ঢাকা, বাংলাদেশ   সোমবার ২১ জুলাই ২০২৫, ৫ শ্রাবণ ১৪৩২

দ্রুজ গোষ্ঠী কারা? কেন তাদের পাশে দাঁড়াচ্ছে ইসরায়েল?

প্রকাশিত: ২১:২১, ২০ জুলাই ২০২৫

দ্রুজ গোষ্ঠী কারা? কেন তাদের পাশে দাঁড়াচ্ছে ইসরায়েল?

ছবি: সংগৃহীত

সিরিয়ার সার্বভৌমত্বে আঘাত করে দেশটির প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ে হামলা চালিয়েছে ইসরাইল। এ হামলার কারণ হিসেবে ইসরাইল দ্রুজ সম্প্রদায়কে রক্ষা করার কথা জানিয়েছে।

কিন্তু প্রশ্ন উঠছে—কারা এই দ্রুজ সম্প্রদায়? কী তাদের ইতিহাস? কেনই বা ইসরাইল তাদের প্রতি দায়বদ্ধতা অনুভব করে মধ্যপ্রাচ্যকে নতুন আরেকটি যুদ্ধের দিকে ঠেলে দিতে চাইছে?

সিরিয়ার সাবেক প্রেসিডেন্ট বাশার আল-আসাদকে ক্ষমতাচ্যুত করার পর দেশটির দায়িত্বভার গ্রহণ করে আসাদবিরোধী বিপ্লবী গোষ্ঠী হায়াত তাহরীর আল-শাম। এরপর দেশটির অস্থায়ী প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব নেন আহমেদ আল সারা। ইসলামপন্থী বিদ্রোহী গোষ্ঠীর নেতা হলেও, ক্ষমতা গ্রহণের পর সারা আবির্ভূত হন কিছুটা উদারপন্থী হিসেবে—যিনি পশ্চিমা দেশগুলোর সঙ্গেই নয়, এমনকি ইসরাইলের সাথেও ঐতিহাসিক দ্বন্দ্ব মিটিয়ে ফেলতে আগ্রহী।

দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকে ইসরায়েলের জন্য হুমকি তৈরি করতে পারে এমন কোনো কাজও তিনি করেননি। তবু ইসরায়েল তার পুরনো আগ্রাসী ধারাবাহিকতা বজায় রেখে সম্প্রতি সিরিয়ার রাজধানী দামেস্কে, দেশটির প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের মতো গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনায় হামলা চালিয়েছে। এই হামলার পেছনে ইসরায়েল দ্রুজ নামের একটি সম্প্রদায়কে রক্ষা করার কারণ দেখিয়েছে।

সিরিয়ার দক্ষিণাঞ্চলের সুয়াইদা প্রদেশ দ্রুজ সম্প্রদায়ের ঘাঁটি হিসেবে পরিচিত। ১৬ জুলাই, বুধবার, সিএনএন জানিয়েছে—গত সপ্তাহে সুয়াইদা শহরে দ্রুজ বাহিনী ও বেদুইন উপজাতিদের মধ্যে ভয়াবহ সংঘর্ষ হয়। এতে অন্তত ৩০ জন নিহত ও বহু মানুষ আহত হন। পরিস্থিতি সামাল দিতে সিরিয়ার সরকার সেনা পাঠালে আবারও সহিংসতা ছড়িয়ে পড়ে এবং ১৮ জন সরকারি সৈন্য প্রাণ হারান। এরপরই সিরিয়ায় হামলা চালায় ইসরায়েল।

এমন অবস্থায় স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন জাগে—দ্রুজ কারা? কী তাদের ইতিহাস? কেনই বা তাদের রক্ষায় ইসরায়েল এতটা তৎপর?

দ্রুজরা একটি আরব ধর্মীয় গোষ্ঠী। বিশ্বজুড়ে তাদের মোট সংখ্যা প্রায় ১০ লাখ। এই সম্প্রদায়ের মানুষ মূলত সিরিয়া, লেবানন ও ইসরায়েলের পাহাড়ি এলাকায় বসবাস করেন। গবেষণায় দেখা গেছে, দ্রুজদের পূর্বপুরুষেরা মূলত উত্তর-পূর্ব তুরস্ক, দক্ষিণ-পশ্চিম আর্মেনিয়া ও উত্তর ইরাক সীমান্ত অঞ্চলের অধিবাসী ছিলেন।

দ্রুজ ধর্ম ৯৮৬ খ্রিস্টাব্দে ইসলামী ধারার একটি আন্দোলন হিসেবে মিশরে শুরু হয়েছিল। এর প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে আদ-দারাজি ও হামজা বিন আলী-কে বিবেচনা করা হয়। আল হাকিম বি আমর আল্লাহ নামে এক শাসক এই ধর্ম গ্রহণ করেন। তবে তাঁর মৃত্যু বা অন্তর্ধানের পর মিশরে এই ধর্ম নিষিদ্ধ হয়ে যায়। কিন্তু ততদিনে ধর্মটি লেবানন অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়ে।

দ্বাদশ শতকে ইহুদি পর্যটক বেনজামিন অব তুদেলা দ্রুজদের পাহাড়বাসী সাহসী যোদ্ধা হিসেবে বর্ণনা করেন, যারা ইহুদিদের প্রতি সহানুভূতিশীল ছিলেন। নানা নির্যাতনের কারণে এই সম্প্রদায় বাইরের ধর্মাবলম্বীদের সঙ্গে বিয়ে নিষিদ্ধ করে এবং নতুন কাউকে ধর্মে গ্রহণ করাও বন্ধ করে দেয়।

১৯৬৭ সালের ছয় দিনের যুদ্ধে ইসরায়েল সিরিয়ার গোলান মালভূমি দখল করে নেয়। এখন সেখানে প্রায় ২০ হাজার দ্রুজ ধর্মাবলম্বী বাস করেন, যাদের অধিকাংশই নিজেদের সিরিয়ান পরিচয়েই গর্ববোধ করেন এবং ইসরায়েলি নাগরিকত্ব প্রত্যাখ্যান করেন।

বর্তমানে ইসরায়েলে প্রায় ১.৩ লাখ দ্রুজ নাগরিক বসবাস করেন। এদের অনেকে ১৯৫৭ সাল থেকে ইসরায়েলি সেনাবাহিনীতে বাধ্যতামূলকভাবে নিয়োজিত। ইসরায়েল এই সম্প্রদায়ের সাথে ঐতিহাসিক ও ভ্রাতৃত্বপূর্ণ সম্পর্কের কথা উল্লেখ করে থাকে।

অন্যদিকে, সিরিয়ার দক্ষিণাঞ্চল সুয়াইদা প্রদেশে দ্রুজরা সংখ্যাগরিষ্ঠ, যারা স্বায়ত্তশাসন ও নিজেদের মিলিশিয়ার মাধ্যমে নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে চায়। তবে প্রেসিডেন্ট আহমেদ আল সারা তাদেরকে অস্ত্রসমর্পণ করে সরকারের অধীনে একীভূত হওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন, যা দ্রুজরা প্রত্যাখ্যান করেছে। তারা রাজনৈতিক প্রতিনিধিত্বে বৈষম্যের অভিযোগও তুলেছে।

সবশেষে ইসরায়েল ঘোষণা করেছে—তারা সিরিয়ার দক্ষিণাঞ্চলে একটি নিরস্ত্রীকরণ এলাকা স্থাপন করেছে। তবে সিরিয়া এই ঘোষণাকে সম্পূর্ণভাবে প্রত্যাখ্যান করেছে।

সুতরাং প্রশ্ন থেকেই যায়—
ইসরায়েল কি সত্যিই দ্রুজদের রক্ষা করছে, নাকি এই সুরক্ষার নামে আবারও একটি ভঙ্গুর অঞ্চলে বিভক্তি ও সংঘাতের বীজ বপন করছে?

 

শেখ ফরিদ 

×