ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

ডাক্তাররা টেস্ট দেন কেন?

প্রকাশিত: ২০:৪১, ২৫ জানুয়ারি ২০২৩

ডাক্তাররা টেস্ট দেন কেন?

টেস্ট

আমরা সাধারণত শরীরে অসুস্থবোধ করলে কাছের কোন ফার্মেসী থেকে ওষুধ কিনে খাই। যখন আমাদের শরীরের অবস্থা বেশি খারাপ হয় তখন আমরা কোন বিশেষজ্ঞ কোন ডাক্তারের কাছে যাই। বেশিরভাগ মানুষের ধারনা যে, ডাক্তারের কাছে গেলেই শুধু পরীক্ষা-নিরীক্ষা করতে হয়। এই ধারনা কতটা যুক্তি সঙ্গত তা আজ আমরা জানবো।

প্রথমে ২টি ঘটনা বলি...

১। একবার ২ দিনের জ্বর নিয়ে ৩০ বছর বয়সী একজন রোগী আমাকে দেখালেন। আমি দেখার পর মনে হল ভাইরাল ফেভার। রোগীর প্রেসার কম আর খেতে পারছে না- তাই রুটিন টেস্ট দিয়ে ভর্তি করলাম।

ভর্তি হবার ২ ঘন্টা পর (তখনও রিপোর্ট আসেনাই) রোগী হঠাৎ খারাপ হয়ে গেল। রোগী খুবই restless, প্রেসার ২০০/১২০, শ্বাসকষ্ট হচ্ছে, রোগীকে আইসিইউ নেয়া হল। কিছুক্ষণ পর (৩০ মিনিট এর মধ্যে) রোগী মারা গেল।

ওই সময় আমি আর ভাগ্যক্রমে বিধু স্যার সেখানে উপস্থিত ছিলাম। রোগী মারা যাবার পর রিপোর্ট আসল।

আমরা দেখলাম platelet count 30000. রোগীর লোকের কাছে আবারো ইতিহাস নেয়া হল। রোগীর লোক বলল, গতকাল অনেক জ্বর হবার পর তাকে diclofen ট্যাবলেট দিয়েছিল গ্রামের ঔষধের দোকানদার। রোগীর platelet count কম ছিল। তার উপর diclofen খেয়ে ব্রেইনে রক্তক্ষরন হয়ে রোগী মারা গেছে।

শিক্ষনীয় হচ্ছে- platelet count দেখে তা নরমাল হলে তারপর NSAID দেয়া উচিত।

২। ৩/৪ দিন আগে একজন ডায়াবেটিসের রোগী জ্বর নিয়ে আমাকে দেখালেন, আমার মনে হল তার প্রসাবে ইনফেকশন, আমি প্রসাবের পরীক্ষা দিলাম। কিডনীর টেস্ট আগে করা ছিল, নরমাল ছিল তাই আর করালাম না। রোগী বাসায় গেলো। ২ দিন পর রোগী হাস্পাতালে ভর্তি  হল। রোগীর তেমন কোন উন্নতি নেই।

C/S দেখার পর এ্যান্টিবায়োটিক পরিবর্তন করব। ভাবলাম, কিডনী কেমন আছে দেখি। আগের রিপোর্টটা খুজে পেলাম না। তাই কিডনীর পরীক্ষাটা করতে দিলাম। রিপোর্ট আসার পর আমার কোনভাবেই সঠিক মনে হয় নাই। কারণ  S. creatinine 12 mg/dl ছিল। ল্যাবে বললাম, রিপিট করো। রিপোর্ট একই আসল।

S. electrolyes করে দেখলাম, hyperkalaemia আছে।

রোগীর গতকাল ডায়ালাইসিস করা হয়েছে। তাহলে এসব টেস্ট কি অকারণে করা হয়েছিল???

শিক্ষনীয় হচ্ছে- ডায়াবেটিস/হাইপ্রেসারের রোগীর মাঝে মাঝে (অন্তত ৬ মাসে ১ বার) এবং যে কোন acute illness এ ভাইটাল অরগানগুলো চেক করা উচিত।

এই রোগীকে প্রথমেই কিডনীর পরীক্ষা দিলে, রোগী বলত- সামান্য জর নিয়ে এলাম আর ডাক্তার এতগুলো পরীক্ষা অকারণে  দিলো। আর রোগী যখন খারাপ হয়ে গেল, তখন রোগির লোকের ভাষ্য- আপনি আগে কেন কিডনী টেস্ট করালেন না।

এবার আসি পরীক্ষা-নিরীক্ষায়।

আমরা সাধারনত কয়েকটি পরীক্ষাকে রুটিন বলে থাকি। এগুলো হল- CBC, RBS, S. creatinine, Urine R/E, ECG (after 40 years).

CBC করে আমরা অনেকগুলো তথ্য পাই, যেমন- শরীরে রক্তের পরিমান কেমন, শরীরে কোন ইনফেকশন আছে কিনা, ব্লাড ক্যন্সার আছে কিনা এবং platelet count কেমন, যা কমে গেলে শরীর থেকে রক্তক্ষরণ হতে পারে। যে কোন রোগির এই টেস্ট না করে তার শরীরে সার্বিক  অবস্থা বুঝা সম্ভব না।

RBS এই পরীক্ষা দিয়ে কারো ডায়াবেটিস আছে কিনা তা স্ক্রেনিং করি। ১৮ বছর পর এই পরীক্ষা বছরে অন্তত একবার করা উচিত। তবে যাদের বাবা-মায়ের ডায়াবেটিস আছে আর যাদের ওজন বেশি তাদের বছরে অন্তত ২ বার (৬ মাস পর পর) করা উচিত। কারো যদি ডায়াবেটিস untreated or uncontrolled থাকে তবে তার কিডনী নষ্ট হয়ে যেতে পারে, হার্ট এ্যাটাক, ষ্ট্রোক, অন্ধত্ব সহ আরো অনেক জটিল রোগ হতে পারে।

S. creatinine এই টেস্ট দিয়ে আমাদের কিডনী ঠিক আছে কিনা দেখা হয়। কিডনী রোগ যত তাড়াতারি ধরা পরবে, তত ভালো হবার সম্ভবনা বেশি। যাদের ডায়াবেটিস/হাইপ্রেসার আছে তাদের কিডনী নষ্ট হবার সম্ভবনা অনেক বেশি। তাছাড়া যে কোন ধরনের NSAID, কিছু প্রেসারের ঔষধ, কিছু ডায়াবেটিসের ঔষধ, বাত রোগের ঔষধ, ক্যান্সারের ঔষধ দেয়া না দেয়া, কি ডোজে দিতে হবে তা নির্ভর করে S. creatinine এর উপর। বছরে অন্তত একবার S. creatinine করা উচিত।

Urine R/E এটি খুবই সাধারণ একটি পরীক্ষা। কিন্তু খুবই ইনফরমেটিভ, এটি দিয়ে প্রস্রাবে  ইনফেকশন আছে কিনা, কিডনীতে কোন সমস্যা আছে কি না, কিডনীতে কোন পাথর আছে কিনা, ডায়াবেটিস আছে কিনা ইত্যাদি জানা যায়। এছাড়াও কারো কিডনীতে সমস্যা কেবল শুরু হয়েছে কিনা (যা চিকিৎসায় ভালো করা সম্ভব) তাও বোঝা যায় (প্রস্রাব দিয়ে যদি protein যায় তবে বুঝতে হবে কিডনীতে সমস্যা শুরু হয়েছে)।

ECG গত সপ্তাহে একজন ডায়াবেটিস রোগী দেখেছিলাম, যিনি ঔষধ খাওয়া বন্ধ করে দিয়েছিলেন। ভেবেছিলেন, ঔষধ খাবার আর দরকার নেই। তার ডায়াবেটিসের পরীক্ষা, কিডনীর পরীক্ষা আর ECG করতে দিলাম। ECG তে Recent anterior MI আসল, ইকো করার পর Ischaemic cardiomyopathy আসল। ডায়াবেটিস ও হাইপ্রেসারের রোগীর বছরে অন্তত একবার ECG করা উচিত। কারণ Heart attack বয়স্ক এবং ডায়াবেটিসের রোগীর বুকে কোন ব্যথা ছাড়াই হতে পারে।

আমার নন-মেডিকেল বন্ধুদের বলছি, কেউ যদি এসব টেস্ট (CBC, RBS, S. creatinine, Urine R/E, ECG) করেন, তাহলে ভাববেন না আর জীবনেও এসব করা লাগবে না। আপনি যদি আজ সব টেস্ট করেন আর কালকেই যদি আপনার বুকে ব্যাথা হয় তবে আবারো ECG করতে হবে। দয়া করে ভুল বুঝবেন না। ডাক্তার যে টেস্ট করতে দেন- তা আপনার জন্যই, আপনার চিকিৎসার জন্যই।


 সূত্র : ডক্টর টিভি

 

এমএস

×