ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ২৩ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১

সেগুফতার নির্ভীকতায় পিতৃহত্যার বিচার

নাজনীন বেগম

প্রকাশিত: ০১:০০, ২ আগস্ট ২০২২

সেগুফতার নির্ভীকতায় পিতৃহত্যার বিচার

অপরাধের বিরুদ্ধে এক লড়াকু কন্যার

২০০৬ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে ঘটে যায় এক নৃশংস হত্যাকাণ্ডঅধ্যাপক ড. তাহেরের মর্মস্পর্শী মৃত্যু ঘণ্টা বেজে ওঠে কতিপয় দুর্বৃত্তের হাতেকন্যা সেগুফতা তাবাসসুম আহমেদ এখন ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়েও আইন বিভাগের তৃতীয় বর্ষের ছাত্রীপিতা অধ্যাপক ড. তাহের স্যারই ভর্তি করান কন্যাকে আইন বিভাগে অধ্যয়ন করতেআমি নিজেও তখন রাজশাহীতে

স্বচক্ষে দেখতে হয়েছে এমন হৃদয়বিদারক অমানবিক দুর্বৃত্তায়নকেপ্রথম থেকেই চিহ্নিত হয়েছে ঘাতক মিয়া মহিউদ্দিন এবং তার সহযোগীরাতিনি নিজেও একই বিভাগের শিক্ষকজানা যায় মহিউদ্দিন মরহুম তাহের স্যারের সরাসরি ছাত্রও ছিলেনস্যারকে হত্যা করা হয় ২০০৬ সালের ১ ফেব্রুয়ারিতার লাশ উদ্ধার করা হয় তিন ফেব্রুয়ারিসে সময় ভাবি সুলতানা আহমেদ বাসায় ছিলেন নাস্যারকে কয়েকবার ফোন করার পরও তার কোন হদিস পাওয়া যাচ্ছিল নাপরবর্তীতে অনেক খুঁজাখুঁজির পর ৩ ফেব্রুয়ারি বিশ্ববিদ্যালয়ের বাসার বাইরে ম্যান হোলে তাহের স্যারের লাশ উদ্ধার করা হয়সন্দেহভাজন তালিকায় প্রথমেই উঠে আসে এক সময়ের ছাত্র ও পরবর্তীতে সহকর্মী মিয়া মোহাম্মদ মহিউদ্দিনের নাম

কতিপয় শিবির কর্মী ও বাসার তত্ত্বাবধায়কের নামও পুলিশি খাতায় লিপিবদ্ধ থাকেলাশ উদ্ধারের পর পুত্র সন্তান সানজিদ আলভী মতিহার থানায় মামলা করেন২০০৬ থেকে ২০২২- সময়ের স্রোতে চলে যাওয়া ১৬টি বছরআর কন্যা তাবাসসুম তখন আইন শাস্ত্রে পড়াশোনায় সমর্পিতইচ্ছে ছিল পিতার মতো শিক্ষক হবেনপিতারও তেমনই ইচ্ছে ছিলবাবার এমন মর্মান্তিক মৃত্যুতে শোকাহত অসহায় কন্যা নিজের জীবনের লক্ষ্যটাই পাল্টে দিলেন

আইনজ্ঞ হওয়ার স্বপ্ন নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ সম্পন্ন করাও লড়াকু কন্যার অনমনীয় সঙ্কল্পতারপর আর পেছন ফিরে তাকাতে হয়নিএখানে একটা কথা উল্লেখ না করলেই নয়- ঠাণ্ডা মাথার ঘাতক মিয়া মহিউদ্দিনের অনেক বন্ধু আর সুহৃদ অভিমত দিয়েছিলেন- তিনি নাকি এমন হত্যাকা- ঘটাতেই পারেন নাকিন্তু সময় সব কিছু প্রমাণও করে দিল

অভিনন্দন ও শুভকামনা হার না মানা তাবাসসুমকেকি দৃঢ় মনোশক্তি আর আইনী বিধি বিধানে নিমগ্ন থেকে পিতৃহত্যার চুলচেড়া বিচার কার্যক্রমে সহযোগী শক্তির ভূমিকায় নিজেকে অনবদ্য করে তোলাপিতৃশোক ভোলার মতো নয়আর তা যদি অস্বাভাবিক এবং অসময়ে চলে যাওয়ার মতো যন্ত্রণা হয়

দুঃসাহসিক এক লড়াকু কন্যার জঘন্য অপরাধের বিরুদ্ধে আইনী কার্যক্রমে শামিল হওয়া সত্যিই এক অসাধ্য সাধনপিতৃহত্যাকারীদের মৃত্যু দ-াদেশ থেকে রেহাই পাওয়ার বিন্দুমাত্র সুযোগ এখানে নেইএকমাত্র রাষ্ট্রপতির ক্ষমা ভিক্ষা করা ছাড়াসেটাও মনে হয় আর কোনভাবেই সম্ভব নয়গত ৫ এপ্রিল আপীল বিভাগের রায়ে খুনিদের বিচারিক কার্যক্রম চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছালে পরিবার হয়তো স্যারকে আর কখনও ফিরে পাবেন নাতবে ক্ষমার অযোগ্য অপরাধীরা শাস্তির কাঠগড়ার দাঁড়িয়ে মৃত্যুর পরোয়ানা পাওয়া সেটাও তো অনেক বড় বিজয়

তবে ১৬ বছর অনেক দীর্ঘ সময়প্রতিটা মুহূর্ত কেটেছে কষ্টে, দুঃখে, বেদনায় জর্জরিত হয়েসেটাও কি কম দুর্ভাগ্যের বিষয়তবে নিরবচ্ছিন্ন পিতৃ হত্যার বিচারিক কার্যক্রমকে যেভাবে সেগুফতা তার অর্জিত জ্ঞানই শুধু নয় পিতার প্রতি অবিচলিত দায়বদ্ধতায় কঠোর পদক্ষেপে এগিয়ে নিয়েছেন তাকেও মাথা নত করে সম্মান জানানোর বিষয়টি কেউ যেন অনাদরে, অবহেরায় নষ্ট না করেনারীরা আজ দুর্জয় সাহসে অনেক বাধা বিঘ্ন অতিক্রম করে বিজয় মালা ছিনিয়ে আনছে

বিচারিক বিধি ব্যবস্থাতেও নারীদের জোরালো অংশগ্রহণ সময়ের অপরিহার্য দাবিশুধু একা সেগুফতা নয়, আরও অনেক নারী এমন উজ্জ্বল নজির অনুসরণ করবে যে কোন অন্যায়, অপরাধের বিপরীতেস্ত্রী সুলতানা আহমেদ দুঃখ ভারাক্রান্ত হৃদয়ে দীর্ঘদিন অপেক্ষা করেছিলেন স্বামী হত্যার যেন আইনসম্মত বিচারকাজ সম্পন্ন হতে সব বাধাবিঘ্নকে অতিক্রম করা যায়সবশেষে সেটাই হয়েছেশুধু স্ত্রী, কন্যা, পুত্র নয় পুরো পরিবার, বিশ্ববিদ্যালয় চত্বর এমনকি সারাদেশ এমন জঘন্য হত্যার বিচারে মৃত্যুদ-াদেশে সর্বশেষ রায় ঘোষিত হওয়ায় শান্তি এবং তৃপ্তি পেয়েছে

×