ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

পদ্মায় ইলিশ শিকারি

প্রবীণ জেলের পেশা বদল

-

প্রকাশিত: ২২:০২, ৬ অক্টোবর ২০২২

প্রবীণ জেলের পেশা বদল

পদ্মায় জেলেদের জাল গোটানোর আগ মুহূর্ত

পঁচাত্তর বছরের হরিশ চন্দ্র ভোমন। ছোট বেলা থেকেই ইলিশ শিকারের সঙ্গে জড়িত। মুন্সীগঞ্জ তথা বিক্রমপুরের লৌহজং উপজেলার পদ্মা পারের হলদিয়া গ্রামে তার বসতি। নিজের ইলিশ ধরার নৌকা ছিল, কর্মচারীও ছিল। কিন্তু এখন গায়ে আর সেই শক্তি নেই। দুই মেয়েকেই বিয়ে দিয়েছেন। দুই ছেলেকেও বিয়ে করিয়েছেন। নিজের আর নৌকা নেই। তাই এখন তারই গ্রামের ইলিশ শিকারি রুহুল আমিন দেওয়ানের নৌকায় কাজ করেন। এক ছেলে স্বর্ণের দোকানে কাজ করলেও আরেক ছেলে অরুণ চন্দ্র ভোমন তার সঙ্গেই দেওয়ানের ইলিশের নৌকার কর্মচারী।
প্রবীণ এই জেলে বলেন, পদ্মায় এখন ইলিশ পাওয়া যাচ্ছে কম। নানা কারণেই ইলিশ পদ্মায় আসতে বাধাগ্রস্ত হয়। তবে ভাল দিনও আসে। সরকারের নানা তৎপরতার কারণে এখন ইলিশের উৎপাদন বেড়েছে। বড় ইলিশও পাওয়া যায়। সুদিন আর দুর্দিন নিয়েই এই পেশায় এখনও টিকে আছেন। স্ত্রী-সন্তান নিয়ে জীবন ধারণ করেন এই ইলিশ শিকার করেই।

মুন্সীগঞ্জ তথা বিক্রমপুরের বেশ কয়েকটি জেলেপল্লী রয়েছে। তবে সবই নদীর ধারে। তাদের জীবনযাপন এবং জেলেপল্লীর মানুষের নানা রকম স্মৃতি। বৈরী আবহাওয়াসহ শীত-বর্ষা বিভিন্ন ঋতুতে বিভিন্ন রকম সময় কাটে। হরিশ চন্দ্র ভোমন বলেন, এই পেশায় থেকেই বিদায় নিতে চাই। কারণ তার পূর্ব পুরুষরাও এই পেশাকে আঁকড়ে রেখে ছিলেন।
এই অঞ্চলের সবচয়ে বড় ইলিশ শিকারি এখন রুহুল আমিন দেওয়ান। হলদিয়া গ্রামের এই ইলিশ শিকারির নিজের ১০টি ইলিশ ধরার নৌকা। তার পিতার সময় থেকেই ইলিশ শিকার করেন। পিতা আব্দুল আলী দেওয়ানের ইলিশের নৌকা ছিল তিনটি। এর তিনি সেটিকে বাড়িয়েছেন। প্রতিটি নৌকায় ইলিশ শিকারের স্বাথে জড়িত ৯ থেকে ১০ জন করে। সব মিলিয়ে ৯৫ জন জেলে রয়েছেন, তার মাছ ধরার দলটিতে। এর মধ্যে নবীণ ও প্রবীণ জেলেও রয়েছে। অভিজ্ঞতার জন্য প্রবীণরা ভূমিকা রাখছেন। আর উত্তাল পদ্মায় ইলিশের জাল ফেলা ও জাল উঠানোর কাজে বেশি ভূমিকা রাখেন নবীনরা।  
এই টিমের ৪৮ বছর বয়সী দেলোয়ার মাঝি বলেন, পদ্মায় রুপালি ইলিশ ধরতে ভাল লাগে। ইলিশ পাওয়া গেলেও খাওয়া-দাওয়া ভাল হয়। আর ৫৩ বছরের আব্দুর রব মাঝি বলেন, ইলিশের প্রজনন মৌসুম সামনে। ইলিশ সমুদ্র থেকে ডিম দেয়ার জন্য পদ্মা ও মেঘনায় উঠে আসে। ৭ অক্টোবর থেকে ২৮ অক্টোবর ২২ দিন ইলিশ ধরা এবার নিষিদ্ধ। কিন্তু এবার তেমন ইলিশ দেখা যাচ্ছে না।  
রুহুল আমিন দেওয়ান বলেন, সমুদ্র থেকে ইলিশ উঠে আসতে বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। কারেন্ট জাল এমনভাবে পথে পথে ব্যারিকেট দিয়ে রাখা হয় যা ইলিশ চলাচলে ক্ষতিগ্রস্ত করছে। আর নোয়াখালীর ভাসানচরের কাছে বড় একটি চরের কারণেও সমস্যা হচ্ছে বলে জানান তিনি। আর মুন্সীগঞ্জের পদ্মা নদীতে ব্যাপকভাবে বালু কাটার কারণেও ইলিশ ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। পদ্মায় এমন বালু উত্তোলন চলমান থাকায় ইলিশের প্রজনন বাধাগ্রস্ত হচ্ছে।

ইলিশ ডিম ছাড়ার পর এই অবস্থায় তার আর সুরক্ষা সম্ভব হবে বলেও মনে করেন না তিনি। অপরিকল্পিতভাবে বালু কাটার কারণে নদীর তলদেশও ক্ষতিগ্রস্ত হওয়া মাছের জন্য ক্ষতিকর বলে মনে করেন এই ইলিশ শিকারি। তিনি জানান, নদীতে মাছ থাকলে তাদের কোন অভাব নেই। কিন্তু মাছ না থাকলে নৌকা আর এত বড় জেলে দল বেকার থাকা ছাড়া আর কিছু করার থাকে না।   
রুহুল আমিন দেওয়ান বলেন, তাদের সব নৌকাই ইঞ্জিনচালিত। ডিজেলের দাম বৃদ্ধির কারণে খরচ বেড়েছে। প্রতিটি নৌকায় জেলেদের খাবারসহ খরচ পড়ে যায় ৫ হাজার। কিন্তু এখন নদীতে ৫ হাজার টাকার ইলিশ পাওয়া যাচ্ছে না। তার একটি নৌকা ৩ হাজার টাকার ইলিশ পেয়েছে। বাকি ২ হাজার লোকসান। তবে এমনও দিন যায় ১০ হাজারেও বেশি টাকার ইলিশ ধরা পরে। সেই দিন এখন স্মৃতি।
রহুল আমিন দেওয়ান বলেন, আমাদের পাশেই গাঁওদিয়া। পদ্মা পারের এই গ্রামে বসেই মানিক বন্দ্যোপধ্যায় কালজয়ী উপন্যাস পদ্মা নদীর মাঝি রচনা করেন। সেই উপন্যাসের কুবের মাঝর মতো এখন আর মাঝিদের কষ্ট নেই। আমরা ভাল দামেই ইলিশ বিক্রি করতে পারছি। কিন্তু ইলিশ সুরক্ষায় সরকার যেসব উদ্যোগ নিয়েছে তা কার্যকর করা আমাদের জেলদেরও অনেক দায়িত্ব। কিন্তু মৌসুমী জেলে আর কারন্টে জালই সর্বনাশ করছে। এই ইলিশ শিকারী বলেন, শুধু কারেন্ট জাল বন্ধ করা গেলেই ইলিশের উৎপাদন কয়েকগুণ বেড়ে যাবে।
লৌহজং উপজেলা নির্বাহী অফিসার ডাঃ আব্দুল আওয়াল বলেন, ইলিশ রক্ষায় সরকার সব রকম চেষ্টা চালাচ্ছে। একই সঙ্গে প্রজনন মৌসুমে নদীতে কোন ড্রেজার  থাকবে না। রাত-দিন অভিযান চলবে। এ ছাড়া কারেন্ট জাল বন্ধেও অভিযান থাকবে। তিনি বলেন, ভ্রাম্যমাণ আদালতে মৎস্য বিভাগ ছাড়াও নৌ পুলিশ, কোস্ট গার্ডসহ অতিরিক্ত আরও কিছু পরিকল্পনা রয়েছে। জেলেদের স্বার্থেই এসব করা হচ্ছে। ইলিশের উৎপাদন বারলে জেলেরাই উপকৃত হবেন। মাছ ধরার নিষিদ্ধ সময়ে জেলে পরিবারে খাদ্য সাহায্য প্রদান করা হবে।
হরিশ চন্দ্র ভোমনদের মত জেলায় ৩ হাজার ৬শ’ জেলে ইলিশ শিকার করেন। মুন্সীগঞ্জ জেলা মৎস্য অফিসার শামশুল করিম জানান,  জেলায় ১০ হাজার ৬৪ জন নিবন্ধিত জেলে থাকলেও সবাই ইলিশ শিকারের সঙ্গে জড়িত নন। ইলিশ শিকারের জন্য জাল এবং নৌকাই আলাদা। তাই ইলিশ শিকারের সাথে জড়িতদেরই দেয়া হবে খাদ্য সহযোগিতা। তিনি জানান, গেলো এক বছরে জেলায় ইলিশ উৎপাদন হয়েছে প্রায় ২ হাজার ৭২ মেট্রিক টন। মা ইলিশ রক্ষা অভিযান সফল হলে এই উৎপাদন আরও বাড়বে বলে তিনি আশা করেন।
এদিকে ভোরের ইলিশের সর্ববৃহত হাট ‘মাওয়া মৎস্য আড়ত’ ইলিশ সংশ্লিষ্টদের পদচারনায় মুখর থাকে। তবে ৭ অক্টোবর থেকে ইলিশ প্রজনন মৌসুমের ২২ দিন ইলিশ বেচা-কেনা বন্ধসহ ইলিশ রক্ষায় কাজ করবে বলে জানিয়েছেন আরত কমিটির সভাপতি ছানা রঞ্জন দাস ও সাধারণ সম্পাদক হামিদুল ইসলাম।
এই আরতের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক বলেন, জেলেদের কথা চিন্তা করেই কারেন্ট জাল বন্ধ করা দরকার। কারেন্ট জালের কারণেই প্রকৃত জেলেদের দুর্দিন যাচ্ছে।

মীর নাসির উদ্দিন উজ্জ্বল, মুন্সীগঞ্জ

×