ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

এক মাসে নতুন আক্রান্ত ২০ হাজার ২৭৮ জন

ফের চোখ রাঙাচ্ছে ॥ জ্যামিতিক হারে বাড়ছে করোনা

স্বপ্না চক্রবর্তী

প্রকাশিত: ২৩:৩৪, ৩০ জুন ২০২২

ফের চোখ রাঙাচ্ছে ॥ জ্যামিতিক হারে বাড়ছে করোনা

গত ৭ দিনের করোনা পরিস্থিতি

জ্যামিতিক হারে বাড়ছে করোনামাসের শুরুতে অর্থা ১ জুন যেখানে আক্রান্তের সংখ্যা ছিল মাত্র ৩৪ জন সেখানে মাস শেষে ২৯ জুন শনাক্তের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ২ হাজার ১৮৩ জনেপরীক্ষার বিপরীতে ০.৬৩ শতাংশ হার মাস শেষে পৌঁছাল ১৫.২৩ শতাংশেমাসের এক তারিখ থেকে ৩০ তারিখ পর্যন্ত ভাইরাসটিতে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যু হয়েছে ১৮ জনেরআর পুরো মাসে ভাইরাসটিতে নতুন করে আক্রান্ত হয়েছেন ২০ হাজার ২৭৮ জনএ অবস্থায় চিন্তার ভাঁজ পড়েছে সংশ্লিষ্টদের কপালেএখনি সতর্ক না হলে পরিস্থিতি আবারও ভয়াবহ হওয়ার আশঙ্কা করছেন তারাএমন অবস্থায় আবারও বিধিনিষেধে কড়াকড়ি আসতে পারে বলে আভাস পাওয়া গেছেইতোমধ্যে করোনা চিকিসায় আবারও হাসপাতালগুলোকে প্রস্তুত করা হচ্ছে বলে জানা গেছে

স্বাস্থ্য অধিদফতরের করোনা বিষয়ক নিয়মিত সংবাদ বিজ্ঞপ্তিগুলো পর্যালোচনায় জানা যায়, জুনের প্রথম দিন দেশে করোনা আক্রান্তের সংখ্যা ছিল মাত্র ৩৪ জনএ দিন শনাক্তের হার ছিল ০.৬৩ শতাংশপ্রায় একই ধারাবাহিকতা বজায় ছিল ২, , , , ৬ জুন পর্যন্তপর্যায়ক্রমে এই দিনগুলোতে শনাক্তের সংখ্যা ছিল ২২, ২৯, ৩১, ৩৪ ও ৪৩ জনশনাক্তের হারও থাকে ১ শতাংশের নিচেইকিন্তু ৭ জুন শনাক্তের সংখ্যা ছাড়ায় ৫০ এর ঘরএদিন ভাইরাসটিতে নতুন করে শনাক্ত হয় ৫৪ জনশনাক্তের হার বাড়ে ১.১৪ শতাংশেএই ধারাবাহিকতা বজায় থাকে ৮, , ১০, ১১ জুন পর্যন্তএই দিনগুলোতে শনাক্তের সংখ্যা ১ জনের নিচে থাকলেও ১২ জুন শনাক্ত হন ১০৯ জনশনাক্তের হার ছাড়ায় ২ শতাংশএরপর উর্ধমুখী গতিতেই বাড়তে থাকে করোনার সংক্রমণ১৩ জুন এক লাফে শনাক্তের সংখ্যা দাঁড়ায় ১২৮ জনে১৪ জুন নতুন করে শনাক্ত হয় ১৬২ জনশনাক্ত হার লাফিয়ে বাড়ে ৩.৫৬ শতাংশে১৫ জুনও শনাক্ত হয় ২৩২ জনএদিন শনাক্তের হার হয় ৩.৮৮ শতাংশ৩৫৭ জন শনাক্ত হয় ১৬ জুন১৭ জুন শনাক্তের হার ছাড়িয়ে ৬ শতাংশের উপরেএদিন নতুন করে আক্রান্ত হয় ৪৩৩ জনশনাক্ত হার দাঁড়ায় ৬.২৭ শতাংশকিছুটা কমে ১৮ জুনএদিন শনাক্ত হয় ৩০৪ জনতবে ১৯ জুন আবারও বাড়ে শনাক্তের সংখ্যাএদিন ভাইরাসটিতে নতুন করে আক্রান্ত হয় ৫৯৬ জনআর শনাক্তের হার বেড়ে দাঁড়ায় ৭.৩৮ শতাংশে২০ জুন শুধু শনাক্তই বাড়েনি বরং ১ জনের মৃত্যুর খবরও জানায় স্বাস্থ্য অধিদফতরএদিন নতুন করে ৮৭৩ জনের শনাক্তের পাশাপাশি শনাক্তের হার দাঁড়ায় ১০ দশমিক ৮৭ শতাংশে

এরপর জ্যামিতিক হারে বাড়তেই থাকে সংক্রমণ২১ জুন নতুন করে ৮৭৪ জন শনাক্তের পাশাপাশি মৃত্যু হয় ১ জনের২২ জুনও মৃত্যুবরণ করেন ১ জনআক্রান্তের সংখ্যা ছাড়ায় হাজারের ঘরএদিন ভাইরাসটিতে নতুন করে আক্রান্ত হন ১ হাজার ১৩৫ জনআর শনাক্তের হার দাঁড়ায় ১৩ দশমিক ৩০ শতাংশএকইভাবে ২৩ জুন মৃত্যু হয় ১জনের, নতুন শনাক্ত ১ হাজার ৩১৯ জনশনাক্তের হার ছাড়ায় ১৪ শতাংশএক লাফে শনাক্তের সংখ্যা ১৬শছাড়ায় ২৪ জুন তারিখেএদিন নতুন করে শনাক্ত হয় ১ হাজার ৬৮৫ জনশনাক্তের হার গিয়ে পৌঁছায় ১৫ দশমিক ০৭ শতাংশে২৫ তারিখ নতুন করে শনাক্ত হন ১ হাজার ২৮০ জন, মৃত্যু হয় ৩ জনের২৬ তারিখও বাড়ে শনাক্তের সংখ্যাএদিন শনাক্ত হয় ১ হাজার ৬৮০ জনমৃত্যুবরণ করেন ২ জন২ হাজার ১০১ জন আক্রান্ত হওয়ার পাশাপাশি ১ জনের মৃত্যু হয় ২৭ জুনমৃত্যুর সংখ্যা বাড়ে ২৮ তারিখএদিন ভাইরাসটিতে আক্রান্ত হয়ে ৩ জনের মৃত্যু হয়নতুন শনাক্ত হয় ২ হাজার ৮৭ জনশনাক্তের হার বেড়ে পৌঁছায় ১৫ দশমিক ৪৭ শতাংশযা ২৯ জুন অর্থা বুধবারও অব্যাহত থাকেএদিন ভাইরাসটিতে নতুন করে কারও মৃত্যু না হলেও আক্রান্তের সংখ্যা বাড়ে ২ হাজার ২৪১ জনআর শনাক্তের হার দাঁড়ায় ১৫ দশমিক ২৩ শতাংশে৪ জনের মৃত্যু হয় ৩০ জুন অর্থা বৃহস্পতিবারএদিন নতুন করে আরও শনাক্ত হন ২ হাজার ১৮৩ জনআর শনাক্তের হার গিয়ে পৌঁছে ১৫ দশমিক ৭০ শতাংশেএতে করে শুধু জুন মাসে ভাইরাসটিতে নতুন করে আক্রান্ত হয়েছেন ২০ হাজার ২৭৮ জনআর এর আক্রমণে মৃত্যু হয়েছে ১৮ জনের

যখন উর্ধমুখী এ শনাক্তের হার তখন এ নিয়ে চিন্তার কথা জানালেন স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেকতিনি জনকণ্ঠকে বলেন, আমরা কিছুটা চিন্তিততবে পরিস্থিতি মোকাবেলায় প্রস্তুত আছিহাসপাতালগুলো রোগীদের চিকিসায় প্রস্তুতসংক্রমণ রোধে গত সপ্তাহে আমরা সভা করেছিসেখানে কিছু প্রস্তাবনা দিয়েছিলামঅফিস, স্কুলে মাস্ক পরে যাবেনট্রেনে-বাসে মাস্ক পরতে হবেগত সপ্তাহে এ বিষয়ে অনুরোধ করেছিকেবিনেটসহ বিভিন্ন জায়গায় চিঠি দিয়েছিজনগণ এই নির্দেশনা পালন করবে বলে প্রত্যাশা করছিগত দু-তিনদিন ধরে দুতিনজন করে মারা যাচ্ছেনসবার প্রতি আহ্বান, আপনারা মাস্ক পরুন, টিকা নিনতিনি বলেন, করোনা সংক্রমণের হার গত ১৫ দিন অনেক কম ছিলএখন অনেক বেশিএটার লাগাম টেনে ধরতে চাই, তবে আমাদের একার পক্ষে সম্ভব নয়জনগণের সচেতনতা ও মাস্ক পরিধান করা জরুরীসেটি হলে অনেকটা নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হবেমাস্ক না পরলে শাস্তির বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, মাস্ক পরিধান করতে নির্দেশনা দিয়েছিএকটি চিঠি মন্ত্রিপরিষদ থেকে দেয়া হয়েছেআমাদের সুপারিশ থাকে মাস্কটা শাস্তি দিয়ে নয়, আহ্বান করব সবাই মাস্ক পরবেতবুও ব্যত্যয় ঘটলে সরকার ব্যবস্থা নিতে দ্বিধা করবে না

তবে প্রয়োজনে আবারও স্বাস্থ্যবিধি মানতে কড়াকড়ি আরোপ করা হতে পারে জানিয়ে কোভিড-১৯ প্রতিরোধে গঠিত জাতীয় কারিগরি কমিটির সদস্য অধ্যাপক ডাঃ ইকবাল আর্সলান জনকণ্ঠকে বলেন, একটা পর্যায়ে আমরা দেখছিলাম করোনা কি সুন্দর নিয়ন্ত্রণে চলে এসেছিলকিন্তু যেই স্বাস্থ্যবিধিতে একটু শিথিলতা দেয়া হলো তখনই আবার সংক্রমণ বাড়তে শুরু করলএ অবস্থায় স্বাস্থ্যবিধিতে আবারও কড়াকড়ি আরোপ করতেই হবেঅন্যথায় আগের মতো বিপজ্জনক পরিস্থিতি তৈরি হতেই পারে

স্বাস্থ্যবিধিতে কড়াকড়ির কথা বললেন স্বাস্থ্য অধিদফতরের মুখপাত্র অধ্যাপক ডাঃ নাজমুল ইসলামওজনকণ্ঠকে তিনি বলেন, করোনার এই উর্ধমুখী প্রবণতা রোধে গত ১৪ তারিখে কি কি করণীয় বিষয়ে সব কর্তৃপক্ষকে চিঠি দিয়েছিমাস্ক পরিধানসহ স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলতে আমরা সবাই পরামর্শ দিয়ে যাচ্ছিকিন্তু মাঠ পর্যায়ে সবাই যদি স্বাস্থ্যবিধি মেনে না চলে তাহলে বিপদের কারণে হয়ে দাঁড়াবেতিনি বলেন, আমাদের অনেক চিকিসক আক্রান্ত হচ্ছেন চিকিসা দিতে গিয়েযদি এ ধারাবাহিকতা অব্যাহত থাকে তাহলে চিকিসা ব্যবস্থায়ও একটা ভয়ঙ্কর পরিস্থিতি তৈরি হতে পারেতাই নিজে মাস্ক পরতে হবে অন্যকে মাস্ক পরা নিয়ে সচেতন করতে হবেএর বিকল্প নেই

এদিকে রাজধানীর কোভিড ডেডিকেটেড হাসপাতাল-গুলোতে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, মাসের শুরুতে হাসপাতাল-গুলোতে রোগীর সংখ্যা কম থাকলেও দিন বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে বাড়ছে রোগীওডিএনসিসির কোভিড ডেডিকেটেড হাসপাতালে প্রতিদিনই রোগী ভর্তি বাড়ছে জানিয়ে হাসপাতালটির পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল এ কে এম শফিকুর রহমান জনকণ্ঠকে বলেন, জুনের শুরুতে যদিও আমাদের এখানে রোগীর সংখ্যা একেবারেই কম ছিলকিন্তু মাসের মাঝামাঝি থেকে রোগীর সংখ্যা বাড়তে থাকেএখনও বাড়তিই আছেএ অবস্থা চলতে থাকলে আমাদের চিকিসার পরিধি আরও বাড়াতে হবেতবে রোগী যদি বাড়ে তাহলে চিকিসা দেয়ার জন্য আমাদের সব ধরনের প্রস্তুতি রয়েছে

একই কথা বলেন রাজধানীর ২৫০ শয্যাবিশিষ্ট টি বি হাসপাতালের সহকারী পরিচালক ডাঃ আয়েশা আক্তারজনকণ্ঠকে তিনি বলেন, মানুষের জীবনযাত্রা স্বাভাবিক হয়ে যাওয়ায় মানুষ আর স্বাস্থ্যবিধি মানছে নাএমনকি মাস্কও ব্যবহার করছে নাআর এতে করেই বাড়ছে করোনাতবে এতে ভয়ের কোন কারণ নেইসঠিক নিয়মে মাস্ক ব্যবহার করার পাশাপাশি স্বাস্থ্যবিধিগুলো মেনে চললে পরিস্থিতি আবারও নিয়ন্ত্রণে আসবে বলেই আমি মনে করি

হাসপাতালে ৫০টি শয্যা করোনা রোগীদের চিকিসায় অব্যবহৃত অবস্থায়ই রাখা হয়েছে জানিয়ে শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিক্যাল কলেজ এ্যান্ড হাসপাতালের পরিচালক অধ্যাপক ডাঃ খলিলুর রহমান জনকণ্ঠকে বলেন, এখন প্রতিদিনই রোগী বাড়ছেতাই যদি রোগী বাড়ে শয্যার সংখ্যাও আরও বাড়ানো হবে

 

তবে মানুষজনের মধ্যে সচেতনতা তৈরি না হলে আবারও বিধিনিষেধে কড়াকড়ি আরোপ করা হতে পারে বলে জনকণ্ঠকে জানিয়েছেন স্বাস্থ্য অধিদফতরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ডাঃ আবুল বাশার মোহাম্মদ খুরশীদ আলমতিনি বলেন, দেখেন গত ছয় মাসে আমরা ভাইরাসটিকে মোটামুটি নিয়ন্ত্রণে নিয়ে এসেছিলামএকটা সময় মনে হচ্ছিল ভাইরাসটি বুঝি পুরোপুরিই চলে যাবেতখন মানুষের মধ্যেও সচেতনতা ছিল চোখে পড়ার মতোকিন্তু যেই সব বিধিনিষেধ শিথিল করা হলো সেই থেকে মানুষের মধ্যে সচেতনতাও উধাওমানুষজন এখন মাস্কও ব্যবহার করে নাসামাজিক দূরত্ব বজায় রাখা তো দূরে থাককিন্তু এভাবে যদি সংক্রমণ বাড়তে থাকে তাহলে আমাদের আবারও বিধিনিষেধে কড়াকড়ি আরোপ করা ছাড়া আর কোন উপায় থাকবে নাআর কিছু না হোক অন্তত মাস্ক ব্যবহার অবশ্যই করতে হবেআমাদের টিকাদান কর্মসূচীও চলছে পুরোদমেইতোমধ্যে প্রথম ডোজ এবং দ্বিতীয় ডোজের কার্যক্রম আমরা গুছিয়ে এনেছিএখন বুস্টার ডোজের ওপর জোর দেয়া হচ্ছেএমন অবস্থায় শুধু মানুষের সচেতনতার অভাবে যদি সংক্রমণ আবারও বাড়ে তাহলে দুঃখের কোন সীমা থাকবে নাতিনি সাধারণ মানুষসহ গণমাধ্যমের প্রতি আহ্বান জানান, করোনার সংক্রমণ এড়াতে নিজেকে যেমন স্বাস্থ্যবিধি মানতে হবে তেমনি পাশের মানুষকেও স্বাস্থ্যবিধি মানতে উদ্বুদ্ধ করতে হবে

×