ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

যেন জনতার মহাসমুদ্র

প্রকাশিত: ২৩:২৩, ২৬ জুন ২০২২

যেন জনতার মহাসমুদ্র

বিশেষ প্রতিনিধি/ মাদারীপুর ও শরীয়তপুর নিজস্ব সংবাদদাতা ॥ এ যেন মহান মুক্তিযুদ্ধের গণজাগরণের মতোই এক স্বর্ণালি মুহূর্ত। তাই জীবনকালের অন্যতম স্মরণীয় মুহূর্ত থেকে বঞ্চিত হতে চাননি কেউ-ই। সবাই ইতিহাসের সাক্ষী হতে জড়ো হয়েছিলেন শিবচরের বাংলাবাজার ফেরিঘাটের জনসভায়। এ কারণে জনসভার চতুর্দিকের কয়েক কিলোমিটার এলাকা যেন পরিণত হয়েছিল জনতার মহাসমুদ্রে। ইতিহাসের স্মরণীয় পদ্মা সেতুর স্বপ্নপূরণের মহোৎসবের মহাআয়োজনে শামিল হয়েছিল দেশের লাখ লাখ মানুষ। বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনার দেয়া উপহার দেশের ইতিহাসে সর্ববৃহৎ স্থাপনা পদ্মা সেতুর স্বপ্নপূরণের মহোৎসবে সাক্ষী হতে শামিল হয়েছিল দক্ষিণবঙ্গের ২১টি জেলাসহ দেশের লাখ লাখ মানুষ। যেদিকে চোখ যায় শুধুই জন¯্রােত। চারিদিকে শুধু মানুষ আর মানুষ। এমন জন¯্রােত, বিশাল জনসমুদ্র ঠিক কতদিন আগে দেখেছে তা মনে করতে পারেননি কেউ-ই। বঙ্গবন্ধুর পর তাঁরই কন্যার হাত ধরে আরেকটি ঐতিহাসিক বিজয় উল্লাসে মেতে উঠেছিল দক্ষিণবঙ্গের ২১টি জেলাসহ সারাদেশের মানুষ। বাংলাদেশের মানুষই শুধু নয়, পদ্মা সেতুর উদ্বোধনকে ঘিরে বিশ্বের সকল বাঙালী যেন বিশেষ এক আবেগ উচ্ছ্বাসে মেতে উঠেছিল। বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা একক সিদ্ধান্তে জাতীয়-আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্রকারীদের চ্যালেঞ্জ দিয়ে দেশের টাকায় পদ্মা সেতু নির্মাণ করে বাংলাদেশের মানুষের জন্য স্বপ্নপূরণের এই মহোৎসবের উপলক্ষ এনে দিয়েছিলেন। তাই শনিবার শুধু প্রমত্তা পদ্মা নদীর দু’পাড়ই নয়, গোটা দেশের মানুষই মেতে উঠেছিল মুক্তিযুদ্ধের বিজয়ের মতোই আরেকটি বড় বিজয়ের আনন্দ-উৎসবে। মানুষের দেশাত্মবোধের এক অনন্য নজিরও সৃষ্টি হয়েছিল এই পদ্মা সেতুর বর্ণিল উদ্বোধনকে ঘিরে। যার এক কৃতিত্বের দাবিদারÑ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। পদ্মা সেতুর উদ্বোধন ঘিরে উৎসবের বর্ণিল আয়োজনে লাখ লাখ মানুষের ঢল নেমেছিল প্রমত্তা পদ্মা নদীর দুই পাড়ে। পদ্মা সেতুর উত্তর প্রান্তে মাদারীপুরের শিবচরের ইলিয়াস আহমেদ চৌধুরী (বাংলাবাজার) ফেরিঘাটে আয়োজিত জনসভাকে ঘিরে চতুর্দিকের কয়েক কিলোমিটার এলাকা পরিণত হয়েছিল জনারণ্য। চারিদিকে স্বপ্নপূরণের মহোৎসবের আমেজে শুধু মানুষ আর মানুষ। জনতার ঢলে যেন জনসমুদ্র। শত শত পুলিশ, র‌্যাব, সোয়াত, গোয়েন্দা বাহিনীর কঠোর নিরাপত্তা বলয়। কিন্তু জন¯্রােত সামলাতে গলদঘর্ম হতে হয় সবাইকে। জনসভা শেষে রাতের আঁধার নামতেই সড়কবাতির ঝলকে আলোকিত হয়ে ওঠে প্রমত্তা পদ্মার বুক। শত ষড়যন্ত্র পেরিয়ে চ্যালেঞ্জ নিয়েই নিজস্ব অর্থায়নে নির্মিত বাংলাদেশের সক্ষমতার প্রতীক আলোকজ্জ্বল পদ্মা সেতু প্রত্যক্ষ করে যেন সব পাওয়ার আনন্দে মেতে উঠেছিল লাখ লাখ মানুষ। সবার হৃদয়ে-মননে, স্লোগানে ছিল একই আওয়াজÑ ‘ইয়েস! উই মেইড ইট।’ ষড়যন্ত্র হয়েছে, বাধা এসেছে, তাতে কী! পদ্মা সেতু নিয়ে অসাধ্যকে সাধন করে বিশ্ববাসীকে দেখিয়ে দিলেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাÑ বাংলার মানুষ কারও কাছে মাথা নত করতে জানে না। পদ্মা সেতু জাতির কাছে নিছক কোন স্থাপন নয়; এটা বাংলাদেশের সক্ষমতার প্রমাণ, বাঙালীর গর্ব, অহঙ্কার ও ষড়যন্ত্রকারীদের দাঁতভাঙ্গা জবাব দেয়ার ঐতিহাসিক স্থাপনা। আর এ কারণেই সারাদেশের মানুষের মধ্যেও ছিল এক অন্যরকম অনুভূতি, অনুষ্ঠানে উপস্থিত থেকে ঐতিহাসিক এক মুহূর্তের সাক্ষী হতে আসা লাখ লাখ মানুষের উত্তাল জনসমুদ্রে দাঁড়িয়ে বঙ্গবন্ধৃুকন্যা শেখ হাসিনার কণ্ঠে শুনলেন জাতীয়-আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্র মোকাবেলা করে স্বপ্নের পদ্মা সেতু নির্মাণের ঘটনাবলীর কথা। মাদারীপুরের শিবচরের কাঁঠালবাড়ির বাংলাবাজার ইলিয়াস আহমেদ চৌধুরী ফেরিঘাট প্রান্তে বেলা সাড়ে ১১টায় জনসভা শুরু হওয়ার কথা থাকলেও ফজরের নামাজের পর থেকেই খ- খ- মিছিল নিয়ে জনসভাস্থলে আসতে থাকেন। সড়ক ও নৌপথে, বাসে, লঞ্চ-ফেরির মাধ্যমে দক্ষিণ ও দক্ষিণ পশ্চিমাঞ্চলের ২১ জেলা থেকে লাখ লাখ আওয়ামী লীগের নেতাকর্মী ও সাধারণ জনগণ স্বতঃস্ফূর্তভাবে জনসভায় যোগদান করেন। বাদ্য যন্ত্র, ব্যান্ড পার্টি, পদ্মা সেতু প্রতিকৃতি ব্যানার এবং অসংখ্য স্লোগান বুকে গেঁথে মানুষের ¯্রােত জনসভাস্থল দিকে ছিল। বেলা ১১টার আগেই ১৫ একর এলাকার জনসভাস্থল কানায় কানায় মানুষে পূর্ণ হয়ে যায়। ঠাঁই না পেয়ে অনেকের জনসভাস্থল থেকে ৫ কিলোমিটার দূর রাস্তায় দাঁড়িয়ে প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্য শোনেন। দুপুর ১টা ৯ মিনিটে যখন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সভাপতির ভাষণ দেন তখন জনসভাস্থল থেকে ৫ কিলোমিটার দূরে পাঁচ্চর এলাকা পর্যন্ত মানুষের ভিড় দেখা যায়। কখনও রোদ, কখনও বৃষ্টি এমন বিরূপ পরিবেশ থাকলেও উপস্থিত লাখো মানুষের মুখে ছিল বাঁধ ভাঙ্গা উচ্ছ্বাস। ১৫ কিলোমিটার এলাকাজুড়ে জনসভার মাইক লাগানো হয়। বিভিন্ন জায়গা ও গুরুত্বপূর্ণ বাজারগুলোতে বসানো হয় এলিডি মনিটর। সেখানে সরাসরি দেখানো হয় প্রধানমন্ত্রীর ভাষণ। শিবচরের পাঁচ্চর এক্সপ্রেস হাইওয়ে থেকে জাজিরা পর্যন্ত শুধু মানুষ আর মানুষ। দেশের ইতিহাসে নিজস্ব অর্থায়নে সর্ববৃহৎ অবকাঠামো স্বপ্নের পদ্মা সেতুর নির্মাণের রূপকার বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনাকে এক নজর দেখতে আসেন বরিশালের অশীতিপর বৃদ্ধ কোরবান আলী। তিনি বলেন, ‘শেখ সাহেব (জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান) আমাদের স্বাধীনতা দিয়েছেন, আর শেখের বেটি শেখ হাসিনা পদ্মা সেতু নির্মাণ করে আমাদের আজন্ম দূরদর্শা থেকে মুক্তি দিলেন। তাঁর সার্বিক মঙ্গল ও সুস্বাস্থ্য কামনা করি। দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের ২১ জেলায় আজ ছিল ঈদ আনন্দ। এক সেতু উদ্বোধন ঘিরে মানুষের যে মহোৎসব তা নিজের চোখে না দেখলে অনেকের বিশ^াস হবে না। মহাৎসবের এই আয়োজনে খুলনা থেকে এসেছিলেন রবীন্দ্র চন্দ্র দাস। প্রতিক্রিয়ায় তিনি বলেন, দক্ষিণাঞ্চলের মানুষ আমরা দীর্ঘদিন অবহেলিত ছিলাম। একটি সেতুর জন্য আমাদের ঢাকায় যেতে একদিন লেগে যেত। পথে কত বিড়ম্বনা, আশঙ্কা। আর আমাদের প্রমত্তা পদ্মার পাড় হতে ফেরি লাগবে না, ঘণ্টার পর ঘণ্টা অপেক্ষা করতে হবে না। এখন আমরা সহজেই পার হতে পারব, এটা বঙ্গবন্ধুর কন্যা জননেত্রী শেখ হাসিনার অবদান। আমরা হৃদয় নিংড়ানো ভালবাসা জানাতেই উপস্থিত হয়েছি। এত দূর আসা কষ্ট হলেও তা মনে হচ্ছে না। কারণ আজ দক্ষিণাঞ্চলের মানুষের জন্য আশীর্বাদের দিন। স্বপ্নপূরণে মহোৎসবের আয়োজনে পদ্মার দু’পাড়ের মানুষ মেতে উঠেছিল এক অন্যরকম বিজয়োৎসবে। পদ্মা সেতুর উদ্বোধন আর জনসভাকে ঘিরে বর্ণিল সাজে সেজেছিল প্রমত্তা পদ্মা নদীর দু’পাড়। পুরো এক্সপ্রেসওয়ে অসংখ্য ফেস্টুন দিয়ে সজ্জিত করা হয়। ফরিদপুরের ভাঙ্গা থেকে পদ্মা সেতুর জাজিরা প্রান্তের টোল প্লাজা পর্যন্ত এক্সপ্রেসওয়ে হাজার হাজার ফেস্টুনে ভরে গেছে। তোরণ, ফেস্টুন ছাড়াও ঘাট ও আশপাশ এলাকায় পোস্টার, ব্যানার, বড় আকৃতির ফেস্টুনের ছড়াছড়ি। এক্সপ্রেসওয়েতে ছয় হাজারের বেশি ফেস্টুন, কয়েক হাজার বড় বড় ব্যানার টানানো হয়েছিল মাওয়া, শিবচর, মাদারীপুর ও শরীয়তপুরের সর্বত্র। বিভিন্ন সড়কের ডিভাইডার, জনসভাস্থলসহ দুপাশের কয়েক কিলোমিটার এলাকাতে করা হয় বর্ণাঢ্য আলোকসজ্জা। এক কথায় শত ষড়যন্ত্রের বেড়াজাল ছিন্ন করে বাঙালী জাতির অহঙ্কারে সর্ববৃহৎ স্থাপনা পদ্মা সেতুর উদ্বোধন অনুষ্ঠানে এক অন্যরকম আনন্দ-উৎসবে মেতে উঠেছিল দু’পাড়ের লাখ লাখ মানুষ। শত শত বর্ষ ধরে যে দক্ষিণবঙ্গের ২১টি জেলার মানুষকে তীব্র খর¯্রােতা পদ্মা সেতু পাড়ি দিতে সীমাহীন দুর্ভোগ, জীবনের সঙ্গে লড়াই করতে হয়েছে। সেই ২১টি জেলার মানুষের সীমাহীন দুর্ভোগের দিন শেষ হয়ে গেল পদ্মা সেতুর উদ্বোধনের মাধ্যমে। তাই পদ্মা সেতুকে ঘিরে এক অন্যরকম আনন্দ-উৎসবে মেতে উঠেছিল দীর্ঘদিন অবহেলিত এই ২১টি জেলার মানুষ। তাই স্বপ্নের পদ্মা সেতুর উদ্বোধন উপলক্ষে আয়োজিত জনসভায় খুলনা, বাগেরহাট, যশোর, সাতক্ষীরা, নড়াইল, কুষ্টিয়া, মেহেরপুর, চুয়াডাঙ্গা, ঝিনাইদহ, মাগুরা, বরিশাল, ভোলা, পটুয়াখালী, বরগুনা, ঝালকাঠি, গোপালগঞ্জ, ফরিদপুর, মাদারীপুর, শরীয়তপুর ও রাজবাড়ী এই ২১টি জেলা থেকে মানুষের ঢল ছিল উল্লেখ করার মতো।
×