ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ১৬ এপ্রিল ২০২৪, ৩ বৈশাখ ১৪৩১

কলাপাড়ায় রাখাইনদের  সেকেলে সামগ্রী

২৫০ বছরের পুরনো, এখনো মানুষকে আকৃষ্ট করে

মেজবাহউদ্দিন মাননু 

প্রকাশিত: ২৩:২৯, ৩১ মে ২০২৩

২৫০ বছরের পুরনো, এখনো মানুষকে আকৃষ্ট করে

রাখাইনদের ব্যবহৃত বিভিন্ন মূল্যবান জিনিসপত্র

তাল পাতায় রাখাইন ভাষায় লেখা পুঁথি। বৌদ্ধ দায়কের খাবার সরবরাহের কাঠের পাত্র। শূকর শিকার করার অস্ত্র, লেজা। সঙ্গে বহন করার অস্ত্র, ভারি ছ্যানা। কাঠ, পিতলসহ বিভিন্ন ধাতুর নির্মিত গৌতম বুদ্ধের ধ্যানমগ্ন মূর্তি। পিতলের ভারি ঘণ্টা। হরিণসহ বিভিন্ন বন্যপ্রাণীর শিংসহ মাথার হাড়। হরিণের চামড়া। সাগরপারের জনপদ কলাপাড়ার রাখাইনদের ব্যবহারের এসব জিনিসপত্র মানুষ এখনও খুঁজে বেড়ায়। রাখাইনদের নিত্যকাজের ব্যবহারে এখন এসব তেমন একটা লাগছেনা।

তারপরও রাখাইনদের অনেকের বাড়িতে অরক্ষিত অবস্থায় এসব পুরনো জিনিসপত্র পড়ে আছে। প্রবীণরা রেখেছেন স্বীয় কীর্তির চিহ্ন হিসেবে। যা দেখে কলাপাড়ায় আগত লোকজন জানতে পারে এই জনপদের অনেক অজানা কাহিনী। শুনতে চায় আদিবাসীদের সেকালের জীবনযাত্রা। হিংস্র শ্বাপদ-সঙ্কুল জনপদ কিভাবে হয়েছে বাসযোগ্য। কুয়াকাটায় আসা পর্যটকরা এসব দেখার জন্য, জানার জন্য ঘুরে বেড়ায় রাখাইন পল্লীতে।

প্রায় আড়াইশ’ বছরের বাসিন্দা রাখাইনদের হারানো এসব ঐতিহ্য সামগ্রী এখন অনেক প্রবীণদের কাছে পড়ে আছে, অযতœ আর অবহেলায়। কেউ আবার পরবর্তী কিংবা বর্তমান প্রজন্মকে জানার জন্য সংরক্ষণ করছেন। মিশ্রিপাড়া রাখাইনপল্লীর হেডম্যান আফ্রু মাদবর জানান, রাখাইনদের ব্যবহারের জিনিসপত্র নিজেদের সংরক্ষণ তো দূরের কথা এখন এদের অধিকাংশের জীবন জীবিকাই চলছে জোড়াতালি দিয়ে। তিনি জানান, আদিবাসীদের চরম দুর্দশার কথা। কিভাবে রাখাইনদের এই দেশে আগমন। কিভাবে বসতি স্থাপন শুরু করেন গহীন অরণ্যে, স্বাপদ সঙ্কুলের জনপদে। এদের ভিন্ন মাত্রার জীবন যাপন সম্পর্কে জানা যায় বহু অজানা তথ্য।

একসময়ের দাপুটে এই আদিবাসীদের বসবাসের কথা শুনলে মনে হয় যেন রূপকথার গল্প। অনেকগুলো পরিবার টংঘর তুলে একেক জায়গায় বসতি গড়ে তোলে। প্রত্যেকটি পাড়ায় পুকুর ছিল নিজেদের ব্যবহারের। যে পুকুরের পানিতে লাল পদ্ম ফুটত। স্বচ্ছ টলমল পানিতে পা ধোয়া ছিল বড় ধরনের অপরাধ। যে কেউ এ নিয়ম অমান্য করলে তাকে জরিমানা গুনতে হতো। ন্যূনতম বকা হতো। রাতের বেলা রাখাইন পল্লীতে অন্য মানুষের প্রবেশ ছিল নিষিদ্ধ। রাখাইন পল্লীর হেডম্যান, মাদবরের নির্দেশ অমান্যকারীর এক ধরনের বিচারের সম্মুখীন হতে হতো। পাড়ার হেডম্যানদের নামানুসারে হয়েছে অধিকাংশ গ্রামের নাম। কলাউ রাখাইনের নামে কলাপাড়া। ক্ষেপু রাখাইনের নামে খেপুপাড়া। এসব কথা এখন গল্পের ছলে বলেন প্রবীণ রাখাইনসহ ভিন্ন ধর্মের মানুষ। শোনার জন্য এখনও রাখাইন পল্লীতে ভিড় জমে দেশ-বিদেশের বহু পর্যটক-দর্শনার্থী। অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকেন তারা। শোনেন এসব।
বয়োবৃদ্ধ রাখাইনরা জানান, প্রত্যেকটি রাখাইন পরিবারের টংঘরের নিচে থাকত একটি করে তাঁত। যাতে নিজেদের পরিধেয় লুঙ্গি, চাদর, মেয়েদের টু-পার্টের জামা-কাপড় তৈরি করা হতো। পল্লীতে হাঁটলেই কানে বাজত তাঁত বোনার ঠক ঠক শব্দ। কালের বিবর্তনে, আর্থিক চরম দৈন্যে তাঁতসামগ্রী প্রায় হারিয়ে গেছে। জীবিকার প্রয়োজনে অনেকে এখন উল বুননের কাজ করছেন। অবস্থা এমন হয়েছে যে অধিকাংশ রাখাইন পল্লীতে ধর্মীয় অনুষ্ঠান পর্যন্ত ঠিকভাবে পালন করা হয়না। রাখাইন শিশুদের নিজের ভাষা শেখার স্কুল ছিল প্রত্যকটি রাখাইন পাড়ায়। যেখানে একজন রাখাইন ধর্মীয় শিক্ষক ছিল। এখন নতুন প্রজন্মের কাছে এসব গল্পের মতো মনে হয়। যেন নিজের সংস্কৃতি নিজের কাছে অচেনা মনে হয়। রয়ে গেছে অজানা। স্বকীয়তা হারিয়ে ফেলছে। 
যদিও বহুবিধ সমস্যার পাশাপাশি জমি-জমা দখল। এমনকি বৌদ্ধবিহার এলাকার দেবোত্তর সম্পত্তিও দখল করা হয়েছে এ সম্প্রদায়ের। অনেকে এলাকা ছেড়ে অন্যত্র চলে গেছেন। এখন পরিণত হয়েছে ক্ষয়িষ্ণু জাতিতে। তারপরও সাধ্যমতো উৎসবের মধ্য দিয়ে চলে প্রবারণা পূর্ণিমায় ফানুস উৎসব। ১৯৬০ সালে পটুয়াখালী ও বরগুনায় রাখাইন পাড়া ছিল একশ’ ৬৮টি। আর রাখাইন পরিবার ছিল পাঁচ হাজার একশ’ ৯০টি। আর বর্তমানে বরগুনা ও পটুয়াখালীতে মোট রাখাইন পাড়া রয়েছে মাত্র ৪৫টি। যার মধ্যে কলাপাড়ায় ২৯টি, লোক সংখ্যা মাত্র ১১শ’ ৬৬ জন। ১৯৯৮ সালের তথ্য এটি।
গোড়া আমখোলা পাড়ার রাখাইন তেননান মং জানান, রাখাইনদের প্রত্যেক পাড়ায় নিজেদের ব্যবহারের ধরন অনুযায়ী অনেক কিছু ছিল। যেমন চিড়া বানানোর জন্য ঢেঁকির আদলে কুড়িয়া ছিল। দায়কের খাবার সরবরাহের পাত্র ছিল। কাঠ দিয়ে তৈরি। কোনটার আবার নিচের অংশে লোহার প্রলেপ ছিল। হাতে চালানো চালকল ছিল। ২০০৯ সালের বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা কারিতাসের উদ্যোগে রাখাইন সংস্কৃতি সংরক্ষণ বিষয়ক এক মেলায় রাখাইনদের নিজস্ব সংস্কৃতি, ব্যবহারের সামগ্রী প্রদর্শন করায় উপচেপড়া ভিড় লেগে যায়। বহু অতিথি অবাক দৃষ্টিতে অবলোকন করেন। রাখাইন শিশুরা উৎফুল্ল চিত্তে দলবদ্ধ হয়ে এসব ঘুরে দেখেছে।

মিশ্রিপাড়ার প্রবীণ বাসিন্দা রাখাইন মংলাচিন জানান, তিনি নিজ উদ্যোগে এখানকার আদিবাসী রাখাইনদের সংস্কৃতি, ইতিহাস-ঐতিহ্য, ধর্মাচার, রীতি, পুরনো ব্যবহার সামগ্রী সংরক্ষণ করেছেন। এখনো সংগ্রহ করছেন। একটি ঘরও তুলেছেন। রাখাইনসহ এই জনপদের পরবর্তী প্রজন্ম যেন প্রকৃত ইতিহাস জানতে পারেন এবং স্বচক্ষে কিছু একটা অবলোকন করতে পারে এ জন্য তিনি আপাতত একটি সংগ্রহশালা করছেন। এটিকে জাদুঘরে রূপান্তরের পরিকল্পনা রয়েছে তার।
কলাপাড়া উপজেলা নির্বাহী অফিসার জাহাঙ্গীর হোসেন জানান, রাখাইনদের কালচার, ইতিহাস-ঐতিহ্য তুলে ধরার জন্য তারা যদি জাদুঘর করার পরিকল্পনা নেয় সেটি ভালো পদক্ষেপ। সেক্ষেত্রে সরকারের পক্ষ থেকে সকল ধরনের সহায়তা দেওয়া হবে।

×