তি শিক্ষা ও এর প্রয়োগের ক্ষেত্রেও আমরা থমকে থাকার মতো অবস্থাতেই বসবাস করতামতবে সাতাশির পর আমরা অনেকটা পথ অতিক্রম করেছিসেই সময়ে ব্যাপকভাবে জনপ্রিয় হওয়া মেকিন্টোস কম্পিউটারের সহজ ইন্টারফেস ও মাতৃভাষা ব্যবহারের সুযোগ আমাদের ব্যাপকভাবে সহায়তা করেএর ফলে বিগত শতকেই আমরা আমাদের মুদ্রণ ও প্রকাশনায় বিপ্লবটা সম্পন্ন করি

২০০০ সালের আগেই  দেশের উপজেলা, এমনকি ইউনিয়ন স্তর পর্যন্ত মুদ্রণ ও প্রকাশনায় কম্পিউটারের প্রয়োগ সম্পন্ন হয়ে যায়বিশেষ করে এর হাত ধরে অতি সাধারণ শিক্ষায় জড়িত তরুণ-তরুণীরা কম্পিউটার প্রযুক্তির ব্যবহারে দক্ষ হওয়ার ফলে এটি ধীরে ধীরে দৈনন্দিন জীবনের অংশে পরিণত হয়অন্যদিকে বিগত শতকেই বাংলাদেশে ইন্টারনেটের আগমন ঘটে এবং আমরা মোবাইল বিপ্লবের সূচনা করিবিগত শতকেই অফিস-আদালতে কম্পিউটারের প্রবেশ ঘটে এবং এমনকি ব্যবসা-বাণিজ্য ও ব্যাংকিং খাতে কম্পিউটারের প্রবেশ ঘটে

বাংলাদেশের তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি খাতের বড় ঘটনাগুলো ঘটতে থাকে ১৯৯৬ সাল থেকেতবে ৯৬ সালের বিদায়ী বিএনপি সরকার এ বিষয়ে সামান্যতম উদ্যোগও গ্রহণ করেনিএর আগের পুরো পাঁচটি বছর তারা এই খাতে নিষ্ক্রিয়তার মাঝে ডুবে থাকেঅথচ সারা দুনিয়ায় তখন তথ্যপ্রযুক্তির জোয়ার এসেছিলসেই সময়ে প্রথম কিছুটা সচেতনতা সৃষ্টি হয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের কারণে

এরপর তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তির সুবর্ণ সময়ের সূচনা হয় শেখ হাসিনা প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব গ্রহণ করার পর থেকেপ্রসঙ্গত উল্লেখ করা প্রয়োজন যে, বিগত শতকের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ চারটি ঘটনা বাংলাদেশের তথ্যপ্রযুক্তি বিকাশে ব্যাপক ভূমিকা পালন করে- সেই চারটিরই নেতৃত্ব ছিল আওয়ামী লীগ সরকার

১) ১৯৯৬ সালে বাংলাদেশ অনলাইন ইন্টারনেটের যুগে পা রাখেতত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে এর সূচনা হলেও বস্তুত আওয়ামী লীগ সরকার একে সুসংহত করে এবং আমরা অনলাইন ইন্টারনেটের যুগে বসবাস করা শুরু করি

২) ১৯৯৭ সালে বাংলাদেশে মোবাইল প্রযুক্তিকে উন্মুক্ত করা হয়এটিও আওয়ামী লীগ সরকারের একটি মাইলফলক কাজএই কাজটি না করা হলে আজকের মোবাইল বিপ্লব আমরা স্বপ্নেও ভাবতে পারতাম না

৩) ১৯৯৭ সালে সরকার বাংলাদেশ থেকে সফটওয়্যার রফতানি বাড়ানো বিষয়ে সুপারিশ করার জন্য বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের অধীনে একটি টাস্কফোর্স গঠন করেড. জামিলুর রেজা চৌধুরীর নেতৃত্বাধীন সেই টাস্কফোর্সের সদস্যরা (লেখক নিজেও এর সদস্য ছিলেন) সরকারের কাছে কম্পিউটারের ওপর থেকে শুল্ক ও ভ্যাট প্রত্যাহার করাসহ মোট ৪৫টি সুপারিশ পেশ করে এবং সরকার সেই সুপারিশগুলো গ্রহণ করে তার সব সুপারিশ বাস্তবায়নের জন্য সর্বাত্মক প্রয়াস গ্রহণ করে

সেই বছরেরই ১৮ ডিসেম্বর বাংলাদেশের সফটওয়্যার কেমন করে রফতানি করা যায় তার ওপর একটি সেমিনারের আয়োজন করা হয় যাতে ভারতের সফটওয়্যার সমিতি নাসকমের নির্বাহী পরিচালক প্রয়াত দেওয়াং মেহতা মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন এবং সরকারের পক্ষ থেকে মেহতাকে তার বক্তব্য অনুসরণ করার পরিপূর্ণ আশ্বাস প্রদান করা হয়

এই সেমিনারে দেয়া প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী ১৯৯৮ সালের ৪ জানুয়ারি আন্তঃমন্ত্রণালয়ের সভায় সফটওয়্যারকে শুল্কমুক্ত করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করাসহ যুগান্তকারী কিছু সিদ্ধান্ত নেয়া হয় যার একটি উল্লেখযোগ্য বাস্তবায়ন হচ্ছে- ’৯৮-৯৯ সালের বাজেটে কম্পিউটারের ওপর থেকে শুল্ক ও কর প্রত্যাহার

৪) ১৯৯৮-৯৯ সালের বাজেটে কম্পিউটারের ওপর থেকে শুল্ক ও ভ্যাট প্রত্যাহার করা হয়সরকারের এই সিদ্ধান্তের প্রভাবে এই প্রযুক্তি সহজলভ্য ও সাধারণ মানুষের ক্রয়ক্ষমতার মধ্যে আসেএই কাজটির প্রভাবেই আজ আমরা ডিজিটাল বাংলাদেশের কথা বলতে পারছি

আমি আগেই বলেছি, এই কয়টি বড় কাজই করেন বর্তমান প্রধানমন্ত্রী যখন তিনি প্রথমবারের মতো দেশের প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব গ্রহণ করেন তখনতথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তির প্রতি তার ব্যক্তিগত আগ্রহ এসব সিদ্ধান্ত নিতে তাকে উসাহিত করেছেএকই সময়ে তিনি দেশে কম্পিউটার শিক্ষার ব্যাপক প্রসারের উদ্যোগ গ্রহণ করেন

১৯৯২ সাল থেকে ধারাবাহিকভাবে লড়াই করতে করতে ১৯৯৬ সাল থেকে বাংলাদেশে নবম-দশম শ্রেণীতে কম্পিউটার বিষয়টি পাঠ্য করা হয়১৯৯৮ শিক্ষাবর্ষ থেকে উচ্চ মাধ্যমিক পর্যায়ে কম্পিউটার শিক্ষা বিষয়টি পাঠ্য হয়এই দুটি কাজ করতে বিএনপি সরকার এত বেশি সময় নেয় যে, এই বিলম্বের জন্য পুরো জাতি অন্তত ৩ বছর পিছিয়ে যায়বেগম জিয়ার সরকার ইচ্ছা করলেই ১৯৯৩ সালে নবম শ্রেণীতে এই বিষয়টি পাঠ্য করতে পারত১৯৯২ সালেই বিষয়টির পাঠক্রম তৈরি হয়ে গিয়েছিলএকই কারণে ১৯৯৩ বা ১৯৯৪ সালে বিষয়টি একাদশ শ্রেণীতে পাঠ্য হতে পারতকিন্তু তখনকার সরকার সেটিও করেনি

১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতা গ্রহণের পর উচ্চতর পর্যায়ে কম্পিউটার শিক্ষায় একটি বিপ্লব আসেবছরে ১০ হাজার প্রোগ্রামার তৈরির লক্ষ্য নিয়ে শেখ হাসিনার সরকার সকল ধরনের উদ্যোগ গ্রহণ করেএই সময়েই কম্পিউটার প্রশিক্ষণ ও স্নাতক পর্যায়ে কম্পিউটার শিক্ষার প্রসারে ব্যাপক উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়সরকারী বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে এই বিষয়ের আসন সংখ্যা বাড়ানো হয়

কোন কোন ক্ষেত্রে সেটি দ্বিগুণ করা হয়সেই সময়েই সফটওয়্যার এবং সেবা রফতানির জন্য বেশ কিছু পদক্ষেপ নেয়া হয় এবং একটি তথ্যপ্রযুক্তি নীতিমালা প্রণয়নের উদ্যোগ নেয়া হয়বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে এই বিষয়টি চালু করা থেকে শুরু করে আইসিটির অবকাঠামো  তৈরিতে সরকারের ভূমিকা ছিল ইতিবাচক

তার প্রথম শাসনকালে শেখ হাসিনার অমর কীর্তি হচ্ছে ৯১ সালে নিজে কম্পিউটারের সঙ্গে যুক্ত হওয়া, তার দলকে কম্পিউটারের যুগে নেয়া এবং ৯৬ সালের নির্বাচনকে ডিজিটাল পদ্ধতির নির্বাচনে পরিণত করা

৫) বিগত শতকের শেষ দিকে বাংলাদেশ কম্পিউটার সমিতি, বেসিস ও আইএসপিএবির জন্ম হয়এসব সমিতি তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তির বিকাশে খুবই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেবিশেষ করে, ১৯৮৭ সালের ২৬ জানুয়ারি জন্ম নেয়ার পর থেকেই বাংলাদেশ কম্পিউটার সমিতি কম্পিউটারকে জনপ্রিয়, সহজলভ্য ও ব্যবহারযোগ্য করার জন্য দেশব্যাপী ব্যাপক কর্মকা- পরিচালনা করে আসছে

১৯৯২ সালে নিবন্ধিত হওয়ার পর ১৯৯৩ সালে প্রথম কম্পিউটার মেলার আয়োজন করা থেকে শুরু করে কম্পিউটারের ওপর থেকে শুল্ক ও ভ্যাট প্রত্যাহার, ডিজিটাল যন্ত্রে বাংলা ভাষা প্রমিতকরণ, কম্পিউটার শিক্ষার প্রসার, ইন্টারনেটের বিকাশ, রাষ্ট্র-সমাজ-ব্যক্তির জীবনের ডিজিটাল রূপান্তর এবং শিক্ষায় কম্পিউটার প্রযুক্তির ব্যবহারসহ সকল নীতি নির্ধারণী কাজে এই সমিতির ব্যাপক ভূমিকা রয়েছে২০০৮ সালে সমিতি এজন্য রাষ্ট্রীয় পুরস্কারে ভূষিত হয়এখন এই সমিতির কেন্দ্রীয় কমিটির পাশাপাশি আঞ্চলিক কমিটিগুলোও ব্যাপকভাবে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তির প্রসারে কাজ করছে

তবে এটি উল্লেখ করা প্রয়োজন যে, ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর সমিতি যে ভূমিকা পালন করতে পেরেছে সেটি এর আগে এমনকি তার পরের ২০০১-০৭ সময়কালে পারেনি১৯৯৬-২০০১ সময়কালে বাংলাদেশ কম্পিউটার সমিতি কার্যত তাদের সকল প্রস্তাবাবলী ও দাবি বাস্তবায়ন করতে সক্ষম হয়

২০০৯ সালের পর সমিতি আবারও একটি আইসিটিবান্ধব সরকার পাওয়ার ফলে যুগান্তকারী অবদান রাখতে সক্ষম হয়বিগত এক যুগে সফটওয়্যার খাতের বিকাশে বেসিস, ইন্টারনেট খাতের বিকাশে আইএসপিএবি, মোবাইল খাতের বিকাশে এমটব এবং কলসেন্টারের বিকাশে বাকো তাদের উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করে যাচ্ছে

তবে আওয়ামী লীগের মতো আইসিটিবান্ধব সরকার না পেলে এসব সমিতিও তাদের কার্যকর ভূমিকা পালন করতে পারত না১৯৯৬-২০০১ সময়কাল তার উজ্জ্বল দৃষ্টান্তবাংলাদেশ কম্পিউটার কাউন্সিলও জন্ম নেয় বিগত শতকে১৯৮৩ সালে হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের আমলে একটি নিয়ন্ত্রক সংস্থা হিসেবে জাতীয় কম্পিউটার কমিটির জন্ম হয়সেটি পরে ১৯৯০ সালের বিসিসি আইনের আওতায় বাংলাদেশ কম্পিউটার কাউন্সিলে রূপান্তরিত হয়সেই সময়ে কোন কোন ক্ষেত্রে এর ভূমিকা ছিল বিভ্রান্তিকর

তবে ১৯৯৬ সালের পর আওয়ামী লীগ সরকার এই সংস্থাটিকে দেশের তথ্যপ্রযুক্তি বিকাশের সহায়ক একটি সংস্থায় পরিণত করে২০২১ সালে আমরা খুব সহজেই এটি উপলব্ধি করতে পারি যে, ৯৬-০১, ২০০৯-২১ সময়কালে এই সংস্থাটির প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেয়ার জন্য আওয়ামী লীগ যেসব কাজ করে তার সুফল এখন পাওয়া যাচ্ছেসার্বিকভাবে এই কথাটি বলতেই হবে যে, বিগত শতকে শেখ হাসিনা লীগ সরকারের প্রথম পাঁচ বছর ছিল দেশে এই খাতের বিকাশের উল্লেখযোগ্য প্রথম সময়

অন্যদিকে অন্য সরকারগুলো এই খাতটির গুরুত্ব তেমনভাবে উপলব্ধি করতে সক্ষম হয়নিতবে বেসরকারী খাত ১৯৮৭ সালের পর থেকে তাদের মতো করে নিজেদের পথ  তৈরি করে চলেছেবেসরকারী খাতের প্রচেষ্টা বেগম জিয়া ও এরশাদের সরকারসমূহের ব্যর্থতাকে অনেকটাই কাটিয়ে উঠতে সহায়তা করেছে

সেই সময়ে দেশের জনগণ একুশ শতকে যাত্রা করার জন্য আনুষঙ্গিক প্রস্তুতি গ্রহণ করেছিলহতে পারত যে, আমাদের প্রস্তুতি আরও সুসংহত ও কাঠামোগতভাবে সমৃদ্ধ করা যেতবিশেষ করে, হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের সময় থেকে বেগম জিয়ার সময়কাল পর্যন্ত আমাদের এই ক্ষেত্রে আগ্রহ আরও বেশি থাকতে পারত

ঢাকা, ২৬ মার্চ ১৯, আপডেট ২৫ জুন ২২

×