কেন্দ্রীয় ব্যাংক
ইউক্রেন যুদ্ধের জেরে বিশ্ববাজার এখনও অস্থির, এর মধ্যে দেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলে হানা দিয়েছে বন্যা। এমন পরিস্থিতিতে সতর্কতার পথেই হাঁটতে চাইছে বাংলাদেশের আর্থিক খাতের নিয়ন্ত্রক সংস্থা। মূল্যস্ফীতির চাপ সামাল দিতে অর্থের জোগান আরও কমাচ্ছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। রেপো (পুনঃক্রয় চুক্তি) সুদহার আরও এক দফা বাড়িয়ে নতুন অর্থবছরের জন্য ঘোষণা করা হয়েছে ‘সংকোচনমুখী’ মুদ্রানীতি। বৃহস্পতিবার বিকেলে বাংলাদেশ ব্যাংক ২০২২-২৩ অর্থবছরের মুদ্রানীতি ঘোষণা করে গবর্নর ফজলে কবির বলেন, ‘এবার সতর্কতামূলক মুদ্রানীতি ভঙ্গি অনুসরণ করা হয়েছে, যা কিছুটা সংকোচনমুখী।’
মহামারীর কারণে মাঝে দুই বছর মুদ্রানীতি প্রকাশ করা হয়েছিল কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ওয়েবসাইটে, কোন আনুষ্ঠানিকতা ছিল না। এবার আবার পুরনো রীতিতে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রধান কার্যালয়ে সংবাদ সম্মেলন করে মুদ্রানীতি ঘোষণা করেন গবর্নর। তিনি বলেন, ‘টাকার অভ্যন্তরীণ বাহ্যিক মান, অর্থাৎ মূল্যস্ফীতি ও বিনিময় হার ‘স্থিতিশীল রাখা’ হবে নতুন অর্থবছরের জন্য মূল চ্যালেঞ্জ। ২০২২-২৩ অর্থবছরের বাজেটে ঘোষিত সরকারের লক্ষ্যমাত্রার ভিত্তিতে নতুন মুদ্রানীতিতে ব্যাংক ব্যবস্থা থেকে ১ লাখ ৬৩ হাজার কোটি টাকা ঋণ যোগানোর ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। তাতে সরকারী ঋণের প্রবৃদ্ধি ধরা হয়েছে ৩৯.৪ শতাংশ, যা গতবার ৩৬ দশমিক ৬ শতাংশ ছিল। আর বেসরকারী খাতে ঋণ প্রবৃদ্ধি ধরা হয়েছে ১৪.১ শতাংশ, যা গতবার ছিল ১৪ দশমিক ৮ শতাংশ। সব মিলিয়ে মোট অভ্যন্তরীণ ঋণের প্রবৃদ্ধি ধরা হয়েছে ১৮.২ শতাংশ, যা ২০২১-২২ অর্থবছরে ১৭ দশমিক ৮০ শতাংশ র্নিধারণ করা হয়েছিল। এর মানে হল, নতুন অর্থবছরে সরকারী খাতের ওপর ভর করে অভ্যন্তরীণ ঋণ প্রবৃদ্ধি বাড়ানোর পরিকল্পনা নেয়া হয়েছে।
গবর্নর জানান, চাহিদাজনিত মূল্যস্ফীতির চাপ প্রশমনের পাশাপাশি বিনিয়োগ ও কর্মসংস্থান সৃষ্টিকারী খাতে ঋণ সরবরাহ নিশ্চিত করতে এক দিন মেয়াদী রেপোর সুদ হার ৫ শতাংশ থেকে ৫০ বেসিস পয়েন্ট বাড়িয়ে ৫ দশমিক ৫০ শতাংশ করা হয়েছে। এর আগে গত ২৯ মে এই হার ২৫ বেসিস পয়েন্ট বাড়িয়ে ৫ শতাংশ করা হয়েছিল। অর্থাৎ এক মাসের মধ্যে দ্বিতীয় দফা বাড়ানো হল রেপো হার। তবে রিভার্স রেপো হার আগের মতোই ৪ শতাংশ, বিশেষ রেপো হার ৮ শতাংশ এবং ব্যাংক রেট ৪ শতাংশ রাখা হয়েছে। ব্যাংকগুলো যখন কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে ধার করে, তখন তার সুদহার ঠিক হয় রেপোর মাধ্যমে। আর রিভার্স রেপোর মাধ্যমে বাংকগুলো তাদের উদ্বৃত্ত অর্থ কেন্দ্রীয় ব্যাংকে জমা রাখে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংক বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোকে যে সুদ হারে দীর্ঘমেয়াদী ঋণ দেয়, তাকে বলে ব্যাংক রেট। এসব নীতি হারের মাধ্যমে কেন্দ্রীয় ব্যাংক বাজারে তারল্য প্রবাহ আর অর্থনীতির গতিপ্রকৃতি নিয়ন্ত্রণ করে, যাতে বাজেটে ঘোষিত সরকারের লক্ষ্য অনুযায়ী জিডিপি প্রবৃদ্ধির উপযুক্ত আর্থিক পরিবেশ তৈরি হয়, আবার বাজারে পণ্যমূল্যও সহনীয় মাত্রায় রাখা যায়।
সরকার বাজেটে যে নীতি ও উন্নয়ন কর্মসূচী ঠিক করে, তা বাস্তবায়নের জন্য সহায়ক আর্থিক পরিবেশ সৃষ্টি এবং নির্দিষ্ট সময়ে বাজারে অর্থের প্রবাহ ঠিক রাখাই মুদ্রানীতির লক্ষ্য। এমনভাবে এই নীতি সাজানো হয় যাতে অন্তর্ভুক্তিমূলক প্রবৃদ্ধির লক্ষ্য পূরণের পাশাপাশি মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ এবং দারিদ্র্য বিমোচনে সরকারের প্রত্যাশা পূরণ সম্ভব হয়। ২০২২-২৩ অর্থবছরের বাজেট বাস্তবায়নে বছরের পুরো সময়টায় বাজারে অর্থপ্রবাহ ও আঙ্গিক কেমন হবে, তাও মুদ্রানীতিতে ঠিক করে দেয়া হয়।
আগামী অর্থবছরের জন্য মুদ্রানীতিতে ব্যাপক মুদ্রা (এম২) প্রবৃদ্ধি কিছূটা কমিয়ে ধরা হয়েছে ১২.১ শতাংশ, গতবার এ সীমা নির্ধারণ করা হয়েছিল ১৫ শতাংশ; চলতি জুন পর্যন্ত এর ৯.১ শতাংশ অর্জিত হয়েছে। ২০২২-২৩ অর্থবছরের জন্য জাতীয় বাজেটে সরকার মোট দেশজ উৎপাদনে (জিডিপি) ৭.৫ শতাংশ প্রবৃদ্ধি এবং মূল্যস্ফীতি ৫.৬ শতাংশে ধরে রাখার পরিকল্পনা নিয়েছে।