পশুবাহী গাড়িতে চাঁদা দাবির
ঈদ-উল-আজহা উপলক্ষে কোরবানির পশুবাহী নৌযান ও ট্রাকে চাঁদাবাজি বন্ধ, দেশব্যাপী নিরাপত্তা জোরদার, পশুর হাটে কঠোর নিরাপত্তা, চামড়া পাচার রোধ, সড়ক-মহাসড়কে যানজট নিরসন, নৌযান ও ফেরিঘাটে সুশৃঙ্খল ব্যবস্থাপনাসহ আইনশৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণে কঠোর পদক্ষেপ নিয়েছে সরকার। স্থল পথ ও জল পথের পশুবাহী যানবাহনে চাঁদাবাজি বন্ধে নজরদারি করাসহ পশুবাহী গাড়িতে চাঁদা দাবিসহ কোন অভিযোগ এলেই কঠোর শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করবে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী।
পশুবাহী প্রত্যেকটি ট্রাকে হাটের নামফলক টানানো এবং কেউ জোর করে যাতে পথে কোন হাটে পশু নামাতে না পারে সেজন্য কঠোর ভূমিকা পালন করবে প্রশাসন। ঈদ-উল-আজহা উপলক্ষে সড়ক-মহাসড়কে পশু পরিবহনের জন্য যাতে যানজট সৃষ্টি না হয় সেদিকে খেয়াল রাখার নির্দেশ দেয়া হয়েছে। পথে পথে চাঁদাবাজি, হাটে অতিরিক্ত মাসুল আদায়, বন্যা ও পশু খাদ্যের মূল্য বৃদ্ধির কারণে এবার কোরবানির ঈদে পশুর দাম ব্যাপকভাবে বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কা প্রকাশ করেছে গোয়েন্দা সংস্থা।
সরকারের নীতি নির্ধারক মহলে দেয়া গোয়েন্দা সংস্থার প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, দ্রুত এ ব্যাপারে পদক্ষেপ নেয়া না হলে জনগণকে অতিরিক্ত দামে কোরবানির পশু কিনতে হবে বলে সতর্ক করা হয়েছে। পাশাপাশি চামড়া নিয়েও কিছু সঙ্কটের কথা বলা হয়েছে গোয়েন্দা সংস্থার প্রতিবেদনে।
জানা গেছে, বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ে পাঠানো ওই গোয়েন্দা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, গত পাঁচ মাসে বাজারে সব ধরনের পশু ও পোল্ট্রি খাদ্যের দাম ৩০ থেকে ৪০ শতাংশ পর্যন্ত বেড়েছে। ফলে পশু পালনে খামারিদের ব্যয় অনেক বেড়েছে। এতে আসন্ন ঈদ-উল-আজহার কোরবানির পশুর দাম বাড়তে পারে। এতে কোরবানির পশুর বাজারে অস্থিরতা দেখা দিতে পারে।
বাজার তদারকির মাধ্যমে পশু খাদ্যের জোগান নিশ্চিত করা এবং দাম সহনীয় পর্যায়ে রাখা না গেলে কোরবানির বাজারে পশুর অপ্রতুলতা দেখা দিতে পারে। একই সঙ্গে বলা হয়েছে, কোরবানির পশু পরিবহনে বিভিন্ন স্থানে চাঁদাবাজি হয়, স্থায়ী ও অস্থায়ী হাটের মালিকেরা অযৌক্তিক হাসিল আদায় করে। এসব বন্ধেও সুপারিশ করা হয়েছে।
বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের একজন কর্মকর্তা গোয়েন্দা প্রতিবেদন পাওয়ার কথা স্বীকার করে বলেছেন, ওই প্রতিবেদনের ভিত্তিতে আমরা দ্রুতই ব্যবস্থা গ্রহণ করব। একজন উপসচিব রিপোর্টটির পর্যালোচনা করছেন বলে জানান তিনি। তবে এবার পশু সঙ্কট হবে না, সেটা মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয় থেকে তো আগেই বলা হয়েছে। অন্যগুলো কিভাবে ব্যবস্থাপনা হবে সেগুলো আমরা দেখছি।
পাশাপাশি চাঁদাবাজিসহ অন্য বিষয়গুলো স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় দেখবে। ওই গোয়েন্দা প্রতিবেদনে চামড়ার কথাও বলা হয়েছে। চামড়া সংরক্ষণে যাতে সঙ্কট না হয়, সে জন্য আমরা শিল্প মন্ত্রণালয়কে দেড় লাখ টন লবণ আমদানির অনুমতি দিয়েছি। চামড়া পরিবহনেও যাতে সঙ্কট না হয় সেটাও আমরা দেখব।
গোয়েন্দা সংস্থার প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, করোনা মহামারী, বিভিন্ন দেশে পশু খাদ্যের কাঁচামালের উৎপাদন কমে যাওয়া এবং রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে সরবরাহ বাধাগ্রস্ত হওয়ার কারণে সামগ্রিকভাবে পশু খাদ্যের দাম বেড়েছে। পশু খাদ্যের অন্যতম উপাদান হচ্ছে গম, ভুট্টা, ধানের কুঁড়া, সয়ামিল, সরিষার খৈল, আটা-ময়দা প্রভৃতি। এর মধ্যে বাংলাদেশের পশু খাদ্য উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানগুলো গম, ভুট্টা ও সয়ামিল বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে আমদানি করে। রাশিয়া ও ইউক্রেন থেকে বেশি ভুট্টা আমদানি করেন বাংলাদেশের ব্যবসায়ীরা।
আবার গম আমদানিতেও এ দুটি দেশের ওপর নির্ভরতা রয়েছে বাংলাদেশের। কিন্তু যুদ্ধের কারণে গত ফেব্রুয়ারির পরে দেশ দুটি থেকে আমদানি এক প্রকার বন্ধ রয়েছে। ফলে এক বছরের বেশি সময় ধরে এসব পণ্যের দাম বাড়ছে। বেড়েছে পরিবহন খরচও। যে কারণে পশু খাদ্য উৎপাদন খরচও বেড়েছে।
প্রাণিসম্পদ অধিদফতরের একজন কর্মকর্তা জানিয়েছেন, এ বছর কোরবানিযোগ্য এক কোটি ২১ লাখ ২৪ হাজারের বেশি গবাদি পশু প্রস্তুত রয়েছে। গত বছর এক কোটি ১৯ লাখ গবাদি পশু প্রস্তুত ছিল, তার মধ্যে প্রায় ৯১ লাখ গবাদি পশু কোরবানি হয়েছে। এ বছর চলাচলে কোন বিধিনিষেধ না থাকায় গত বছরের চেয়ে কোরবানি বেশি হবে বলে আমরা আশা করছি।
এবার কোরবানিযোগ্য পশুর মধ্যে গরু-মহিষ রয়েছে ৪৬ লাখ, ছাগল-ভেড়া রয়েছে ৭৫ লাখ এবং অন্যান্য পশু রয়েছে ১৪ হাজার। ফলে পশুর সঙ্কট হবে না। কোরবানির পশু এবার চাহিদার চেয়ে অতিরিক্ত পশু প্রস্তুত আছে। ফলে কোরবানির জন্য কোন রকম সংশয়, সঙ্কট বা আশঙ্কার কারণ নেই। সরকারের পক্ষ থেকে পরিপূর্ণ প্রস্তুতিও রয়েছে। তবে সিলেট-সুনামগঞ্জসহ বিভিন্ন অঞ্চলে সাম্প্রতিক বন্যায় গবাদি পশু কিছুটা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। সেখানে প্রাণিসম্পদ অধিদফতর থেকে গবাদি পশুর খাবার সরবরাহ করা হচ্ছে, চিকিৎসাসেবা দেয়া হচ্ছে।
বাংলাদেশ ডেইরি ফার্মারস এ্যাসোসিয়েশনের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, সুনির্দিষ্ট কিছু প্রস্তাব করা হয়েছে প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ে। এসব প্রস্তাবের মধ্যে আছে পশুবাহী ট্রাক দ্রুত চলাচলের ব্যবস্থা করতে হবে। এসব ট্রাক থেকে যাতে চাঁদাবাজি না হয় সে উদ্যোগ নিতে হবে। কোন খামার থেকে যদি কেউ পশু কেনেন, তাদের কাছ থেকে কোন মাসুল আদায় করা যাবে না। আমরা যে হাটে পশু নিতে চাইব সেখানে নেয়ার সুযোগ দিতে হবে। অনেক ইজারাদার জোর করে তাদের হাটে খামারিদের ট্রাক নিয়ে যান।
দাম নিয়ন্ত্রণে রাখতে পশুবাহী ট্রাকগুলো টোলমুক্ত করার প্রস্তাব দেয়া হয়েছে। গত এক বছরে পশু খাদ্যের দাম প্রায় ৪০ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে, যার কারণে এবার গরুর দাম ১০ থেকে ১৫ শতাংশ এমনিতেই বাড়বে যদি পরিস্থিতি স্বাভাবিক থাকে। আর চাঁদাবাজিসহ অন্যান্য খরচ বাড়লে তো পশুর দাম আরও বেড়ে যাবে।
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একজন কর্মকর্তা বলেছেন, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী কর্তৃপক্ষের উচ্চ পর্যায়ের সঙ্গে একাধিকবার বৈঠক হয়েছে। পশুবাহী পরিবহন যাতে দ্রুত চলাচল করতে পারে সে পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে। প্রতিটি হাটে পুলিশের ক্যাম্প থাকবে। হাটের জায়গা নির্দিষ্ট করে দেয়া হবে। হাসিলের চার্ট টানানো থাকবে। থাকবে জাল টাকা শনাক্ত করার যন্ত্রও।
পুলিশ সদর দফতরের একজন কর্মকর্তা জানিয়েছেন, ঈদ উপলক্ষে সন্ত্রাসী, চাঁদাবাজ, অজ্ঞান পার্টি, মলম পার্টি প্রতিরোধে বিশেষ ট্রাস্কফোর্স কাজ করবে। ঈদের আগেই গার্মেন্টসহ শিল্প কারখানার শ্রমিক-কর্মচারীদের বেতন বোনাস পরিশোধ করতে মালিকদের নির্দেশ দেয়া হবে। ঈদ যাত্রায় যাতে ভিড়ের বাড়তি ভোগান্তি পোহাতে না হয় সেজন্য ব্যবস্থা গ্রহণ করা হচ্ছে।
এবারের পশুবাহী ট্রাক, ট্রলার ও যানবাহনে যাতে চাঁদাবাজি বন্ধ, পশুর হাঠে জোরপূর্বক পশু নামানো, অতিরিক্ত হাসিল আদায় করতে না পারে সেজন্য আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করার নির্দেশ দেয়া হয়েছে বলে পুলিশ কর্মকর্তার দাবি।