ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

ব্যাংকিং খাতের সংস্কার

ড. মিহির কুমার রায়

প্রকাশিত: ২১:১৪, ৩০ জুলাই ২০২২

ব্যাংকিং খাতের সংস্কার

বাংলাদেশ ব্যাংক

অতিসম্প্রতি ৩০ জুন, ২০২২ বাংলাদেশ ব্যাংকের বিদায়ী গবর্নর মুদ্রানীতি (২০২২-২৩) ঘোষণাকালে কলেছিলেন দেশের সামনে দুটি মূল চ্যালেঞ্জ যথা মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ ও বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ স্থিতিশীল রাখা যা বৈশ্বিক অর্থনীতিতে একটি অতি আলোচিত বিষয় বিশেষত দক্ষিণ এশিযার দেশ শ্রীলঙ্কার অর্থনৈতিক বিপর্যয়ের পরএরই মধ্যে বিগত ১২ জুলাই, ২০২২ তারিখে নতুন গবর্নর বাংলাদেশ ব্যাংকে যোগদানের পর পরই পূর্বের ন্যায় একইভাবে মুদ্রার ব্যবস্থাপনার  সঙ্কট মোকাবেলায় নতুন তিনটি পদক্ষেপ ঘোষণা দিয়েছে

এতে বলা হয়েছে ডলারের চাহিদা কমিয়ে আনতে পণ্য আমদানি তদারকি, অব্যবহৃত ডলার নগদায়ন এবং ব্যাংকের অফশোর ইউনিট থেকে অভ্যন্তরীণ ব্যাংকিং কার্যক্রমের জন্য অর্থ ধার নেওয়ার সুযোগ তৈরি করতে আলাদাভাবে এসব নির্দেশনা দেওয়া হয়েছেরফতানি আয় হিসেবে পাওয়া বৈদেশিক মুদ্রার ইআরকিউ (রফতানিকারকের রিটেনশন কোটা) হিসেবে রাখা অর্থের ৫০ শতাংশ নগদায়ন করতে হবে এবং এর সীমা কমানো হয়েছে

অপরদিকে ব্যাংকের বিদেশে পরিচালিত অফশোর ব্যাংকিং ইউনিট থেকে অভ্যন্তরীণ ব্যাংকিং কার্যক্রমের জন্য মূলধনী যন্ত্রপাতি, শিল্পের কাঁচামাল ও সরকারী পর্যায়ে আমদানির জন্য ব্যাংকের রেগুলেটরি মূলধনের সর্বোচ্চ ২৫ শতাংশ অর্থ যোগান দেওয়া যাবেকেন্দ্রীয় ব্যাংকের নীতি নির্ধারণী এই তিন সিদ্ধান্তের ফলে ব্যাংকগুলোর কাছে বৈদেশিক মুদ্রার সরবরাহ বাড়বে বলে মনে করছেন ব্যাংকাররা

এরই মধ্যে আইএমএফের একটি উচ্চ পর্যায়ের টিম (আইএমএফ স্টাফ ভিজিট মিশন-২০২২)  বাংলাদেশ সফর করেছেন এবং ব্যাংক খাতে সংস্কারের অগ্রগতি জানতে গিয়ে  সরকারী ব্যাংকে উচ্চ খেলাপী ঋণ নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে  এবং রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকের উচ্চ খেলাপী ঋণ  কমাতে কী কী পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে, তাও জানতে চেয়েছেএকই সঙ্গে বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভের হিসাব পদ্ধতি নিয়ে ফের আপত্তি তোলে আইএমএফতাদের মতে  রিজার্ভের অর্থে গঠিত রফতানি উন্নয়ন তহবিলসহ (ইডিএফ) বিভিন্ন ঋণ তহবিল গঠন করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক, যা এখনও রিজার্ভেই দেখানো হচ্ছে

অথচ এগুলো নন লিকুইড সম্পদ বা ইনভেস্টমেন্ট গ্রেড সিকিউরিটিজসংস্থাটির ব্যালেন্স অব পেমেন্ট এ্যান্ড ইন্টারন্যাশনাল ইনভেস্টমেন্ট পজিশন (বিপিএম-৬) ম্যানুয়াল অনুযায়ী, এসব দায় রিজার্ভ হিসেবে বিবেচিত হবে নাএতে বাংলাদেশ ব্যাংক জানিয়েছে, দুটি পদ্ধতিতে রিজার্ভ হিসাব করে থাকে কেন্দ্রীয় ব্যাংক : একটি হলো গ্রস হিসাব এবং আরেকটি নিট হিসাবনিট হিসাবে রিজার্ভ থেকে বিভিন্ন ঋণ তহবিল বাদ দেওয়া হয়তবে আগামীতে আইএমএফের ম্যানুয়াল মেনেই রিজার্ভের হিসাব দেখানো হবে বলে একমত হয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংকবর্তমানে রিজার্ভের অর্থে ইডিএফে ৭০০ কোটি, জিটিএফে ২০ কোটি, এলটিএফএফে ৩ কোটি ৮৫ লাখ এবং সোনালী ব্যাংকের মাধ্যমে পায়রা বন্দর কর্তৃপক্ষকে ৬৪ কোটি ডলার ও বাংলাদেশ বিমানকে ৪ কোটি ৮০ লাখ ডলার ঋণ দেওয়া হয়েছে

এই ৭৯২ কোটি ৬৫ লাখ ডলারের বাইরে কারেন্সি সোয়াপের আওতায় শ্রীলঙ্কাকে দেওয়া হয়েছে ২০ কোটি ডলারএটা রিজার্ভ থেকে বাদ দিলে প্রকৃত রিজার্ভ ৩১ বিলিয়ন ডলারে নেমে আসবে

খেলাপী ঋণ নিয়ে প্রথম থেকেই সরকারের অর্থমন্ত্রণালয় সরগরম এবং ২ শতাংশ ঋণ পেরিশোধ করে খেলাপী ঋণীরা আরও নয় মাস ঋণ পরিশোধের জন্য সুযোগ পাবে বলে ঘোষণা এসে ছিল  এবং যারা শতকরা ৯ শতাংশ হারে ঋণ   নিয়ে নিয়মিত ঋণ পরিশোধকারী তারা অনেকটা অখুশি হয়েছিল তার পরও খেলাপী ঋণীর সংখ্যা ও ঋণের  পরিমাণ কমেনিতথ্য বলছে বাংলাদেশ ব্যাংকের গত ডিসেম্বর পর্যন্ত হিসাবে ব্যাংকিং খাতে খেলাপী ঋণের পরিমাণ ৯৪ হাজার ৩৩১ কোটি টাকা, আর আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) হিসেবে খেলাপী ঋণের পরিমাণ ২ লাখ ৪০ হাজার ১৬৭ কোটি টাকা এবং ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) হিসেবে প্রকৃতপক্ষে খেলাপী ঋণের পরিমাণ প্রায় ৩ লাখ কোটি টাকা

এখন কোন সংন্থা কোন পদ্ধতিতে খেলাপী ঋণের পরিমাণ হিসাব করেছে তা অবশ্য আলেচনার বিষয়সম্প্রতি অর্থ মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে রাষ্ট্রায়ত্ত সোনালী ব্যাংক, জনতা, অগ্রণী, রূপালী, বেসিক ও বাংলাদেশ ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক বার্ষিক কর্মপরিকল্পনা নিয়ে একটি চুক্তি করেছেওই চুক্তির প্রতিবেদনে ব্যাংকগুলোর খেলাপী ঋণ আদায় ও স্থিতি নিয়ে আগামী তিন বছরের পরিকল্পনা তুলে ধরা হয়ব্যাংকগুলো নিজ অবস্থান থেকে কী পরিমাণ খেলাপী ঋণ কমাবে, এর ঘোষণা সেখানে দেয়া হয়েছে প্রতিবেদনে দেখা গেছে, আগামী তিন বছরে খেলাপী ঋণ ৭ হাজার ২৪০ কোটি টাকা কমিয়ে আনার রূপরেখার মধ্যে চলতি অর্থবছরে করা হবে ১ হাজার ৭০৫ কোটি টাকাআর আগামী অর্থবছরে কমিয়ে আনার লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছে ২ হাজার ৫০০ কোটি টাকা এবং পরবর্তী অর্থবছরের লক্ষ্যমাত্রা হচ্ছে ৩ হাজার ৩৫ কোটি টাকা

অর্থা এ টাকা খেলাপীদের কাছ থেকে আদায় করা হবেব্যাংকগুলোর মতে, খেলাপী ঋণ আশঙ্কাজনকহারে বৃদ্ধির কারণে মূলধন সঙ্কট সৃষ্টির শঙ্কা দেখা দিয়েছেএ কারণে আন্তর্জাতিক মান অনুযায়ী মূলধন পর্যাপ্ততার হার সঠিক পর্যায়ে রাখা যাচ্ছে নাএর আগের তিন বছরে (২০১৭-২০১৯) রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলো খেলাপী ঋণ কমিয়েছে ৬ হাজার ৪৩৯ কোটি টাকাতবে ব্যাংকিং খাতে বিশেষজ্ঞদের মতে, খেলাপী ঋণ নিয়ন্ত্রণের প্রতিবন্ধকতা হিসেবে আইনী সীমাবদ্ধতা, রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ এবং ব্যবসায়িক প্রভাব রয়েছেএছাড়া কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তদারকি সক্ষমতায় ঘাটতি রয়েছে

তবে আশ্চর্যের বিষয় হলো আব্দুর রউফ তালুকদার নতুন গবর্নর হিসেবে যোগ দেওয়ার পাঁচ কার্যদিবসের মাথায় বাংলাদেশ ব্যাংক নতুন এই নীতিমালা জারি করে এবং নীতিমালায় খেলাপি ঋণে কী সুবিধা দেওয়া হবে, তা নির্ধারণ করার পুরো ক্ষমতা ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদের হাতে তুলে দেওয়া হয়েছে যার ফলে ব্যাংক মালিকেরাই এখন ঠিক করবেন তারা ঋণখেলাপীদের কী সুবিধা দেবেনআগে বিশেষ সুবিধায় ঋণ নিয়মিত করতে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের অনুমোদন লাগত, যা স্বয়ং গবর্নর অনুমোদন করতেন যা নতুন গবর্নর দায়িত্ব নিয়ে সেই ক্ষমতার পুরোটাই ব্যাংকগুলোর হাতে তুলে দিয়েছেন

নতুন নির্দেশনা মতে, আর্থিক খাতে স্থিতিশীলতা বজায় রাখা ও শ্রেণীকৃত ঋণের সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনার স্বার্থে ঋণখেলাপীদের জন্য বড় ছাড় দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংকএখন থেকে খেলাপী ঋণ নিয়মিত করতে আড়াই থেকে সাড়ে ৪ শতাংশ অর্থ জমা দিলেই হবেএর আগে খেলাপী ঋণ নিয়মিত করতে ১০ থেকে ৩০ শতাংশ জমা দিতে হতোআগে এ ধরনের ঋণ পরিশোধে সর্বোচ্চ দুই বছর সময় পেলে এখন ৫ থেকে ৮ বছরে সময় পাওয়া যাবে

একই সঙ্গে নতুন করেও ঋণ পাওয়া যাবেব্যাংক সংশ্লিষ্টদের মতে, ব্যাংক মালিকদের হাতে খেলাপী ঋণ সুবিধার ক্ষমতা থাকলেও জাল-জালিয়াতি, অনিয়ম, ও প্রতারণার ঋণ নতুন নীতিমালার আওতায় নিয়মিত করা যাবে নাএকটি ঋণ চার অর্থবছর পর পুনরায় একবার নিয়মিত করতে পারবে

×