ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

পোশাকের কারণে হেনস্তা!

প্রকাশিত: ০০:০৫, ২৪ মে ২০২২

পোশাকের কারণে হেনস্তা!

একটি স্বাধীন দেশে সব মানুষই তার নাগরিক অধিকার নিয়ে বেঁচে থাকে। সেখানে পছন্দমতো চলাফেরা, পোশাকের ধরন নির্বাচন থেকে শুরু করে রুচিসম্মত এবং শালীনভাবে জীবন কাটানো এক প্রকার সচেতনতা। মানুষের সংস্কৃতি, রুচি তার জীবনাচরণ কোন নির্দিষ্ট সমাজ ব্যবস্থার আলোকেই সংহত হয়। শুধু তাই নয় এসব যাপিত জীবনের অনুষঙ্গগুলো এক প্রকার অভ্যাসে পরিণত হওয়াও নিত্য নৈমিত্তিক কর্মযোগ। আবার সামাজিক বিভাজনও মানুষের অধিকারের মাত্রাকে নিয়ন্ত্রণ করলেও আইনী বিধানে সবাই সমান সুযোগ ও স্বাধীনতা পাওয়া বাঞ্ছনীয়। সমাজে শুধু বিত্ত কিংবা মর্যাদার ফারাকই নয় নারী-পুরুষের বৈষম্যও দৃষ্টিকটুভাবে দৃশ্যমান। আমরা বাঙালী। একটি সংস্কৃতিবান, রুচিশীল জাতি। আমাদের প্রতিদিনের জীবন প্রবাহে তার নজির স্পষ্ট। তবে আধুনিকতার নির্মাল্যে যেমন আমরা এগিয়ে যাই পাশাপাশি ঐতিহ্যিক ধ্যান-ধারণা ও প্রতিনিয়ত প্রাণিত করে। কোন দেশ নিজস্ব কৃষ্টি, সংস্কৃতিকে যেমন ধারণ করে তেমনি বিশ্বজনীনতার বৈশিষ্ট্যেও উজ্জীবিত হয়। যেমন জ্ঞান চর্চায়, খাদ্যাভ্যাসে এমনকি পোশাক পরিচ্ছদেও। সেখানে যেমন নিজের ব্যক্তিগত রুচি বিদ্যমান একইভাবে বিশ্বায়নের কিছু বিষয়ও আমরা নিতে পারি। সেটা অবশ্যই আমার সংস্কৃতির বেড়াজালে শালিনতা ও রুচিকে প্রাধান্য দিয়েই। গত বুধবার ১৮ মে নরসিংদীর রেল স্টেশনে এক তরুণীর পোশাক পরিচ্ছদকে অবমাননা করে ভীষণভাবে নাজেহাল করার চিত্র সত্যিই দুঃখজনক। কারণ অন্যের ব্যক্তিগত অধিকার ও রুচির ওপর আঘাত করার স্বাধীনতা আসলে কারোরই নেই। অন্যের পছন্দে আমার আস্থা নাই থাকতে পারে কিন্তু সেজন্য তাকে অসম্মান কিংবা মারধর করার সামন্যতম অধিকারও কারও থাকে না। কয়েকজনের অযাচিত হস্তক্ষেপে যখন কোন বিধি বিধানের তোয়াক্কা করে না সেখানে অত্যাচারির শাস্তি পাওয়া একান্ত জরুরী। লাঞ্ছনার শিকার তরুণীটি ঢাকার একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী। নরসিংদী এসেছিলেন জামালের মাখানো মুড়ি খেতে। সঙ্গে দুই পুরুষ বন্ধুও ছিল। মেয়েটির ওপর প্রথম চড়াও হয় অন্য দুই নারী। তাদের আপত্তি তরুণীটির পরনে জিনসের প্যান্ট এবং টপস ছিল। আমাদের এখন অনেক বাঙালী তরুণী শার্ট, প্যান্ট, ফতুয়া, টপস এসব পরে থাকেন। শুধু তাই নয় বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, কর্পোরেট পেশায় কিংবা কোথাও বেড়াতে যাওয়া নয়ত শপিংমলে জিনিসপত্র কিনতে মেয়েরা এখন আরামদায়ক এবং স্বাচ্ছন্দ্য পোশাক হিসেবে শার্ট, প্যান্ট, ফতুয়া কিংবা টপসকেই বিবেচনায় আনছে। পোশাক নিয়ে এমন অপ্রীতিকর ঘটনা নিকট অতীতে না ঘটলেও টিপ পরার কারণে এক নারীকে হেনস্তা হতে হয়েছে। সমাজ ব্যবস্থার কারণে নারীরা বিভিন্নভাবে নির্যাতন, নিপীড়নের শিকার হয় এটা অস্বীকার করার কোন পথ নেই। তবে পোশাকের জন্য প্রকাশ্যে দিবালোকে এমন হেনস্তা একটি স্বাধীন, সার্বভৌম দেশে সত্যিই অচিন্তনীয়। তাও আবার অন্য দুই নারীর দ্বারা। দেশে বহু নারী বোরকা পরেন, কিন্তু অন্য নারীর ওপর চড়াও হন না। এমনতরও ন্যক্কারজনক দুঃসহ ঘটনার সহিংস হোতারা যেন কোনভাবেই পার পেয়ে না যায়। হিজাব কিংবা বোরখা এসব নিয়েও তো কোন আপত্তি চলেই না। যে পোশাক পরে, রুচি এবং ইচ্ছে অতি আবশ্যিকভাবে তারই পছন্দ অনুযায়ী হবে। তবে লক্ষণীয় যাতে শালিনতাকে ছড়িয়ে না যায়। যদিও বা যায়, সেখানেও গায়ে হাত তোলার অধিকার কিন্তু কারওই থাকে না। প্রয়োজনে ভদ্রভাবে পরামর্শ দেয়া যেতে পারে। তরুণীটি সেভাবে অশালীন পোশাক মোটেও পরিধান করেননি। তিনি একটি মানসম্মত বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী। রুচিসম্মত পছন্দ এবং মাত্রাজ্ঞান স্বাভাবিকভাবেই তার আছে। বাঙালী নারী হিসেবে মূলত শাড়ি, সালোয়ার কামিজ এবং এখন শার্ট প্যান্টও পরে থাকে উদীয়মান তরুণীরা। সেটা তেমন বিসদৃশ্য কিছুই নয়- যার কারণে তরুণী ও তার বন্ধুটিকে অসহনীয় হেনস্তার শিকার হতে হবে। শেষ পর্যন্ত তরুণীটি ৯৯৯ তে ফোনকল করে এমন বিপন্ন অবস্থা থেকে বের হয়ে আসতে পেরেছে। কষ্টকর, বেদনাদায়ক এই দুঃসহ ঘটনার যাতে পুনরাবৃত্তি না হয় তেমন দৃষ্টান্তমূলক বিচার কার্যক্রম অত্যন্ত জরুরী। শুধু তাই নয়, সংশ্লিষ্ট তরুণীটি মানসিকভাবে ভেঙ্গে পড়েছেন। তাকে মানবিক দায়বদ্ধতায় সুস্থির অবস্থায় নিয়ে আসাও আবশ্যক। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে এই দুঃসহ চিত্র ছড়িয়ে পড়লে দোষী ব্যক্তিদের নজরে নিয়ে আসার কার্যক্রম ডিবি পুলিশের হাতে চলে যায়। সিসিটিভির ফুটেজও মুঠোফোনে ধারণ করা ভিডিও চিত্রের মাধ্যমে ইসমাইল ইসলাম নামে এক ব্যক্তিকে পুলিশ আটক করে। অন্য দুইজন অত্যাচারী নারীকেও আটক করার প্রচেষ্টা অব্যাহত রয়েছে। ভিডিও চিত্রে আরও দৃশ্যমান হয় তরুণিটিকে কয়েকজন ঘিরে ধরে তার পোশাক নিয়ে আপত্তিকর মন্তব্য এবং উত্তেজিত হয়ে কথা বলার প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। ভুক্তভোগীদের পক্ষে কেউই মামলা দায়ের করেননি। আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীও মনে করছেন এমন জঘন্য অপরাধকে কোনভাবেই মানা যায় না আর উচিতও নয়। নারীদের পোশাক পরিচ্ছদ নিয়ে বিব্রতকর অবস্থায় পড়ার দৃশ্য মাঝে মধ্যেই গণমাধ্যমে উঠে আসে। তবে ন্যক্কারজনক এই লাঞ্ছনা এবারই প্রথম। এর সুষ্ঠু তদন্ত ও আইনী ব্যবস্থাপনায় অপরাধীদের শাস্তি প্রদান অনিবার্য দাবি। আদালতের নির্দেশে ডিবি পুলিশ মামলা দায়ের করার সংবাদ স্বস্তিদায়ক। তবে তাৎক্ষণিক ও দ্রুত বিচার আইনে মামলা পরিচালনা করাও কর্তৃপক্ষের দায়বদ্ধতা। অপরাজিতা প্রতিবেদক
×