ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

চা নারী শ্রমিকদের বদলে যাওয়ার লড়াই

রাজু মোস্তাফিজ

প্রকাশিত: ০১:২২, ৬ সেপ্টেম্বর ২০২২

চা নারী শ্রমিকদের বদলে যাওয়ার লড়াই

চা নারী শ্রমিকদের বদলে যাওয়ার লড়াই

বাংলাদেশে চা বাগান প্রতিষ্ঠা পায় অষ্টাদশ শতকেব্রিটিশ ভারতবর্ষের ব্রহ্মপুত্র অববাহিকায় ইংরেজ শাসকরা চা চাষের পরিকল্পনা করেঅসমে চায়ের একটি পাতা আবিষ্কার করার পর দার্জিলিং, অসম, সিলেট ও চট্টগ্রাম অঞ্চলে চা বাগান প্রতিষ্ঠা করে১৮৫৪ সালে সিলেটের মালনিছড়ায় বাণিজ্যিক চা বাগান প্রতিষ্ঠা করা হয়তিন বছর পর সেই চা বাগান থেকে বাণিজ্যিকভাবে চা উপাদন শুরু হয়চা বাগানে প্রথমে  যে নারী শ্রমিকরা কাজ করতেন তারা সিলেটের স্থানীয় ছিল না

এসব নারী শ্রমিকদের ভারতের বিহার উড়িষ্যা, মাদ্রাজ নাগপুর, সাঁওতাল পরগনা মধ্য ও উত্তর প্রদেশ থেকে নিয়ে আসা হতোতাদের বেশিরভাগ ছিল গরির, দুর্বল ও নিম্নবর্ণের হিন্দু সম্প্রদায়েরদালালরা তাদের ভাল চাকরি ও উন্নত জীবনের লোভ দেখিয়ে নিয়ে আসলেও পরবর্তীতে তা পূরণ করত নাবাগান মালিকরা এই নারী শ্রমিকদের নিজেদের সম্পত্তি বলে মনে করতমালিকরাই তাদের স্বাধীনতা নির্ধারণ করে বিভিন্ন বাগানে আনা-নেয়া করত

এখানে এসে তারা সারা জীবনের জন্য বন্দী হয়ে পড়তেনব্রিটিশরা শুরুর দিকে এভাবে আনলেও পরে আর তাদের আনতে হয়নিসন্তানরাও বংশ পরস্পরায় এভাবেই কর্মী হিসেবে চা বাগানে আজও কাজ করে যাচ্ছেদেড়শবছর পরেও তারা বাংলাদেশের মুসলমানদের সঙ্গে মিশে যেতে পারেনিশিক্ষা, চাকরি সুযোগের অভাবে তারা চা বাগানের মধ্যেই আটকে রয়েছেস্বাধীন দেশে এ যেন এক বন্দী দশাচা বাগনে সবচেয়ে নারী শ্রমিকরাই  বেশি পরিশ্রম করেসকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত এক অবর্ণনীয় কষ্টে চলে তাদের কাজকিন্তু দিন শেষে এই নারী শ্রমিকদের মজুরি মাত্র ১২০টাকা

চা বোর্ডের তথ্য অনুযায়ী ১৬৭টি চা বাগানে ৫ লক্ষাধিক চা শ্রমিকের স্থায়ী শ্রমিক প্রায় ১ লাখএকজন শ্রমিকের  মজুরির ওপর কমপক্ষে ৫/৬ জনের ভরণ পোষণ নির্ভর করেএত অল্প মজুরিতে চরম কষ্টে দিনাতিপাত করে আসছে

তার পরও থেমে থাকেনি তারা, তাদের হাড় ভাঙ্গা পরিশ্রমে বাংলাদেশ চা উপাদনে বিশে^ নবম স্থানে উঠে এসেছেএমন কি করোনাকালীন সময়ে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে চা উপাদনে সক্রিয় ছিল এই নারী শ্রমিকরা২০২১ সালে ৯৬ দশমিক ৫০৬ মিলিয়ন কেজি চা উপাদন  করে নতুন রেকর্ড সৃষ্টি করে

বাংলাদেশে সিলেট হবিগঞ্জ, মৌলভীবাজার ও চট্টগ্রাম জেলার ১৬৭টি নিবন্ধিত চা বাগানে সোয়া লাখের বেশি শ্রমিক কাজ করেএদের অধিকাংশই নারীএ সব নারী শ্রমিক ১৯ কেজি চা পাতা তুললে ১২০ টাকা মজুরি পেতএর বেশি হলে কেজি প্রতি ২ টাকা ৫০ পেতযা দিয়ে তাদের সংসার চালানো খুব কঠিন হয়ে পড়ততবে বর্তমানে পাবে ১৭০ টাকা আর এর বেশি প্রতি কেজিতে ৪ টাকা করে পাবে

যা দিয়ে সংসারে কিছুটা সচ্ছলতা নেমে এসেছেহবিগঞ্জ জেলার চুনারুঘাট উপজেলার দেওরগাছ ইউনিয়নের চান্দপুর চা বাগানের নারী শ্রমিক নির্মলা বাদ্য (৩৩), মিঠু মন্ডা জানান সারাদিন কাজ করে যে টাকা আয় হয় তা দিয়ে আমরা দুই বেলা পেট পুরে খেতেও পারি নাশুধু কোন রকমে জীবনটাকে বাঁচিয়ে রেখেছিএকই বাগানের রত্না (২৮), সকরা তাঁতি জানান আমরাও আমাদের সন্তানদের উচ্চ শিক্ষায় শিক্ষিত করতে চাই

সরকারের কাছে দাবি জানান সরকার যেন তাদের সন্তানদের শিক্ষার পাশাপাশি চাকরির ব্যবস্থা করেনসবিতা কর্মকার (৩২), কল্পনা ভৌমিক (৩৫), জানান আমরা চা শ্রমিকরা বাধ্য হয়ে ধর্মঘটে গিয়েছিআমাদের কষ্টের কথা মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা শুনেছেনএবং আমাদের মজুরি ১৭০ টাকা করেছেনতার কারণে এখন একটু ভালভাবে খেতে পারব দুই বেলাএ জন্য প্রধানমন্ত্রীকে ধন্যবাদ ও জানিয়েছেন এই চা শ্রমিকরা

মৌলভীবাজারের গ্যাসনগর ইউনিয়নের প্রেমনগর ও দেবরাছড়া চা বাগানের নারী চা শ্রমিক মালতি বাউরি, অমলা মুন্ডি, অন্ন গুনজা, সুরঞ্জনা কুমি জানান আমরা বংশপরম্পরায় চা বাগানে কাজ করে আসছিকিন্তু এত অল্প মজুরিতে ভাগ্যের উন্নয়ন হয়নি

এবার আমাদের দিকে প্রধানমন্ত্রীর নজর পড়ায় কিছুটা মজুরি বেড়েছেকৃতজ্ঞ আমরা তার কাছেঅনিকা গোয়ালা, অঞ্জীলি কৃষ্ণা, অমিতা রায় ঘাঘাটিয়া জানান আমরা আর চা বাগানের বন্দী জীবন চাই নামুক্ত জীবন চাইআমাদের সন্তানদের উচ্চ শিক্ষায় শিক্ষিত করতে চাইআমরাও সবার সঙ্গে মিলে মিশে থাকতে চাইচা শ্রমিক নেতা মৌলভীবাজারের আহ্বায়ক রাজদের কৈরী জানান শ্রমিকদের মজুরি বাড়ানো আর তাদের জীবনমান বাড়ানো এখন সময়ের দাবি

তিনি বলেন, শ্রম আইনের বৈষম্য নিরসন করে গণতান্ত্রিক শ্রম আইন প্রণয়ন এবং শ্রম আইন মোতাবেক নিয়োগপত্র, পরিচয়পত্র সার্ভিসবুক প্রদান এবং ৯০দিন কাজ করলেই সব শ্রমিককে স্থায়ী করার বিধান করার দাবি জানানবাংলাদেশ চা শ্রমিকের নেতা রায় ভজন কৈরী জানান এখনকার যে মজুরি তা দিয়ে চা শ্রমিকদের সব মৌলিক চাহিদা পূরণ হয় নাচা সংসদের চেয়ারম্যান শাহ আলম জানান শ্রমিকদের সঙ্গে দুই পক্ষের আলোচনার মাধ্যমে প্রধানমন্ত্রীর ঐকান্তিক ইচ্ছায় তাদের মজুরি বাড়ানো হয়েছে

এ ছাড়াও তারা প্রতিমাসে রেশন পায়, বিনা মূল্যে চিকিসা সেবা পায়তবে শ্রমিক নেতারা আরও জানান ২০২০ সালে চা শ্রমিক ইউনিয়ন ও বাগান মালিকদের মজুরি চুক্তি ৩০০ টাকা করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল তা বাস্তবায়িত করেনি মালিক পক্ষতবে এবার প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপেই মজুরি কিছুটা বাড়লেও প্রয়োজনের তুলনায় অনেক কম।       

সময় বদলে গেছে, সব কিছুতেই উন্নতির ছোঁয়া লেগেছেনারী চা শ্রমিকরাও  আর বৈষ্যম্যের স্বীকার হতে চান নাতাদের হাড়ভাঙ্গা পরিশ্রমে সারা পৃথিবীতে চায়ের বাজার দখল করে নিয়েছে আমাদের দেশ।  দেড়শ বছর পরেও তারা বাংলাদেশের মূল সমাজের মাঝে যেন মিশে যেতে পারেআর যেন এক ঘরের মতো থাকতে না হয়শিক্ষা চাকরি যেন পায় প্রতিটি চা শ্রমিকের সন্তানরাচা বাগানের চারপাশেই আটকে না থাকে তাদের জীবন

×