
বুকে ব্যথা শুনলেই অনেকে হৃদরোগ বা হার্ট অ্যাটাকের ভয় পান। যদিও এটি একটি গুরুতর উপসর্গ হতে পারে, তবে সব বুকে ব্যথাই হৃদ্যন্ত্রের কারণে হয় না। বুকের অস্বস্তি অনেক সময় ফুসফুস, হজমতন্ত্র, হাড়-জোড়ার সমস্যা বা মানসিক উদ্বেগ থেকেও হতে পারে। এ প্রতিবেদনটিতে তুলে ধরা হলো বুকের ব্যথার সম্ভাব্য কারণ ও কোন উপসর্গগুলোতে সতর্ক হওয়া জরুরি।
হৃদ্যন্ত্র ও রক্তনালিজনিত বুকে ব্যথার কারণ
বুকে ব্যথার সবচেয়ে ভয়ানক কারণগুলোর একটি হলো হৃদ্যন্ত্র বা এর প্রধান রক্তনালির সমস্যা। এসব অবস্থায় দ্রুত চিকিৎসা না নিলে জীবনহানির ঝুঁকি থাকে।
হার্ট অ্যাটাক:
করোনারি ধমনীতে রক্তপ্রবাহ বন্ধ হয়ে হৃদ্পেশিতে রক্ত না পৌঁছালে হার্ট অ্যাটাক হয়। এতে বুকের মাঝখানে বা বাম পাশে ভারী চাপ বা অস্পষ্ট ব্যথা অনুভব হতে পারে, যা গলা, চোয়াল বা হাতে ছড়িয়ে পড়ে। সঙ্গে থাকতে পারে শ্বাসকষ্ট, বমিভাব, অস্বাভাবিক হৃৎস্পন্দন ও ক্লান্তি।
নীরব হার্ট অ্যাটাক:
সব হার্ট অ্যাটাকে বুকে ব্যথা হয় না। অনেকেই উপসর্গ না বুঝেই হার্ট অ্যাটাক পার করে যান, যাকে বলে নীরব হার্ট অ্যাটাক। গবেষণায় দেখা গেছে, প্রতি পাঁচটি হার্ট অ্যাটাকের একটিই নীরব।
ক্রনিক অ্যাঞ্জাইনা:
যারা ধীরে ধীরে করোনারি আর্টারি ডিজিজে আক্রান্ত হন, তাদের চলাফেরার সময় বুকের ভারী চাপ অনুভূত হয়, যাকে বলা হয় অ্যাঞ্জাইনা। বিশ্রামে তা কমে যায়। তবে নতুন বা বাড়তে থাকা অ্যাঞ্জাইনা হলে দ্রুত পরীক্ষা করানো জরুরি।
পেরিকার্ডাইটিস:
হৃদ্যন্ত্রের চারপাশের আবরণীর প্রদাহকে বলে পেরিকার্ডাইটিস। এতে তীব্র ব্যথা হয়, যা শ্বাস নিতে বা শুয়ে পড়লে বাড়ে। যদি এ প্রদাহের কারণে হৃদ্যন্ত্রের চারপাশে তরল জমে যায় (কার্ডিয়াক ট্যাম্পোনেড), তবে তা জীবনহানিকর হতে পারে। এ অবস্থায় দেখা দিতে পারে রক্তচাপ কমে যাওয়া, মাথা ঘোরা, ত্বক ফ্যাকাশে হওয়া এবং শ্বাসকষ্ট।
এওর্টিক স্টেনোসিস ও হাইপারট্রফিক কার্ডিওমায়োপ্যাথি:
হৃদ্যন্ত্রের ভালভ সংকুচিত হলে বা পেশি অস্বাভাবিকভাবে মোটা হয়ে গেলে বুকব্যথা, দুর্বলতা, মাথা ঘোরা বা অজ্ঞান হয়ে যাওয়ার মতো উপসর্গ দেখা দিতে পারে।
এওর্টিক ডিসেকশন:
এটি একটি মারাত্মক অবস্থা, যেখানে হৃদ্যন্ত্র থেকে শরীরে রক্ত সরবরাহকারী প্রধান ধমনী এওর্টার দেয়ালে ফাটল ধরে। এতে হঠাৎ তীব্র ও ছড়ানো ব্যথা হয়, যা পিঠে ছড়ায়। অন্যান্য উপসর্গের মধ্যে থাকতে পারে অজ্ঞান হওয়া, তীব্র দুর্বলতা, দ্রুত হৃদস্পন্দন ও ঠাণ্ডা ঘাম।
পালমোনারি এম্বোলিজম (PE):
ফুসফুসের ধমনীতে রক্ত জমাট বাঁধলে PE হয়। এতে বুকের যেকোনো স্থানে ব্যথা হতে পারে, বিশেষ করে শ্বাস নেওয়ার সময়। সঙ্গে থাকতে পারে শ্বাসকষ্ট, খুসখুসে কাশি, অক্সিজেন কমে যাওয়া এবং হৃৎস্পন্দন বেড়ে যাওয়া।
হৃদ্যন্ত্র-সম্পর্কিত নয়, এমন বুকব্যথার কারণ
ফুসফুসজনিত সমস্যা:
নিউমোথোরাক্স বা ফুসফুসে বাতাস জমে গেলে হঠাৎ তীব্র ব্যথা হয়। এটি প্রাণঘাতী হতে পারে। অ্যাজমা, সিওপিডি বা সিস্টিক ফাইব্রোসিসে আক্রান্তরা এতে বেশি ঝুঁকিতে থাকেন।
ফুসফুসের সংক্রমণ:
ব্রঙ্কাইটিস বা নিউমোনিয়ার মতো সংক্রমণে বুকব্যথা হতে পারে। সঙ্গে কাশি, জ্বর, কাঁপুনি দেখা দিতে পারে। ভাইরাসজনিত ইনফেকশন থেকেও পেরিকার্ডাইটিস হতে পারে।
ফুসফুসে টিউমার বা ক্যানসার:
ধীরে ধীরে শুরু হওয়া ব্যথা, দীর্ঘস্থায়ী কাশি, রক্ত ওঠা, ওজন কমে যাওয়া ও ক্লান্তি থাকলে ফুসফুসে টিউমার হতে পারে।
অন্ত্রজ উপসর্গ (জিআই ট্র্যাক্ট):
অ্যাসিড রিফ্লাক্স ও গ্যাস্ট্রোইসোফেজিয়াল রিফ্লাক্স ডিজিজ (GERD) বুকের মাঝখানে জ্বালাভাব সৃষ্টি করে। খাওয়ার পর বা ঝাল-অম্লজাতীয় খাবারে তা বেড়ে যায়। সঙ্গে ঢেকুর, গলায় তেতো স্বাদ, দুর্গন্ধযুক্ত শ্বাস বা কাশি থাকতে পারে।
হাড়-স্নায়ু-সন্ধির সমস্যা:
কস্টোকনড্রাইটিসে বুকের হাড় ও তরুণাস্থির সংযোগস্থলে ব্যথা হয়, যা চাপ দিলে বাড়ে। নুতন ব্যায়াম, আঘাত বা বেশি কাশির ফলে এ ব্যথা হতে পারে। পাঁজরের হাড় ভাঙা, আঘাত বা মাংসপেশির টান থেকেও ব্যথা হতে পারে।
চর্মরোগ:
শিংগলস বা হারপেস জোস্টার ভাইরাসের কারণে এক পাশের বুকে তীব্র জ্বালাময় ব্যথা হয়। পরে ফুসকুড়ি দেখা দেয়। শুরুতে রোগটি ধরা কঠিন, তবে সময়ের সঙ্গে স্পষ্ট হয়।
মানসিক কারণ:
আতঙ্ক বা প্যানিক অ্যাটাকে হঠাৎ বুকব্যথা, দ্রুত হৃৎস্পন্দন, বমিভাব ও হাত-পায়ে ঝিঁ ঝিঁ হতে পারে। যদিও এটি প্রাণঘাতী নয়, তবে হার্ট অ্যাটাকের উপসর্গের সঙ্গে মিলে যাওয়ায় পরীক্ষা করে নিশ্চিত হওয়া জরুরি।
ব্যথার ধরন ও সময়জ্ঞানও গুরুত্বপূর্ণ
হঠাৎ শুরু হওয়া ব্যথা:
হার্ট অ্যাটাক, এওর্টিক ডিসেকশন, PE, ফুসফুসের পতন বা ইসোফ্যাগাস ফেটে যাওয়া—এসবেই হঠাৎ তীব্র ব্যথা হয়। এমন ব্যথা উপেক্ষা না করে জরুরি চিকিৎসা নিন।
অবিরত ব্যথা:
মিনিট থেকে ঘণ্টা ধরে চলা ব্যথা হার্ট অ্যাটাক, শিংগলস, ফুসফুসের টিউমার বা হাড়ের আঘাত থেকে হতে পারে।
ক্ষণস্থায়ী ব্যথা:
মাত্র কয়েক সেকেন্ড স্থায়ী ব্যথা সাধারণত গুরুতর হয় না, তবে যদি কয়েক মিনিট বা তার বেশি স্থায়ী হয়, তবে সেটি হার্ট-সম্পর্কিত হতে পারে।
আসা-যাওয়া করে এমন ব্যথা:
শারীরিক পরিশ্রমে বাড়ে এবং বিশ্রামে কমে, এমন ব্যথা অ্যাঞ্জাইনার ইঙ্গিত হতে পারে। আবার নির্দিষ্ট খাবার খাওয়ার পর ব্যথা বাড়লে তা জিএইচআরডি-সম্পর্কিত হতে পারে।
বুকের ব্যথাকে হালকাভাবে নেওয়া যাবে না
বুকব্যথা একাধিক কারণে হতে পারে এবং উপসর্গগুলো প্রায়ই একে অপরের সঙ্গে মিলে যায়। তাই কম তীব্রতা হলেও উপেক্ষা করা উচিত নয়। বিশেষ করে হার্ট অ্যাটাকের উপসর্গ দেখা দিলে দেরি না করে দ্রুত জরুরি চিকিৎসা নিতে হবে।
চিকিৎসকেরা প্রয়োজনীয় রক্ত পরীক্ষা, ইসিজি এবং বুকের ইমেজিংয়ের মাধ্যমে ব্যথার প্রকৃত কারণ নির্ণয় করে থাকেন।
বুকে ব্যথার পেছনে রয়েছে বিভিন্ন জটিল ও সাধারণ কারণ। বিশেষ করে হৃদ্যন্ত্র ও রক্তনালিজনিত সমস্যাগুলো সময়মতো চিহ্নিত না করলে বিপজ্জনক হতে পারে। তাই নতুন বা অস্বাভাবিক কোনো বুকব্যথা হলে অপেক্ষা না করে দ্রুত চিকিৎসা নেওয়াই সবচেয়ে বুদ্ধিমানের কাজ।
সূত্র:https://tinyurl.com/4j5bwecr
আফরোজা