
ছবি: জনকণ্ঠ
মানুষের মিষ্টি মুখের হাসির চেয়ে সুন্দরতর আর কিছু হতে পারে না; অভিনয়শিল্পী কবরীকে সিনেমার পর্দায় দেখলে এই ভাবনাটা আরো গভীরভাবে উপলদ্ধি হয়। তার অভিনয়ের আরো একটা বিষয় ছিল পর্দায় তাকে দেখলেই মনে হতো পাশের বাড়ির কোন মেয়ে যেন হেসে হেসে কথা বলছে।
গান হয়ে এলে মন যেনো বলে সারাবেলা এতো সুখ নিয়ে নিজেরে কি করে বলো রাখি লুকিয়ে.. মিষ্টি মুখের আরও অধিক মিষ্টি হাসিতে সুরে সুরে গান গেয়ে প্রেমে পড়ার আকুতির কথা কি মনে পড়ছে... কারো..? ঢাকাই বাংলা ছবির মিষ্টি মেয়ে কবরীর কথা !
তিনি আমাদের বাংলাদেশের চলচ্চিত্রের ‘মিষ্টি মেয়ে’ হয়ে চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত পেয়েছেন সেই বিগত শতাব্দীর ৬৪ সালে, মাত্র ১৪ বছর বয়সে সুভাষ দত্ত পরিচালিত সুতরাং সিনেমার বদৌলতে।
চলচ্চিত্রে তার স্রষ্টা সুভাষ দত্ত, মিস্টার দত্ত ‘সুতরাং’ সিনেমা দিয়ে সৃষ্টি করেছিলেন কবরী নামে এক দ্যুতিময় হীরকখন্ড। সেই কবরী দীর্ঘদিন তার কথায়, কাজে, হাসিতে সৃষ্টিতে সপ্রাণ, এটা ভাবলেই বুকের ভেতর পুলক জাগে। রূপালী পর্দায় ঝলমলে হাসি ছড়িয়ে দেয়া নায়িকা-পর্দামানবী কবরীকে পুরনো সিনে সাংবাদিকরা ‘ম্যাডাম’ বলে সম্বোধন করতেন। কেনো করেন এর কারণ, ব্যাখ্যা তারাই জানেন। সেই ১৯৬৪ সাল থেকে কবরী যেভাবে বিচরণ করেছেন আমাদের সিনেমা ভুবনে তাতে করে তার নামের সঙ্গে হাজারটা অলঙ্কারবাচক শব্দ যোগ হয়ে যেতেই পারে অবলীলায়।
কেবল বাংলা নয়, বিশংশতাব্দীর চলচ্চিত্রে ঝাঁকি দেয়া নির্মাতার নাম ঋত্বিক ঘটক। সেই ঘটক মহাশয় যখন বাংলাদেশে চলচ্চিত্র করবেন, অনেক নায়িকা গিয়েছিল অভিনয়ের জন্য কিন্তু ঘটক মশাই কবরীকে সিলেক্ট করেন সেলোলুয়েডে বন্দী করতে তিতাস একটি নদীর নাম চলচ্চিত্রে।
তিতাসের নদীপাড়ের জীবন, মালোপাড়ার জীবনগাথা। অদ্বৈত মল্ল বর্মণ-এর একটিই উপন্যাস ‘তিতাস একটি নদীর নাম’কে চলচ্চিত্রে রূপ দিলেন ঋত্বিক। সে মালোপাড়ার চলচ্চিত্রে কি সাবলীল অভিনয় কবরীর।
কেউ যদি বাংলাদেশের নদী আর নারীর কিছুটা রূপ দেখে নিতে চায়, তাহলে আশ্রয় করতে পারে এই সিনেমায়। পালতোলা নৌকার এমন ব্যবহার, এমন বিশাল ক্যানভাস এই সিনেমাছাড়া আর কোথায় পাওয়া যাবে? ঋত্বিক কুমার ঘটকের ভীষণ এই সৃষ্টিতে সার্থকভাবে যুক্ত ছিলেন এবং আছেন কবরী।
ক্যারিয়ারের শুরুতেই পায়ের তলায় বেশ শক্ত মাটি পেয়ে গিয়েছিলেন ১৯৫০ সালের ১৯ জুলাই চট্টগ্রামে জন্ম নেয়া মেয়ে মীনা পাল। আর তার মাথার উপর ছিলো নীল আকাশ।
রাজ্জাকের সঙ্গে দারুণ একটা রোমান্টিক জুটি গড়ে উঠেছিলো ঢাকাই চলচ্চিত্র জগতে করবীর। ভারতের সুচিত্রা উত্তম কুমারের মতো এই রোমান্টিক জুটি অনেক দিয়েছে আমাদের চলচ্চিত্রকে। যা আজও অবলীলায় স্মরণ করে প্রতিটি দর্শক ও বোদ্ধা মহলের সিনেমা প্রেমীগণ।
ঢাকাই সিনেমার প্রথম আলোড়িত রোমান্টিক জুটি কবরী-রাজ্জাক অথবা রাজ্জাক-কবরী। তারপর ইলিয়াস কাঞ্চন, ফারুক, বুলবুল, আলমগীর অনেক নায়কের সঙ্গেই জুটি বেধে অনেক ব্যবসা সফল চলচ্চিত্র উপহার দিয়েছেন মিষ্টি মেয়ে কবরী। দর্শকের মগজে গেথে আছে রাজ্জাক-কবরীর নাম।
করবী কী কী করেন, করতে পারেন? অভিনয়? এটা মীমাংসিত বিষয়। সিনেমার পরিচালনার পরীক্ষাও তিনি দিয়েছেন একবার। রাজনীতি? সে পাঠ থেকেও দূরে নেই তিনি।
সরাসরি ভোটে জনপ্রতিনিধি নির্বাচিত হয়ে গিয়েছেন জাতীয় সংসদে। তিনি খুব গুছিয়ে, সুন্দর করে, স্পষ্ট করে কথা বলতে পারেন। সংসদ অধিবেশনে তার বক্তব্য শুনেও বুঝা গেছে তিনি সব কাজে সমান পারদর্শী। মিষ্টি মেয়ে কবরী শৈশব কৈশোরকালে হতে চেয়েছিলেন স্কুল শিক্ষক, হতে পারেন নি। তাই শিক্ষার প্রতি তার আজন্ম একটা টান মৃত্যুর পূর্বেও ছিল। সেই টান থেকেই তিনি প্রতিনিয়ত শিক্ষা নিচ্ছেন।
কবরী সময় পেলেই নিজের জীবনের ডায়েরি লিখতে পছন্দ করতেন। সেই ডায়েরির পাতা গুলো সংযোজিত করে ‘স্মৃতিটুকু থাক’ নামে প্রকাশ করেছেন নিজ জীবনকথা। সেখানে উঠে এসেছে সিনেমা আর ব্যক্তিজীবনের অনেক বাঁকের ছবি। কোভিড-১৯ রোগে আক্রান্ত হওয়ার ১৩ দিনের মাথায়, ২০২১ সালের ১৭ এপ্রিল মৃত্যুবরণ করেন ঢাকাই চলচ্চিত্রের মিষ্টি মেয়ে কবরী।
গভীর শ্রদ্ধা, নিরন্তর ভালোবাসা, জন্মদিনে। সুন্দর সাবলীল স্বাচ্ছন্দ্য ও ছবিময় জীবনের কবরী, ঢাকাই চলচ্চিত্রের মিষ্টিমেয়ে তার সৃষ্টির মাঝে বেঁচে থাকুন আজীবন।
শহীদ