জাতীয় নাট্যশালায় মঞ্চস্থ লিওনার্দো দ্য ভিঞ্চি নাটকের দৃশ্য
আগুন শীতল হলে হয় জল আর জল উত্তপ্ত হলে হয় আগুন। আগুনের তাপের উষ্ণতা কমতে কমতে এই দেহ যখন বরফ শীতল তখনই মরণ। মরণ আমার আসন্ন। এই জীবনে কোন কাজেই কোনদিন অবহেলা করিনি। হয়ত সকল কাজের গন্তব্যে পৌঁছাতে পারিনি সব সময় কিন্তু জীবনের কোন এক মুহূর্তও তো কাজ ছাড়া থাকিনি। তবে অন্তিম বেলায় ইচ্ছাপত্র, উইল পেপার রচনা বাকি রাখি কেন? লিখতে আমাকে হবেই।
আমার বিষয়ে আমি ছাড়া তো বলবার তেমন কেউ নেই। না আছে রক্তজাত উত্তরাধিকারী, না আছে পরিকল্পিত শিষ্য, না আছে আমার রচিত আমারই আত্মজীবনী গ্রন্থ। ফলে সমকালকে মহাকালের গর্ভে হারিয়ে যেতে না দিতে এই একটি ঘণ্টা সময় বড় অমূল্য।
এভাবেই নিজের জীবনের শেষ এক ঘণ্টার বয়ান দিলেন শিল্পের সা¤্রাজ্যে অমরত্ব অর্জনকারী লিওনার্দো দ্য ভিঞ্চি। মঞ্চের আলো-আঁধারির সঙ্গে সংলাপের আশ্রয়ে ঢাকার নাট্যমঞ্চে হাজির হলেন দুনিয়া আলোড়িত করা এই চিত্রকার।
তার কালজয়ী সৃষ্টিকর্ম মোনালিসা ও দ্য লাস্ট সাপার সম্পর্কিতহ বিশদ তথ্য তুলে ধরলেন দর্শকের সামনে। সংলাপে সংলাপে উচ্চারিত হলো একইসঙ্গে শিল্পীর রহস্য ও বৈচিত্র্যময় জীবন অধ্যায়। ভিঞ্চিকে নিয়ে নির্মিত নাটকটি মঞ্চে এনেছে জয়পুরহাটের নাট্যদল শান্তিনগর থিয়েটার।
বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় শিল্পকলা একাডেমির জাতীয় নাট্যশালা মিলনায়তনে নাটকটির উদ্ধোধনী মঞ্চায়ন হয়। অপূর্ব কুমার কুন্ডু রচিত লিওনার্দো দ্য ভিঞ্চি শীর্ষক প্রযোজনাটির নির্দেশনা দিয়েছেন এইচ আর অনিক।
প্রদর্শনীর পূর্বে ছিল উদ্বোধনী আনুষ্ঠানিকতা। প্রযোজনাটির উদ্বোধন ঘোষণা করেন শিল্পকলা একাডেমির মহাপরিচালক লিয়াকত আলী লাকী। উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ছিলেন সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের সভাপতি গোলাম কুদ্দুছ।
বিশেষ অতিথির বক্তব্য দেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদের ডিন নিসার হোসেন এবং আওয়ামী লীগের স্বাস্থ্য ও জনসংখ্যাবিষয়ক সম্পাদক ডাঃ রোকেয়া সুলতানা। সভাপতিত্ব করেন শান্তিনগর থিয়েটারের নির্বাহী সদস্য আবু রেজা মোঃ আমিনুর রহমান সুইট।
প্রযোজনাটি প্রসঙ্গে নাট্যকার অপূর্ব কুমার কুন্ডু বলেন, কালের ইতিহাসে আজ থেকে পাঁচশ’ বছর আগের রহস্যভরা এক চরিত্র লিওনার্দো দ্য ভিঞ্চি। মোনালিসা এবং দ্য লাস্ট সাপার ছবির সুবাদে বিশ^বাসীর কাছে কমবেশি পরিচিত তিনি। অজানা দিকটি হলো চিত্রকরের পাশাপাশি বিজ্ঞানী-প্রযুক্তিবিদ-সঙ্গীতশিল্পী-শারীরিবিদ্যা বিশারদ-সমর বিজ্ঞানী-নগর বিশারদ কিংবা জ্যোতিবিজ্ঞানীসহ আরও কত না তার পরিচয়।
তার মতো সভ্যতার তীব্র সহায়ক শক্তিকে মঞ্চনাটকের মায়ায় দেখার সাধ মেটাতে পাড়ি দিতে হয়েছে পরিশ্রমী এক পথ। তাকে পুরোপুরি জানতে অনেক বইয়ের সহায়তা নিতে হয়েছে। দিনের পর দিন, রাতের পর রাত বিষয়ের গভীরে একটু একটু করে মিশে যাওয়া, মিলিয়ে যাওয়া।
এক সময় একটু একটু করে গাঢ় কুয়াশার চাঁদর ভেদ করে সামগ্রিকতায় স্পষ্ট হলেন লিওনার্দো দ্য ভিঞ্চি। পা-ুলিপির পাতায় পাতায়, আলো-আঁধারির রহস্যময়তায় আর ব্যক্ত-অব্যক্ত কথার মায়ায় জীবন্ত হয়ে উঠলেন ভিঞ্চি।
ইতালিতে জন্ম নিলেও ভিঞ্চির জীবনের শেষ দিনগুলো কেটেছিল ফ্রান্সে। আর সেই জীবনের অন্তিমলগ্নের একটি ঘণ্টা উঠে এসেছে নাটকে। সেখানে ফরাসী রাজা প্রথম ফ্রাঁসোয়ার জন্য অপেক্ষায় থাকেন ভিঞ্চি। তার কণ্ঠে উচ্চারিত হয়- আজকের গোধূলি বেলায় তিনি আসবেন। তিনি রাজা। তার কথা আইন। তার কথা অব্যর্থ হতে জানে না।
আবার আমার প্রিয় সময় রাত্রি শেষে ঊষা আর দিন শেষে গোধূলি। ঊষাকালের সৃজন আমার লাচেন, দ্য লাস্ট সাপার, শেষ নৈশভোজ আর গোধূলি বেলার সৃজন আমার লা জোকোন্দ, মোনালিসা। ঊষা বেলায় ছিল আমার জনম আর গোধূলি বেলায় হতে চলেছে আমার মরণ। জনম থেকে মরণের এই জীবননদী প্রবাহে কত কত ঘাট যে ছুঁয়ে গেলাম, মানবতীর্থের কত রংবেরঙের মানুষ যে দেখে গেলাম, কত ভাঙ্গন-গড়নের যে সাক্ষী হলাম সেসব থেকে কিছু কথা, কিছু ব্যাখ্যা, কিছু প্রাপ্তি, কিছু তৃপ্তি না হয় ফুটে থাকুক দৈনিক দিনলিপির সমান্তরাল ইচ্ছাপত্রের পাতায় পাতায়, ডায়েরির সমান্তরাল উইল পেপারের বাঁধা খাতায়। সময় বড় কম। সব যায়। বয়ে যায়। চলে যায়। ক্ষয়ে যায়। নিভে যায়। সময় বয়ে যায়। যার যাওয়ার সেও চলে যায়...।
ঘটনার পরম্পরায় ভিঞ্চির মনে পড়ে তার শৈশবে ভিঞ্চি গ্রামে বেড়ে ওঠার কথা, সামাজিক নিস্পেষনে মাতৃত্ব থেকে বঞ্চিত হবার কথা, পিতার কাছ থেকে অবহেলা পাবার কথা, দাদু-দিদার কাছ থেকে অপার স্নেহ পাবার কথা, শিল্প গুরু ভেরোক্কির অপার স্নেহ সান্নিধ্য পাবার কথা, আরোপিত দোষের বিপরীতে আত্মপক্ষ সমর্থনের কথা, মোনালিসা-দ্য লাস্ট সাপারসহ বহু অঙ্কিত চিত্রকর্ম অঙ্কনের প্রেক্ষাপটের কথা, বহির্শত্রু মোকাবেলায় সমর পরিকল্পনার কথা, নিত্য-নতুন আবিষ্কারের কথা, প্লেগের মতো মহামারীর মাঝে দাঁড়িয়েও শিল্প সৃজনের কথা, ফ্রান্সের রাজার কোলে অন্তিম বেলায় মাথা রাখবার অন্তিম ইচ্ছার কথাসহ আরও কতশত রহস্যমাখা কথা।
ভিঞ্চি উচ্চারিত সংলাপের মতোই ঐতিহাসিক চরিত্ররা বাস্তবতা আর কল্পনার ডানায় ভর করে অতীত হতে বয়ে আসে, বর্তমানে বয়ে চলে এবং ভবিষ্যত পানে বয়ে যায়।
প্রযোজনাটিতে লিওনার্দো দ্য ভিঞ্চি সিনিয়র চরিত্রে রূপ দিয়েছেন মিজানুর রহমান। ভিঞ্চির জুনিয়ার চরিত্রে অভিনয় করেছেন সজীব মাহমুদ। মোনালিসা হয়ে সংলাপ আউড়েছেন শারমিন আক্তার নিসা। রাজা ফ্রাঁসোয়ার চরিত্রে অভিনয় করেছেন জুলফিকার আলী ভুট্টো। এছাড়া অন্য চরিত্রের অভিনয়শিল্পীরা হলেন সেকান্দার আলী, সরদার মোস্তাক, রুপালী খানম রুপা, মাহবুব আলম ও রাকিন আহমেদ।