
ছবি: প্রতীকী
সকালের সময়টা হলো আমাদের সারা দিনের ভিত গড়ার সময়। একজন মানুষ দিনের শুরুটা যেমনভাবে করে, পুরো দিনটা প্রায় সেই ছাঁদেই চলে। কিন্তু আজকের দিনে আমরা অনেকেই ঘুম থেকে উঠে প্রথম কাজ হিসেবে মোবাইল ফোন হাতে নেই। ফেসবুক, ইনস্টাগ্রাম, টিকটক বা ইউটিউব খুলে বসি। ভাবি, “একটু দেখে নিই, তারপর কাজে মন দেব।” কিন্তু সেই “একটু” দেখতে দেখতেই কখন যে এক ঘণ্টা, কখনো তার বেশি সময় কেটে যায়, তা আমরা বুঝতেই পারি না।
এই এক ঘণ্টার ক্ষতি শুধু সময়ের দিক থেকেই নয়, মনোযোগ, কর্মক্ষমতা, এবং মানসিক অবস্থার দিক থেকেও মারাত্মক। সকালের এই এক ঘণ্টা যদি আমরা প্রোডাক্টিভ কোনো কাজে ব্যয় করতাম, যেমন – বই পড়া, হালকা ব্যায়াম, নামাজ, মেডিটেশন, পরিবারের সঙ্গে কথা বলা কিংবা দিনের পরিকল্পনা করা, তাহলে পুরো দিনটা অনেক বেশি সুশৃঙ্খল ও ফলপ্রসূ হতে পারত। কিন্তু সোশ্যাল মিডিয়ায় এই সময় নষ্ট করে আমরা সেই সুযোগটা নিজের হাতেই নষ্ট করি।
সোশ্যাল মিডিয়াতে সকালের সময় কাটালে মনের ওপর একটা অদৃশ্য চাপ পড়ে। আমরা অন্যের জীবন দেখি – কে কোথায় ঘুরছে, কে কী খাচ্ছে, কার চাকরি হলো, কে কী বলল। এসব দেখে অনিচ্ছাকৃতভাবেই আমরা নিজেদের সঙ্গে তুলনা করি। নিজের জীবনকে হীন মনে হতে শুরু করে। অথচ এসবের পেছনের বাস্তবতা আমরা জানি না। শুধু সাজানো পোস্ট দেখে নিজের মন খারাপ করে ফেলি। এভাবেই দিনের শুরুতেই আমাদের মন নেতিবাচক চিন্তায় ভরে ওঠে।
আরো খারাপ হয় যখন সোশ্যাল মিডিয়ার স্ক্রলিং করতে করতে সময়ের হিসাব থাকে না। আমরা ভাবি, এখনই মোবাইল রাখব, কিন্তু অ্যালগরিদম এমনভাবে কাজ করে যে একটার পর একটা কনটেন্ট আমাদের আকৃষ্ট করেই চলে। আমাদের ইচ্ছা থাকলেও আমরা তা থেকে বের হতে পারি না। মস্তিষ্ক ধীরে ধীরে অভ্যস্ত হয়ে যায় এই অকাজের প্রতি। তখন আর কাজে মন বসে না। ক্লান্তি লাগে, অলসতা আসে, এবং যেসব জরুরি কাজ করার কথা ছিল সেগুলো আমরা এড়িয়ে যাই।
সোশ্যাল মিডিয়াতে সকালের সময় ব্যয় করলে একটি বড় সমস্যা হচ্ছে – দিনের লক্ষ্য ঠিক করতে পারি না। অনেকেই বলে, “দিনের শুরুতে যদি ফোকাস ঠিক না থাকে, তাহলে পুরো দিনটাই এলোমেলো হয়ে যায়।” আমরা যেসব কাজ করার কথা ছিল, সেগুলো ঠিকভাবে মাথায় আনতেই পারি না, কারণ মস্তিষ্ক তখনো সোশ্যাল মিডিয়ার নানা রঙিন, বিরক্তিকর, কিংবা আবেগময় কনটেন্টে ডুবে থাকে।
অনেকেই ভাবে, “সকালে একটু দেখলে সমস্যা কী?” সমস্যা তখনই হয় যখন এই ‘একটু’টা রুটিনে পরিণত হয়। প্রতিদিনের সেই এক ঘণ্টা একত্র করলে মাস শেষে প্রায় ৩০ ঘণ্টা হয় – যা এক দিনেরও বেশি সময়। এই সময়টা যদি আমরা নিজেদের দক্ষতা বাড়ানো, নতুন কিছু শেখা, কিংবা শরীর-মন ঠিক রাখার কাজে লাগাতাম, তাহলে জীবন অনেক বেশি গঠনমূলক হতো। অথচ আমরা নিজের অজান্তেই নিজের সময়কে নষ্ট করছি।
সবচেয়ে বড় ক্ষতিটা হয় মনোযোগের। একবার মনোযোগ হারালে সেটা ফিরিয়ে আনতে সময় লাগে। সকালের এই এক ঘণ্টা মোবাইলে কাটিয়ে দিলে পরবর্তীতে আর কাজের গভীরে ঢোকা কঠিন হয়ে যায়। তখন আমরা সারাদিন শুধু “চেষ্টা করছি” কিন্তু “পারছি না” – এই মনোভাব নিয়ে কাটাই। দিন শেষে মনে হয়, “আজ কিছুই হলো না।”
এই “আজ কিছুই হলো না” আসলে সেই সকালের এক ঘণ্টার কারণেই। তাই যারা নিজের জীবন, সময়, এবং লক্ষ্যকে গুরুত্ব দেয়, তাদের উচিত দিনের প্রথম ঘণ্টাকে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দেওয়া। সোশ্যাল মিডিয়ায় সেই সময় না দিয়ে নিজেকে দেওয়া, নিজের উন্নয়ন আর মানসিক প্রশান্তির দিকে মন দেওয়া। নয়তো শুধু এক ঘণ্টার কারণে ২৪ ঘণ্টা ব্যর্থতায় রূপ নিতে বাধ্য।
পরের দিনগুলো যাতে সফল হয়, তার জন্য আজই সিদ্ধান্ত নিতে হবে – দিনের শুরুতে ফোন নয়, নিজের উন্নয়নের সময়। তাহলেই আমরা আসল সময়ের প্রকৃত মূল্য দিতে পারব।
এম.কে.