মৌলভীবাজারের সাতছড়ি জাতীয় উদ্যানে বিচরণ করছে বনমোরগ
আপাত দৃষ্টিতে সাধারণ মোরগের মতোই মনে হয়। বাস্তবে তা নয়। বনমোরগ কিছুটা আলাদা প্রজাতির। পাখির স্বভাব আছে। ডানা দুটোও ভাল ব্যবহার করতে জানে। শক্তি-সামর্থ্যও সাধারণ মোরগের চেয়ে বেশি। হবিগঞ্জের বনে এ ধরনের মোরগের দেখা মেলে।
জেলার চুনারুঘাট উপজেলায় অপেক্ষাকৃত দুর্গম পাহাড়ী অঞ্চলে অবস্থিত রেমা-কালেঙ্গা ও সাতছড়ি। এগুলোর মধ্যে রেমা-কালেঙ্গা বাংলাদেশের দ্বিতীয় বৃহৎ প্রাকৃতিক বনভূমি। এ বনে বিভিন্ন বিরল প্রজাতির উদ্ভিদ ও পশুপাখির আবাসস্থল। বিশেষ করে সাতছড়ি ও রেমা-কালেঙ্গার অরণ্যে বনমোরগ ও বনমুরগি দেখা যায়। সকাল-সন্ধ্যায় এদের ডাক কানে আসে। বনের কোন গাছতলায় পাকা ফল ঝরে পড়লে বনমোরগ খেতে চলে আসে। আবার বনের বড় গাছে উঠেও ফল খায় এরা।
বনমোরগ দেখতে গৃহপালিত মোরগ-মুরগির মতোই। তবে মোরগের লেজের দুটি পালক লম্বা থাকে। ধারণা করা হয়, এরাই গৃহপালিত মোরগ ও মুরগির পূর্বপুরুষ। সুদূর অতীতে এশিয়া অঞ্চলে বনের এই পাখিকে পোষ মানানো হয়। পাহাড়ের পাদদেশে ঘন প্রাকৃতিক ঝোপের ভেতর মাটিতে জানুয়ারি থেকে সেপ্টেম্বর মাসে এরা বাসা করে।
পাহাড়, টিলা, চা বাগান ও প্রাকৃতিক ঘনবনের কাছাকছি নিরাপদ খোলামাঠে একাকী, জোড়ায় ও দলবদ্ধভাবে চরে বেড়ায়। প্রধানত, ফল, বীজ, শস্যকণা, কচি পাতা, কেঁচো ও কীটপতঙ্গ এদের খাদ্য। শীতের সময় কুয়াশা থাকা অবস্থায় খাদ্যের সন্ধানে বের হয়।
এ ব্যাপারে বনগবেষক মোঃ আহমদ আলী বলেন, ‘বনমোরগ খুব সপ্রতিভ ধরনের হয়। মানুষের পায়ের শব্দ পেলেই দ্রুত পালিয়ে যায়। এরপরও বনমোরগ শিকার থেমে নেই। একটি চক্র দুর্লভ প্রজাতির মোরগ নিঃশেষ করে দিতে উঠেপড়ে লেগেছে। ফলে সংখ্যাটা দিন দিন কমছে। বিপন্ন পাখির তালিকায় এখন বনমোরগ।
তিনি বলেন, সিলেট বিভাগের চা বাগান ও বন না থাকলে বনমোরগ প্রায় বিলুপ্তই হয়ে যেত। শিকারিরা চা বাগানে ঢুকতে পারে না বলে ঘন চা বাগানে এরা অনেকটা নিরাপদে থাকে। তবে প্রাকৃতিক বনে বাস করা শিকারিরা বনমুরগি শিকার তো করেই, উপরন্তু বাসা থেকে ডিম ছিনিয়ে নেয়।
হবিগঞ্জের পাখিপ্রেমিক সোসাইটির সভাপতি মোঃ মোজাহিদুর রহমান মসি বলেন, রেমা-কালেঙ্গা ও সাতছড়ি বনে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক বনমোরগ আছে। খুব সকালে ও সন্ধ্যার আগে বনের কাছাকাছি খোলা জায়গায় খাবার খেতে বের হয়। দ্রুত দৌড়াতে পারে। প্রয়োজন হলে দিতে পারে উড়ালও।
রেমা-কালেঙ্গা বনের কালিয়াবাড়ি আদিবাসী পুঞ্জির হেডম্যান বিনয় দেববর্মা বলেন, বনমোরগ মাঝারি আকারের ভূচর পাখি। এদের মাথায় ঝুঁটি ও গলার দুই পাশে দুটি ঝুলন্ত লতিকা থাকে। বনের মোরগ রক্ষায় বন বিভাগকে তারা সার্বিকভাবে সহায়তা করছেও বলে জানান তিনি।
সাতছড়ি বন্যপ্রাণী রেঞ্জ কর্মকর্তা মোঃ আব্দুল্লাহ আল আমিন বলেন, অন্যান্য পশুপাখির পাশাপাশি বনমোরগের জন্য ভ্রমণপিপাসুদের কাছে এ উদ্যানটি প্রিয় হয়ে উঠেছে। তা ছাড়া এখানে যাতায়াতও সহজ।
এদিকে জরিপ বলছে, এখানে ৩৭ প্রজাতির স্তন্যপায়ী, ১৬৭ প্রজাতির পাখি, সাত প্রজাতির উভচর, ১৮ প্রজাতির সরীসৃপ এবং ৬৩৮ প্রজাতির উদ্ভিদ রয়েছে। আদিবাসী সম্প্রদায় ত্রিপুরা, সাঁওতাল ও উড়ং এই বনভূমির আশপাশে এবং অভ্যন্তরে বসবাস করে। বিরল প্রজাতির মেছো বিড়ালের বিচরণও রয়েছে এ জঙ্গলে। এসবের সঙ্গেই বসবাস করছে বনমোরগ। এ প্রাণিটি এ বনের ঐতিহ্য বহন করছে।
যতদূর জানা যায়, হবিগঞ্জ ছাড়াও সিলেট, মৌলভীবাজার, চট্টগ্রাম বিভাগের চিরসবুজ বন, চা বাগান, শেরপুর ও মধুপুর শালবন ও সুন্দরবনে বনমোরগ বাস করে। দেশের বাইরে নেপাল, ভুটান, মিয়ানমার, ভারত, চীন, মালয়েশিয়া, মালদ্বীপ ও ইন্দোনেশিয়ায় বনমোরগ দেখা যায়।