ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

নদী খননে জোর দেয়ার তাগিদ পরিবেশ মন্ত্রীর

হাওড়কে রক্ষা করার জন্য সব করা হবে : পানি সম্পদ উপমন্ত্রী

প্রকাশিত: ২০:৩৭, ৪ জুলাই ২০২২

হাওড়কে রক্ষা করার জন্য সব করা হবে : পানি সম্পদ উপমন্ত্রী

গোলটেবিল বৈঠকে পানি সম্পদ উপমন্ত্রী

সিলেটসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে ঘন-ঘন বন্যা হচ্ছে। বিশেষ করে সিলেট, সুনামগঞ্জ ২০১৭, ২০১৮ এবং ২০১৯ সালের পর চলতি বছরেই পরপর তিনটি বন্যার কবলে পড়েছে। পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতের চেরাপুঞ্জীতে অতিবৃষ্টি, নদ-নদীগুলোর নাব্যতা হারানোসহ খাল-বিল ভরাটের কারণেই এমনটি হচ্ছে বলে মত সংশ্লিষ্টদের। কিন্তু আন্ত:দেশীয়, আন্তর্জাতিক নানা কারণে আপাত: বন্যা সমস্যার স্থায়ী কোনো সমাধান নেই বলে মন্তব্য করেছেন পরিকল্পনা মন্ত্রী এম এ মান্নান।

তবে এক্ষেত্রে পুনর্বাসনে জোর দেয়ার আশ্বাস দিয়েছেন তিনি। এদিকে বন্যা নিয়ন্ত্রণে যেসব নদী ভরাট হয়ে গেছে সেগুলো খনন করা দরকার বলে মন্তব্য করেছেন পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রী মো. শাহাব উদ্দিন। আর হাওড়কে রক্ষা করার জন্য যা কিছু করা দরকার সব কিছুই করা হবে বলে মন্তব্য করেছেন পানি সম্পদ উপমন্ত্রী একেএম এনামুল হক শামীম।

সোমবার (৪জুন) রাজধানীর জাতীয় প্রেসক্লাবের তোফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়া মিলনায়তনে সিলেট বিভাগ সাংবাদিক সমিতি-সিবিসাস আয়োজিত ‘সিলেট অঞ্চলে ঘন-ঘন বন্যা : কারণ, পূনর্বাসন ও স্থায়ী সমাধান শীর্ষক গোলটেবিল আলোচনায় প্রধান অতিথির বক্তব্যে তিনি এ কথা বলেছেন। সিবিসাসের সভাপতি আজিজুল পারভেজের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠানে বিশেষ অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী মো. শাহাব উদ্দিন, প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী ইমরান আহমেদ, পানি সম্পদন মন্ত্রণালয়ের উপমন্ত্রী এ কে এম এনামুল হক শামীম। এছাড়াও আলোচনায় অংশ নেন পদ্মা সেতু প্রকল্প বিশেষজ্ঞ প্যানেল : ইমেরিটাস অধ্যাপক ও স্টামফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য ড. এম ফিরোজ আহমেদ, বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতির (বেলা) প্রধান নির্বাহী সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান, বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা) সাধারণ সম্পাদক শরীফ জামিলসহ আরও বিশেষজ্ঞরা।

এসময় ধারণাপত্র পাঠকালে সংগঠনের ক্রীড়া সম্পাদক এহসানুল হক জসীম বলেন, জুনের মাঝামাঝিতেই সিলেট অঞ্চলের বন্যা অতীতের সব রেকর্ড ছাড়িয়ে যায়। মাত্র কয়েকদিনের ব্যবধানে আবারও পানিবন্দি হয়ে পরে সিলেট অঞ্চলের মানুষজন। দুই জেলার যথাক্রমে ৮০ ভাগ ও ৯০ ভাগ এলাকা বন্যা কবলিত হয়। ৪০ লাখ মানুষ হয় পানিবন্দি। ৩০ জুন পর্যন্ত ১৫ থেকে ১৬ দিনের ব্যবধানে সিলেট নগরীসহ এই জেলার ১৩ টি উপজেলায় ক্ষতিগ্রস্থ হয় প্রায় পাঁচ লাখ পরিবার। কাঁচা ঘরবাড়ি ভেঙে ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে ৪০ হাজারেরও বেশি। আশ্রয়কেন্দ্রে আশ্রয় নেয় আড়াই লাখের বেশি মানুষ। ২ জুলাই পর্যন্ত ৩৭ হাজারেরও বেশি লোক আশ্রয়কেন্দ্রে ছিলেন জানিয়ে তিনি বলেন, বন্যায় বাড়িছাড়া মানুষের সংখ্যা আরও বেশি। যারা স্বজনদের বাসা-বাড়িতে উঠেছিলেন তারা হিসেবে আসেননি। মস্য অধিদফতর সিলেটের তথ্য অনুযায়ী এই বিভাগে ২৯ জুন পর্যন্ত কেবলই মস্যখাতে ক্ষতির পরিমাণ ১৪২ কোটি টাকার বেশি।

সুনামগঞ্জের বন্যায় ক্ষয়ক্ষতির হিসাব তুলে ধরে জসিম বলেন, সুনামগঞ্জে বন্যায় সড়কের ক্ষতিই হয়েছে প্রায় ১৮শ কোটি টাকা। এর মধ্যে ৩৯৪ কিলোমিটার সড়ক, ১৫৫টি সেতু-কালভার্টের সংযোগ ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে। সুনামগঞ্জের জেলা প্রশাসনের প্রতিবেদন অনুযায়ী, এই জেলার ১১ উপজেলায় ৪৫ হাজারের বেশি ঘরবাড়ি ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে। পাঁচ হাজার সম্পূর্ণ, ৪০ হাজার আংশিক। ২৫ হাজার পুকুরের মাছ ভেসে গেছে। দেড় হাজার গবাদিপশু মারা গেছে ২৯ হাজারের মতো মুরগী আর ৯৮ হাজারের মতো হাঁস মারা যায়। বন্যায় মৌলভীবাজার ও হবিগঞ্জে ক্ষয়-ক্ষতি সাধিত হয়েছে। মৌলভীবাজার জেলা প্রশাসনের তথ্য অনুযায়ী, ৫৮ হাজারেরও বেশি পরিবার ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে। আর কাঁচা ঘরবাড়ি বিধ্বস্ত হয়েছে ১৪ হাজারের বেশি। হবিগঞ্জ জেলা প্রশাসনের তথ্য অনুযায়ী, ২৪ হাজারের বেশি পরিবার ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। আর ঘরবাড়ি বিধ্বস্ত হয়েছে প্রায় ৭০টি।

এ পরিস্থিতি একদিনে সিলেট অঞ্চলে তৈরি হয়নি উল্লেখ করে বিশেষজ্ঞদের বক্তব্যে সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান বলেন, বৈশ্বিক জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে অস্বাভাবিক বৃষ্টিপাত ভবিষ্যতে আরও বাড়বে। আমরা নানাভাবে নদ-নদীকে নিয়ন্ত্রণ করতে চাচ্ছি। অপরিকল্পিত উন্নয়নের ফলে পানি প্রবাহ বাঁধাগ্রস্থ হচ্ছে। সিলট্যাশন হচ্ছে, নদীর পানির ধারণ ক্ষমতা কমছে। গঙ্গা-ব্রহ্মপুত্র-মেঘনা বদ্বীপের একটি বড় অংশজুড়ে বাংলাদেশের অবস্থান। বাংলাদেশে নদীভাঙন, নদীর গতি-প্রকৃতি পরিবর্তন, নদীতে পলি পড়া, চর জেগে ওঠা আবার বিলীন হয়ে যাওয়া এবং প্রতিবছর বন্যা হওয়া অনেকটাই প্রকৃতির স্বাভাবিক নিয়মের অংশ। নদীর গতিপথ পরিবর্তন সাধারণত একটি ধীর প্রক্রিয়া।

তবে প্রবল বন্যা ও ভূমিকম্প অল্প সময়ের মধ্যে অনেক বড় নদীরও গতি-প্রকৃতিতে ব্যাপক পরিবর্তন আনতে পারে। বাংলাদেশে বন্যার কারণ নানাবিধ। যেমন পর্যাপ্ত পানি নিষ্কাশনের ব্যবস্থা ছাড়া নগরায়ণ, উজানে ও অববাহিকায় বৃষ্টিপাতের ফলে নদীর পাড় উপচে বা বেড়িবাঁধ ভেঙে প্লাবনভূমিতে পানি প্রবেশ, দক্ষিণ এবং দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে জোয়ার বা জলোচ্ছ্বাসের সময় বাঁধ ভেঙে লোনাপানি ঢুকে পড়া, সড়ক ও বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধের জন্য পানিপ্রবাহের স্বাভাবিক পথ রোধ হওয়া ইত্যাদি। বন্যা ও জলাবদ্ধতার যে কারণগুলো মানুষের সৃষ্টি, তার সমাধান কঠিন হলেও অসম্ভব নয়। বন্যা সমস্যা সমাধানের জন্য স্থানীয় সরকার, নাগরিক ও ব্যবসায়িক গোষ্ঠী, নগর পরিকল্পনাকারী এবং বিভিন্ন সরকারি এজেন্সি ও বিভাগের সঙ্গে বিজ্ঞান, প্রকৌশল, গণিত, পরিসংখ্যান, অর্থনীতি এবং সমাজবিজ্ঞানবিষয়ক বিশেষজ্ঞদের সৃজনশীল চিন্তাভাবনা ও অংশীদারত্ব অপরিহার্য। তবে যেহেতু বৃষ্টি বা পার্শ্ববর্তী দেশের বন্যা পরিস্থিতির নিয়ন্ত্রণ করা আমাদের হাতে নেই তাই এক্ষেত্রে বন্যা সমস্যার স্থায়ী সমাধান একটু কঠিনই। এক্ষেত্রে লস এন্ড ড্যামেজ তথা পুনর্বাসনে জোর দিতে হবে।

এর প্রেক্ষিতে পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নান বলেন, গত ৩০-৩৫ বছরে হাওড়ে যে উন্নয়ন হয়েছে তার অনেক ক্ষতি করেছে বন্যা। বন্যায় ক্ষতি হয় বলে হাওড়ের উন্নয়ন বন্ধ করে দেব এটা হতে পারে না। হাওড়ের মানুষও উন্নত জীবনযাপনের অধিকারী ও অংশীদার। শিগগিরই সিলেট-সুনামগঞ্জে পুনর্বাসন কার্যক্রম শুরু করা হবে। তিনি বলেন, বিনামূল্যে বীজ ও সার ক্ষুদ্র চাষিদের মাঝে প্যাকেট করে বিতরণ করা হবে। হাওড়ের বাসিন্দাদের যাদের কাঁচা ঘর তাদের সিমেন্টের খুঁটি ও মেঝে পাকা করে দিতে পারলে ক্ষয়ক্ষতি কমবে।

মন্ত্রী বলেন, একাত্তর সালে সিলেট সুনামগঞ্জের রাস্তা পাকিস্তানিরা বন্ধ করতে না পারলেও এবারের বন্যা তা পেরেছে। তবে আশার কথা হচ্ছে, অন্যান্য সময় হাওড়ের বন্যায় মানুষ মুখ ফিরিয়ে নিলেও এবছর সরকার পৌঁছার আগেই মানুষ ত্রাণ নিয়ে হাওড়বাসীর পাশে দাঁড়িয়েছে। কারণ মানুষের অর্থনৈতিক অবস্থার পরিবর্তন হয়েছে, সক্ষমতা বেড়েছে, গড় আয় বেড়েছে। বন্যায় সুনামগঞ্জের সব সড়কের ক্ষতি হয়েছে, গ্রামের রাস্তাগুলো নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে।

এসময় বিশেষ অতিথির বক্তব্যে পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রী মো. শাহাব উদ্দিন বলেন, যেসব নদী ভরাট হয়ে গেছে সেগুলো খনন করা দরকার। সিলেটের সুরমা কুশিয়ারা নদী ও হাওড়ের যেসব এলাকা ভরাট হয়ে গেছে সেগুলো জরুরি ভিত্তিতে খনন করা হবে। বন্যা থেকে বাঁচতে হলে ভরাট হওয়া সারাদেশের নদ-নদীগুলো খনন করতে হবে। এছাড়া পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষায় বেশি বেশি গাছ রোপণ করতে হবে।

এর আগে আলোচনায় পানি সম্পদ উপমন্ত্রী একেএম এনামুল হক শামীম বলেন, হাওড়কে রক্ষা করার জন্য যা কিছু করা দরকার সব কিছুই করা হবে। ইতিমধ্যে সিলেট অঞ্চলে ২ হাজার কোটি টাকার প্রকল্প হাতে নিয়েছি। আরও ৩ হাজার ২০০ কোটি টাকার প্রকল্প হাতে নেয়ার পরিকল্পনা আছে। এই পরিকল্পনা বাস্তবায়ন হলে জনগণের জানমালের আর কোন ক্ষতি হবে না। আপাতত বন্যার অবনতি হওয়ার কোন সম্ভাবনা নেই। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা শিক্ষকের ন্যায় বন্যা দুর্যোগকেও মোকাবিলা করেছেন।

বিশেষ অতিথির বক্তব্যে প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রী ইমরান আহমেদ বলেন, কেউই কল্পনা করেনি এতো বড় বন্যা হবে, তাই সরকারকে এককভাবে দোষ দেয়া যায় না। অসংখ্য সমাজসেবী ও মানবসেবী মানুষ বন্যার্তদের সহায়তা করেছে। আমি মনে করি এরাই বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সোনার মানুষ। বন্যা আগামী বছর আবারও আসতে পারে তাই বন্যা মোকাবিলায় এখন থেকেই প্রস্তুতি নিতে হবে। যারা ত্রাণ দিচ্ছেন তাদের বলব, এখন ত্রাণ দেওয়ার চেয়ে পুনর্বাসন জরুরি তাই পুনর্বাসনের জন্য অর্থ সংগ্রহ ও সংরক্ষণ করুন।

 

×