ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

ঐতিহ্যবাহী শঙ্খ শিল্পের নিদর্শন, প্রতিমার সাজ, বিচিত্র কেনাকাটা

মোরসালিন মিজান

প্রকাশিত: ২৩:৩৮, ২৬ সেপ্টেম্বর ২০২২; আপডেট: ০০:১৬, ২৭ সেপ্টেম্বর ২০২২

ঐতিহ্যবাহী শঙ্খ শিল্পের  নিদর্শন, প্রতিমার সাজ,  বিচিত্র কেনাকাটা

দুর্গোৎসব সামনে রেখে দারুণ মুখরিত এখন শাঁখারীবাজার। শঙ্খ শিল্পের নানা নিদর্শন ও প্রতিমা সাজানোর সরঞ্জাম বিক্রি হচ্ছে মধ্যরাত পর্যন্ত

শারদীয় দুর্গোৎসবের আনন্দঘন সময়টা প্রায় চলে এসেছে। আগামী ১ অক্টোবর থেকে পূজার শুরু। তার আগে দেশজুড়েই চলছে প্রস্তুতি। তবে পুরান ঢাকার শাঁখারীবাজারের প্রস্তুতি পর্বটি বিশেষ বর্ণাঢ্য হয়। এবারও এর ব্যতিক্রম হচ্ছে না। প্রাচীন গলি এখন সকাল থেকে মধ্যরাত পর্যন্ত সরগরম থাকছে। দোকানগুলোতে এখন বাহারি পণ্যের পসরা। ঐতিহ্যবাহী শঙ্খ শিল্পের নিদর্শন তো আছেই, সেইসঙ্গে প্রতিমা সাজানোর যাবতীয় উপকরণ পাওয়া যাচ্ছে এখানে। মাঙ্গলিক পণ্যের পসরা বসেছে যথারীতি। জমে উঠেছে কেনাবেচা। আসছেন দর্শনার্থীরাও।  
করোনা মহামারীর কারণে গত দুবছর শারদীয় দুর্গোৎসবের আনুষ্ঠানিকতা ছিল সীমিত। এবার মোটামুটি করোনামুক্ত সময়। ফলে দারুণ রঙিন এক উৎসব আশা করা হচ্ছে। সে লক্ষ্যে সর্বত্রই চলছে জোর প্রস্তুতি। আর এ প্রস্তুতি পর্বের ছবিটা সবচেয়ে ভাল দৃশ্যমান হচ্ছে শাঁখারীবাজারে। ছোট্ট সরু গলি সকাল থেকে মধ্যরাত পর্যন্ত সরগরম।
ইতিহাসবিদদের মতে, ১২ শতকে বল্লাল সেনের শাসনামলে ঢাকায় শঙ্খ শিল্পের উদ্ভব ঘটে। যারা এ কাজের সঙ্গে যুক্ত তারা শাঁখারী হিসেবে পরিচিত। এ সম্প্রদায়ের মানুষেরা প্রথমে ছিলেন বিক্রমপুরে। সতেরো শতকে চলে আসেন ঢাকার শাঁখারীবাজারে। মূলত মোগলরা তাদের এখানে নিয়ে আসেন। সেই থেকে এখনও একই ঠিকানায় আছেন। ছোট্ট সরু গলি। ঘিঞ্জি ঘর। ঘরের এক অংশে পরিবারসহ বসবাস। অন্য অংশে ব্যবসা প্রতিষ্ঠান। ব্যবসা প্রতিষ্ঠান বলতে দোকান। দোকানগুলোতে শঙ্খশিল্পের নিদর্শন ছাড়াও বাহারি পণ্যের
পসরা সাজিয়ে রাখা হয়েছে। সারা বছরই এসব পণ্য বিক্রি হয়। তবে শারদীয় দুর্গোৎসব সামনে রেখে বিশেষ জমজমাট হয়ে ওঠে। সে সময়টিই চলছে এখন।
রবিবার রাতে শাঁখারীবাজারে গিয়ে দেখা যায়, দুর্গোৎসব রঙিন করার নানা উপকরণ বিক্রি হচ্ছে এখানে। প্রতিমার সাজ-পোশাক মাথার মুকুট জরি মতি চুমকিÑ আরও কত কী! আছে ম-প ও তোরণ সাজানোর উপকরণ। মৃৎশিল্প, কাঁসা পিতল শিল্প, শোলা শিল্প সামগ্রীর আলাদা আলাদা দোকান রয়েছে।
তবে শাঁখারীবাজারের খ্যাতি শাঁখা শঙ্খের জন্যই। একসময় বাসিন্দারা সবাই এ কাজ করতেন। পূর্ব পুরুষের চর্চা এখনও অনেকে ধরে রেখেছেন। পূজার সময় চাহিদা বেশি থাকে। তাই শাঁখারীদের ব্যস্ততাও বেড়েছে। ব্যস্ততা যে বেড়েছে তা গলি ঘুরে বেশ বোঝা যায়। এখন চোখের সামনেই কাজ করছেন কারিগররা। কেউ শাঁখা শঙ্খ নিয়ে কাজ করছেন। কেউ কাজ করছেন বাদ্য শঙ্খ নিয়ে।
ব্যবসায়ী সমিতির অফিসে বসে শাঁখা গড়ার কাজ করছিলেন জনৈক স্বপন নন্দী। ওপর থেকে লম্বা তারে ঝুলতে থাকা বৈদ্যুতিক বাল্বের আলোর নিচে, অর্থাৎ, মেঝেতে বসে শাঁখার গায়ে নক্সা করছিলেন তিনি। কথা প্রসঙ্গে বললেন, পূজায় নারীরা নতুন শাঁখা পরতে ভালবাসেন। চাহিদা বিবেচনায় প্রচুর শাঁখা আগেই গড়া হয়েছে। আর এখন আমরা অর্ডারের কাজগুলো করছি।
শাঁখার গায়ে ছিদ্র করতে করতে তিনি বলেন, ক্রেতার চাওয়া অনুযায়ী এই শাঁখা জোড়ায় স্বর্ণ বসানো হবে। আগে অর্ডার নিয়েছিলাম। এমন আরও বেশ কিছু অর্ডার আছে বলে জানান তিনি।
আরেকটি ঘরে বসে কাজ করছিলেন প্রদীপ নামের এক কারিগর। ভবনের ভেতর দিয়ে লম্বা সরু গলি। গলির শেষ মাথায় ছোট্ট ঘর। সেখানে খালি গায়ে মেঝেতে বসে আপন মনে কাজ করছিলেন। তার সামনে অনেকগুলো বাদ্য শঙ্খ। বিশেষ পদ্ধতিতে শঙ্খগুলোর গা কেটে সেখানে লতা পাতার নক্সা করা হয়েছে। একইভাবে তুলে ধরা হয়েছে প্রতিমার মুখ। প্রদীপ জানালেন, বাদ্য শঙ্খে ‘ফিনিশিং টাচ’ দিচ্ছেন তিনি। এরপর এগুলো দোকানে চলে যাবে বিক্রির জন্য।
গলি ঘুরে দেখা যায়, প্রায় সব দোকানেই শঙ্খ শাঁখা ও শঙ্খ বাদ্য সাজিয়ে রাখা হয়েছে। ছোট ছোট দোকানে বসে নারীরা হাতে শাঁখা পরছেন। পছন্দ হলে দরদাম করে কিনে নিচ্ছেন তৎক্ষণাৎ।
লক্ষ্মী ভা-ার নামের একটি দোকান ৬০-৭০ বছরের পুরনো। এখান থেকে শাঁখা কিনছিলেন আরতি রানী নামের এক নববধূ। পরিবারের আরও কয়েক নারীকে সঙ্গে নিয়ে এসেছিলেন তিনি। বললেন, করোনাকালে বিয়ে হয়েছে আমাদের। ফলে উৎসব অনুষ্ঠান তেমন কিছু হয়নি। এবার তাই ভালভাবে পূজাটা করতে চান। আর পূজার সাজের জন্য প্রথমেই শাঁখা কিনতে এসেছেন বলে জানান তিনি।   
শাঁখারীবাজারে পাওয়া যাচ্ছে প্রতিমা সাজানোর উপকরণও। বিচিত্র সম্ভার  এখানে। ‘মা বাসন্তী’ নামের একটি দোকানে গিয়ে দেখা গেল প্রতিমার মাথায় স্থাপনের জন্য রঙিন মুকুট তৈরি করা হয়েছে। একেক মুকুটের একেক নাম। কোনটির নাম বাংলা চূড়া বা ওরিয়েন্টাল। কোনটি আবার লক্ষ্মীবাংলা নামে পরিচিত। দোকানে সরাসরি বিক্রির পাশাপাশি বাক্সবন্দী করা হচ্ছিল মুকুট। কেন? জানতে চাইলে কারিগর ও বিক্রেতা শঙ্কর সরকার বলেন, এগুলো ঢাকার বাইরে যাচ্ছে। আগে অর্ডার নেয়া ছিল। আজকে ডেলিভারি দিচ্ছি। পূজার শেষ দিন পর্যন্ত তাদের বিক্রি কম বেশি চলবে বলে জানান তিনি।  
প্রতিমা সাজাতে প্রয়োজন হয় শাড়ি গহনারও। উজ্জ্বল রঙের শাড়িতে এম্ব্রয়ডারি কাজ করা হয়েছে। বসানো হয়েছে জরি চুমকি। আকর্ষণীয় এমন শাড়ি গহনা দিয়ে ভর্তি ‘আরতি ভা-ার’ নামের একটি দোকান। দোকানের শাড়ি দেখে আসন্ন উৎসবের রংটা অনুমান করা যায়। তরুণ দোকানি প্রান্ত জানান, প্রতিমা সাজানোর জন্য ২৫ থেকে ২৬ জাতের বস্ত্র রয়েছে তাদের কাছে। শাড়িগুলো থান কাপড়ের মতো। প্রতিমার মাপ অনুযায়ী কেটে বিক্রি করা হয়। যে যার বাজেট অনুযায়ী কিনছেন।
প্রতিমার মাথার চুল, হাতের মুঠোয় ধরে রাখার অস্ত্র ইত্যাদিও বিক্রি হচ্ছে দোকানে দোকানে। এক দোকানি চুল দেখিয়ে বললেন, ৮ জাতের চুল আছে আমাদের কাছে। প্রতিমাকে সুন্দর করে উপস্থাপন করতে হলে চুলের বিকল্প নেই। ফলে চুলের আলাদা চাহিদা বলে জানান বিক্রেতা।
পূজার ম-প, তোরণ ইত্যাদি সাজানোর জন্য দোকানগুলোতে রাখা হয়েছে শোলা ও কাপড়ের তৈরি নানা জাতের ফুল, মালা। জরি বিক্রি হচ্ছে। এর বাইরে আছে অসংখ্য পূজার উপকরণ। পূজার আনুষ্ঠানিকতায় প্রয়োজন হয় এমন সব কিছুই  পাওয়া যাচ্ছে।  
এসব কারণে শাঁখারীবাজারে ভিড় বেশি। দেশের নানা প্রান্ত থেকে ক্রেতারা আসছেন। তার চেয়েও বেশি আসছেন কৌতূহলী মানুষ। সব ধর্মের মানুষ আগ্রহ নিয়ে গলি ঘুরে বেড়াচ্ছেন। দেখে মনে হচ্ছে, উৎসব শুরু হয়ে গেছে!

 

×