ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১

জুনের মাঝামাঝি বাজারে আসছে হাড়িভাঙ্গা আম

প্রকাশিত: ১৯:১৩, ২৩ মে ২০২২

জুনের মাঝামাঝি বাজারে আসছে হাড়িভাঙ্গা আম

নিজস্ব সংবাদদাতা, রংপুর ॥ অপূর্ব স্বাদ আর গন্ধের কারণে দেশ-বিদেশে প্রসিদ্ধ রংপুরের হাড়িভাঙা আম জুনের মাঝামাঝি বাজারে আসছে । কৃষি বিভাগের নির্দেশনা অনুযায়ী এই আম ১৫ জুন গাছ থেকে পাড়া শুরু হবে। তবে প্রচন্ড গরম থাকলে দু-একদিন আগেও বাণিজ্যিকভাবে বাজারে হাঁড়িভাঙা আম বিক্রি করতে পারবেন আমচাষিরা। কৃষি অফিস বলছে, গত দুই সপ্তাহের ঝড়-বাতাসে আমের কিছুটা ক্ষতি হয়েছে। শেষ পর্যন্ত সব কিছু ঠিক থাকলে শুধু হাঁড়িভাঙা আম বিক্রি করে এ বছর প্রায় ২০০ কোটি টাকার ব্যবসা করতে পারবেন জেলার আমচাষি ও ব্যবসায়ীরা। সঙ্গে গত বছরের মতো এবারও হাঁড়িভাঙা বিদেশে পাঠানোর সুযোগ তৈরির সম্ভাবনা রয়েছে। আমচাষিরা বলছেন, এবার আমের ফলনে কাল হয়ে দাঁড়িয়েছে মাত্রা অতিরিক্ত হরমোন ব্যবহার। প্রতিটি গাছে শুরুতে যে পরিমাণ আমের গুটি ছিল, তা এখন অর্ধেকে নেমেছে। বাগান কেনা ক্ষুদ্র উদ্যোক্তা ও মৌসুমী ফল ব্যবসায়ীদের পরামর্শে গাছের গোড়ায় হরমোন দিয়ে অতিরিক্ত ফলনের আশায় গুড়েবালি হয়েছে। মাত্রাতিরিক্ত কীটনাশকের প্রভাবে ফিকে হতে বসেছে অনেক আমচাষির স্বপ্ন। কম ফলনের জন্য শুধু কীটনাশকই নয় প্রাকৃতির কাছেও অসহায় হাঁড়িভাঙা ঘিরে ঘুরে দাঁড়নোর স্বপ্ন দেখা হাজারো আমচাষি। রংপুরের মিঠাপুকুর ও বদরগঞ্জ উপজেলার চাষিরা জানান, এ মৌসুমে আম গাছে প্রচুর মুকুল এসেছিল। কিন্তু ঘন ঘন বৃষ্টি আর প্রথম দফার ঘূর্ণিঝড়ে মুকুলগুলো ঝরে যায়। দ্বিতীয় দফায় আবারও ঘূর্ণিঝড় ও শিলাবৃষ্টির কারণে গুটি আমেরও একটি অংশ ঝরে যায়। এছাড়া গেল রমজান মাসে রোজা এবং ঈদের ব্যস্ততার কারণে বাগান পরিচর্যায় কিছুটা অবহেলা হয়েছে। সব মিলিয়ে এবার ফলন কম হয়েছে। তবে যারা সঠিক পরিচর্যা করেছেন, সময় মতো ভিটামিন ও কীটনাশক স্প্রে করেছেন তাদের আম ভালো হয়েছে। তারপরও আমের বিপণন ও সংরক্ষণ ব্যবস্থা নিয়ে চিন্তায় রয়েছে চাষিরা। হাঁড়িভাঙা আমের হাটখ্যাত মিঠাপুকুরের পদাগঞ্জের রাস্তাঘাটের বেহাল দশায় দূর-দূরান্তের ক্রেতাদের ভোগান্তির কারণে বাজার ধরতে অনেক কষ্ট পেতে হয় চাষি ও ব্যবসায়ীদের। চলতি মৌসুমে ঘন-ঘন বৃষ্টি হওয়ায় এবার আগাম পাকতে পারে আম । এবার আমের প্রচুর মুকুল গাছে এলেও দফায় দফায় ঘুর্ণিঝড় ও শিলা বৃষ্টির কারণে ফলন কম হয়েছে বলে বলেছেন আম চাষিরা। ফলন ভাল হওয়ায় এ বছর প্রায় ২০০ কোটি টাকার আম বিক্রির আশা স্থানীয় আম চাষিদের। মিঠাপুকুরের পদাগঞ্জের আম বাগানে গিয়ে দেখা যায়, গাছে গাছে সবুজ পাতা ঝুলছে সবুজ আম। বাগানে বাগানে চলছে শেষ সময়ের চলছে আমের পরিচর্চা। কেউ ফলন ও ফলের মান বাড়ানোর স্প্রে করছেন, কেউ কেউ পোকা দমনে স্প্রে করছেন বিভিন্ন ধরনের কীটনাশক। এই আম চাষেই স্বপ্ন দেখছেন আম চাষিরা। গতবারের চেয়ে এবারে ফলন কম হলেও প্রায় সব মিলিয়ে ২০০-২২০ কোটি টাকার আম বেচাকেনা হবে বলে আশা করা হচ্ছে। সেই স্বপ্ন ঘিরেই এখন চলছে এই পাইকারদের কাছে আমের বাগান বেচা-কেনা। ঢাকা-চট্টগ্রামসহ দূর-দূরান্ত থেকে এসেছেন অনেকেই বাগান কেনার জন্য। মৌসুমী আম ব্যবসায়ী কিংবা অনলাইনে যারা কেনাবেচা করেন তারা এসেছেন বাগান দেখার জন্য। অনেকেই বাগান মালিকদের সাথে কথা বলে চূড়ান্ত করছেন হিসেব-নিকেশ। আঁশ বিহীন এবং অত্যন্ত সুমিষ্ট হওয়ায় এই আম মানুষের কাছে অত্যন্ত জনপ্রিয়। শুরুতে রংপুর জেলার মিঠাপুকুর উপজেলার পদাগঞ্জসহ কয়েকটি এলাকায় ব্যপক হাড়িভাঙ্গা আমের চাষ হতো। হাড়িভাঙ্গা আমের জনপ্রিয়তার কারণে এখন রংপুরের বদরগঞ্জ, তারাগঞ্জ, নীলফামারীর সৈয়দপুর, সদর, দিনাজপুরের পার্বতীপুর, খানসামা, চিরিরবন্দরসহ দেশের বিভিন্ন এলাকায় গড়ে উঠেছে এই আমের বাগান। ব্যক্তিগত ও বাণিজ্যিক ভিত্তিতে গড়ে উঠেছে এসব বাগান। তবে, বৈরী আবহাওয়ার কারণে এ বছর এই আমের সাইজ কিছুটা ছোট ও ফলন তুলনামূলকভাবে কম হয়েছে বলে চাষিরা জানিয়েছেন। কম ফলনের কারণ হিসাবে চাষিরা জানান, এ মৌসুমে আম গাছে প্রচুর মুকুল এসেছিল কিন্তু ঘন ঘন বৃষ্টি আর ঘুর্ণিঝড়ে প্রথম দফায় মুকুল গুলো ঝরে যায়। দ্বিতীয় দফায় আবারও ঘুর্ণিঝড় ও শিলাবৃষ্টির কারণে পরবর্তীতে গুটি আমেরও একটি অংশ ঝরে যায়। এছাড়া রমজান মাসে রোজা এবং ঈদের ব্যস্ততায় বাগান পরিচর্চায় কিছুটা অবহেলা হয়েছে। সবমিলিয়ে এবার ফলন কম হয়েছে। তবে যারা সঠিক পরিচর্চা করেছে, সময়মতো ভিটামিন ও কীটনাশক স্প্রে করেছেন তাদের আম ভালো হয়েছে। জেলার মিঠাপুকুর খোড়াগাছ ইউনিয়নের আম চাষি আশরাফুল ইসলাম জানান, এবার ভালোই ফলন এসেছিল কিন্তু অর্ধেক আমই নষ্ট হয়েছে ঘুর্ণিঝড় ও শিলাবৃষ্টির কারণে। এখন অবশিষ্ট আম যাতে সাইজে বড় হয় সেই চেষ্টাই করা হচ্ছে। আম বাজারে আসতে প্রায় এক মাস বাকী আছে। এই এক মাসে পরিচর্চা করে আমের সাইজ বড় করতে পারলে লাভ হবে। এজন্য সরকার নির্ধারিত সময়ে আম বাজারজাত করা দরকার। আম চাষি ছালাম মিয়া জানান, তার বাগানে এবার আমের কম ফলন হয়েছে। তিনি অবশ্য তার পরিচর্চার ঘাটতির কথা স্বীকার করেন। গতবছর ফলনও বাম্পার হলেছিল, লাভও ভালো হয়েছিল, এবার লাভ হবে না। সময় মতো আম বাজারজাত করতে পারলে হয়তো ক্ষতি কম হবে। আম চাষি আব্দুল বারি জানান, প্রায় ৬-৭ বছর ধরে আম চাষ করে আসছেন। সময় মতো পরিচর্চার কারণে ফলন ভালো হয়েছে। তবে ভিটামিন ও কীটনাশকের দাম বাড়ায় এবারে ব্যয় বেশি হয়েছে। আমে সেই অনুযায়ী দাম না পেলে লাভ হবে না। মিঠাপুকুরের পদাগঞ্জের আম চাষি লাবলু জানান, প্রতিবছর তিনি আগাম বাগান বিক্রি করে দেন। এবারেও ১ লাখ টাকায় চট্টগ্রামের এক ব্যবসায়ীর কাছে বিক্রি করে দিয়েছেন। দুটি বাগান নিজেই দেখভাল করছেন। কম ফলন হলেও লাভ হবে বলে তিনি জানান। আম চাষি ও ব্যবসায়ীদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, এ বছর ২০০-২২০ কোটি টাকার আম বিক্রির আশা স্থানীয় আম চাষিদের। তবে আগামীতে আবহাওয়া ভালো থাকলে হাড়িভাঙ্গাসহ বিভিন্ন জাতের আম দেশের চাহিদা মিটিয়ে এবারও বিদেশে রপ্তানি করা সম্ভব হবে। রংপুরের হাড়িভাঙ্গা আম দেশ বিদেশে সরবরাহে এখনই প্লাষ্টিকের ক্যারেট, সুতলি, খাঁচা, পেপারসহ আনুষাঙ্গিক জিনিষের কেনাবেচা শুরু হয়েছে। গতবছরের তুলনায় এবারের এসব প্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের দাম বেড়েছে। গতবছর এসময় বাঙলা ক্যারেট ৭০-৮০ টাকা হলেও এখনই ১০০ টাকা, ভালো মানের ক্যারেট গতবার ৯০-১১০ টাকা হলেও এবার ১২০-১৫০ টাকা। বেড়েছে সুতলী এবং পেপারের দাম। রংপুর কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক ওবায়দুর রহমান মন্ডল বলেছেন, এবার ১ হাজার ৮৮৭ হেক্টর জমিতে আম চাষ হয়েছে। গত বছরের তুলনায় ফলন কম হলেও হেক্টর প্রতি ১২-১৫ টন আম আসবে। জুনের মাঝামাঝি সময়ে বাজারে আসতে শুরু হওয়ার সম্ভাবনা থাকলেও জুনের শেষ সপ্তাহে ভালোভাবেই বাজারে আম পাওয়া যাবে। সরকার নির্ধারিত সময়ের আগে আম বাজারজাত না করার জন্য আম চাষিদের অনুরোধ জানিয়েছেন। কেননা আগাম লাভের আশায় আম বাজারজাত করলে হাড়িভাঙ্গা আমের প্রকৃত স্বাদ পাওয়া যাবে না। তাতে লাভের চেয়ে লোকসান হবে। উপপরিচালক ওবায়দুর রহমান মন্ডল বলেন, আমরা শুরু থেকেই হাঁড়িভাঙা আমের মানসম্মত উৎপাদন নিশ্চিত করতে হরমোন প্রয়োগকে নিরুৎসাহিত করে আসছি। তারপরও গোপনে অনেক চাষি মাত্রা অতিরিক্ত হরমোন ব্যবহার করেছেন। উল্লেখ্য, এটি আঁশবিহীন, মিষ্টি ও অত্যন্ত সুস্বাদু আম। এই আমের আঁটিও খুব ছোট। ছাল পাতলা। প্রতিটি আমের ওজন হয় ২০০ থেকে ৩০০ গ্রাম। মৌসুমের শুরুতে হাঁড়িভাঙার চাহিদা বেশি থাকায় এর দাম কিছুটা বেশি হয়ে থাকে। সেক্ষেত্রে প্রতি কেজি হাঁড়িভাঙা আকার ভেদে ৮০ থেকে ১৫০ টাকা কেজি দরে বিক্রি হতে পারে। গত এক দশকে দেশজুড়ে জনপ্রিয়তা বেড়েছে হাঁড়িভাঙার। সঙ্গে সরকারের পৃষ্টপোষকতায় বিদেশেও রপ্তানির সুযোগ হাতছানি দিচ্ছে। ব্যাপক সমাদৃত হওয়ায় গত বছর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীসহ অনেক রাষ্ট্র নায়ককে হাড়িভাঙ্গা আম উপহার পাঠিয়েছিলেন।
×