ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

দুজনকে হাতছানি দিচ্ছে আরও মাইলফলক

দুর্দান্ত ব্যাটিংয়ে বিশ্বরেকর্ড মুশফিক-লিটনের

প্রকাশিত: ২৩:৫২, ২৪ মে ২০২২

দুর্দান্ত ব্যাটিংয়ে বিশ্বরেকর্ড মুশফিক-লিটনের

মোঃ মামুন রশীদ ॥ অবিশ্বাস্য এক কীর্তিই গড়েছেন মুশফিকুর রহিম আর লিটন কুমার দাস। মিরপুর শেরেবাংলা জাতীয় ক্রিকেট স্টেডিয়াম ব্যাটারদের জন্য চিরাচরিত ভয়াল রূপে আবির্ভূত হয়েছে সকালের প্রথম ৪০ মিনিট। বিভীষিকাময় পরিস্থিতিতে পতিত হয় বাংলাদেশ। এরপর সেই ধ্বংসস্তূপে দাঁড়িয়ে ২৫৩ রানের অবিচ্ছিন্ন জুটি গড়ে দ্বিতীয় টেস্টের প্রথম দিন শেষ করেন মুশফিক-লিটন। তাই শুরুতে বিপর্যস্ত বাংলাদেশ দল স্বস্তিতে মাথা উঁচিয়ে মাঠ ছেড়েছে ৫ উইকেটে ২৭৭ রান নিয়ে। দুজন জোড়া সেঞ্চুরি হাঁকিয়েছেন মাত্র ২৪ রানেই বাংলাদেশ ৫ উইকেট হারানোর পর। এত কম রানে ৫ উইকেট হারিয়ে টেস্ট ইতিহাসে আর কখনও জোড়া সেঞ্চুরি হাঁকাতে পারেনি কোন দল। তাই মিরপুর এবং বাংলাদেশ-শ্রীলঙ্কা লড়াইয়ের গণ্ডি ছাড়িয়ে রীতিমতো জুটির বিশ^রেকর্ড হয়েছে। ষষ্ঠ উইকেটে এটি এখন পর্যন্ত বাংলাদেশের সেরা জুটি। টানা দ্বিতীয় টেস্টে শতক হাঁকিয়ে মুশফিক ও ক্যারিয়ারের তৃতীয় শতক হাঁকিয়ে লিটন অপরাজিত থেকে বড় সংগ্রহের পথ দেখিয়েছেন বাংলাদেশকে। আরও কিছু ব্যক্তিগত ও জুটির রেকর্ড হাতছানি দিচ্ছে তাদের। মিরপুরে যে কোন উইকেটে সেরা জুটির কাতারে এখুনি মুশফিক-লিটন যা করেছেন তার স্থান তিনে, যদি আজ আর ৪৪ রান যোগ করতে পারেন দুজন, সেটি হবে মিরপুরে যে কোন উইকেটে সর্বোচ্চ রানের জুটি। ১১৫ রানে অপরাজিত থেকে ৩৪তম ব্যাটার হিসেবে ঘরের মাটিতে ৩ ফরমেট মিলিয়ে ৭ হাজার রান পূর্ণ করেছেন মুশফিক। টেস্টে ঘরের মাটিতে প্রথম বাংলাদেশী হিসেবে ৩ হাজার রান ছুঁতে তার ৩৮ রান প্রয়োজন আর। তবে চট্টগ্রামের পর মিরপুরেও সর্বাধিক রানের মালিকও হয়ে গেছেন। ১৩৫ রানে অপরাজিত লিটন আর ৪৭ রান করতে পারলেই ২ হাজার রান পূর্ণ করবেন। শুরুটা তারা করেছেন এক বিভীষিকাময় অবস্থার মধ্যে দাঁড়িয়ে। কারণ ৪০ মিনিটের মধ্যেই ব্যাটারদের অসহায়ত্বে ব্যাকফুটে চলে যায় বাংলাদেশ ২৪ রানে ৫ উইকেট হারিয়ে। টস জিতেই আগে ব্যাটিং নেয় বাংলাদেশ একাদশে ২ পরিবর্তন নিয়ে। নাঈম হাসানের পরিবর্তে প্রায় ৩ বছর পর অলরাউন্ডার মোসাদ্দেক হোসেন এবং বাঁহাতি পেসার শরিফুল ইসলামের বদলে এবাদত হোসেন জায়গা করে নেন। লঙ্কানরা লাসিথ এম্বুলদেনিয়ার পরিবর্তে বাঁহাতি স্পিনার প্রাভীন জয়াবিক্রমাকে দলে টেনেছে। ব্যাটিং শুরুর পর মাহমুদুল হাসান জয় ইনিংসের দ্বিতীয় বলে আর ইনিংসের দশম বলে তামিম ইকবাল সাজঘরে ফিরেছেন শূন্য রানে। অধিনায়ক মুমিনুল হক টানা ব্যর্থতার বৃত্ত ভাঙতে পারেননি, আউট হন ৯ রানে। নাজমুল হোসেন শান্ত ৮ এবং সাকিব আল হাসান ক্যারিয়ারে দ্বিতীয়বারের মতো ‘গোল্ডেন ডাক’ (প্রথম বলেই আউট) এর শিকার হন। লঙ্কান দুই পেসার কাসুন রাজিথা আর আসিথা ফার্নান্দোর তোপে এমন দুর্বিষহ অবস্থার পর মুশফিক ও লিটন প্রতিরোধ গড়েন। সেই প্রতিরোধের দেয়ালে আটকা পড়ে স্তিমিত হয়ে যায় লঙ্কান বোলারদের দাপট। ক্রমেই প্রতিপক্ষ বোলারদের ওপর ছড়ি ঘোরাতে শুরু করেন এ দুই মিডলঅর্ডার। চট্টগ্রামে তারা ১৬৫ রানের জুটি গড়েছিলেন চতুর্থ উইকেটে। এবার তারা ষষ্ঠ উইকেটে একতাবদ্ধ হয়ে আর কোন বিপদ হতে দেননি, প্রথম সেশনে আরও ৪২ রান যোগ করেন। লাঞ্চ বিরতির পর মুশফিক-লিটন জুটি দুর্দান্ত ব্যাটিংয়ে লঙ্কান বোলারদের গলদঘর্ম করতে থাকেন। দুজনই অর্ধশতক পেরিয়ে যান। চা বিরতি পর্যন্ত কোন উইকেট না হারিয়ে দুজন যোগ করেন ৩০ ওভারে আরও ৮৭ রান। চা বিরতির পরে ক্রমেই দুজন সেঞ্চুরির পথে এগিয়ে যান। আর এই দুর্দান্ত ইনিংস খেলার পথে দুজন কোন সুযোগই দেননি লঙ্কান বোলারদের। লিটন কিছুটা দ্রুত ছিলেন মুশফিকের তুলনায়। চট্টগ্রাম টেস্টের প্রথম ইনিংসেও দুজন চতুর্থ উইকেটে জুটি বেঁধে ১৬৫ রান করে সেঞ্চুরির কাছাকাছি পৌঁছেন। কিন্তু লিটন ৮৮ রানে সাজঘরে ফিরে যান। দ্বিতীয়বার শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে সেঞ্চুরি হাতছাড়া করেন। কিন্তু এবার আর ভুল করেননি। ক্যারিয়ারের তৃতীয় ও শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে প্রথম সেঞ্চুরির দেখা পান তিনি মাত্র ১৪৯ বলে। তার অনেকক্ষণ পরেই টানা দ্বিতীয় টেস্টে শতক হাঁকান মুশফিকও। ক্যারিয়ারের নবম এই সেঞ্চুরি মুশফিক হাঁকালেন ২১৮ বল খেলে। শেষ পর্যন্ত দুজন মিলে নির্বিঘেœ দিন শেষ করেছেন। চা বিরতির পর আর হতে দেননি কোন বিপদ। শেষ সেশনে ৩২ ওভারে আরও ১২৪ রান যোগ করেছেন তারা স্বাচ্ছন্দ্যে ব্যাট চালিয়ে। দিনশেষে মুশফিক ২৫২ বলে ১৩ চারে ১১৫ রানে এবং লিটন ২২১ বলে ১৬ চার, ১ ছয়ে ১৩৫ রানে অপরাজিত আছেন। দুজনের সেঞ্চুরির পাশপাাশি হয়েছে অবিশ^াস্য কিছু রেকর্ড। ২৫ রানের মধ্যে ৫ উইকেট হারিয়ে ফেলার পর দুজনের অবিচ্ছিন্ন এই ২৫৩ রান টেস্ট ইতিহাসে সেরা। এর আগে ২৫ রানের ভেতর ৫ উইকেট হারিয়ে সর্বোচ্চ ৮৬ রানের জুটি গড়তে পেরেছিলেন পাকিস্তানের ওয়ালিস ম্যাথিয়াস ও সুজাউদ্দিন বাট। সেটি ১৯৫৯ সালে ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে। আশ্চর্যজনকভাবে সেই জুটিও হয়েছে ঢাকায় (ঢাকা স্টেডিয়াম)। তারা সেদিন ২২ রানে ৫ উইকেট হারিয়েছিল। এছাড়া বাংলাদেশের পক্ষে নিজেদের সেরা ষষ্ঠ উইকেট জুটির রেকর্ডও গড়েছেন মুশফিক-লিটন। এর আগে ষষ্ঠ উইকেটে বাংলাদেশের সেরা জুটি ছিল শ্রীলঙ্কার বিপক্ষেই ২০০৭ সালে কলম্বোয়। সেবার মোহাম্মদ আশরাফুল আর মুশফিক করেছিলেন ১৯১ রানের জুটি। এই বিপর্যয় ব্যতীত ষষ্ঠ উইকেটে অবশ্য টেস্ট ইতিহাসে সর্বাধিক ৩৯৯ রানের জুটি আছে ইংল্যান্ডের জনি বেয়ারস্টো ও বেন স্টোকসের। তারা ২০১৬ সালে দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে সেই জুটি গড়েন কেপটাউনে। আরেকটি রেকর্ড গড়ার পথে রয়েছেন তারা। জুটিতে ২৯৭ রান হলেই মিরপুরে যেকোন উইকেটে রেকর্ড জুটি হবে। এই ভেন্যুতে সর্বাধিক ২৯৬ রানের অবিচ্ছিন্ন জুটি আছে ওয়েস্ট ইন্ডিজের শিবনারায়ন চন্দরপল ও দিনেশ রামদিনের। ২০১২ সালের নবেম্বরে স্বাগতিকদের বিপক্ষে পঞ্চম উইকেটে এ রান করেন তারা। ১১৫ রানে অপরাজিত থেকে এখন ৩ ফরমেট মিলিয়ে দেশের মাটিতে ৭ হাজার রান পেরিয়েছেন মুশফিক। ৩ ফরমেটে ২০৭ ম্যাচে ২৩২ ইনিংস ব্যাট করে তার রান এখন ৭০১০। বাংলাদেশে তার ওপরে আছেন শুধু তামিম ইকবাল ১৭২ ম্যাচে ২০৪ ইনিংস খেলে ৭০৬৩ রান নিয়ে। আজ আর ৫৪ রান করলেই তাকে ছাড়িয়ে যাবেন মুশফিক। অস্ট্রেলিয়ার সাবেক উইকেটরক্ষক এডাম গিলক্রিস্টকে (১৭৩ ম্যাচে ৬৯৭০) ছাড়িয়ে গেছেন এদিনই। তবে ইতোমধ্যেই চট্টগ্রামের জহুর আহমেদ চৌধুরী স্টেডিয়ামের সেরা রান সংগ্রাহক (১৪০৬ রান) এবার মিরপুরেরও রাজা হয়ে গেছেন। ২২ টেস্টের ৩৮ ইনিংসে এই ভেন্যুতে মুশফিক ১৪১৭ রান করে সবার ওপরে। পেছনে ফেলেছেন তিনি ১৯ টেস্টের ৩৪ ইনিংসে ১৪০৯ রান করা সাকিব আল হাসানকে। ঘরের মাটিতে টেস্টে এখন প্রথম বাংলাদেশী হিসেবে ৩ হাজার রান স্পর্শ করতে ৩৮ রান প্রয়োজন মুশফিকের। ঘরের মাটিতে তিনি করেছেন ৪৭ টেস্টের ৮৩তম ইনিংসে ২৯৬২ রান। লিটনকেও হাতছানি দিচ্ছে ২০০০ রান। আর মাত্র ৪৭ রান করলেই তা হয়ে যাবে এ উইকেটরক্ষক ব্যাটারের। ৩৩ ম্যাচের ৫৫তম ইনিংসে তার রান এখন ১৯৫৩। আজ দ্বিতীয় দিন শুধু তাদের আরও রেকর্ড গড়ার দিকেই নয়, সবার নজর থাকবে বাংলাদেশের সংগ্রহটা কত বড় হয়! সেই ভিত তো গড়েই দিয়েছেন মুশফিক-লিটন।
×