ট্রেনের সিডিউল বিপর্যয়
আগামী ১০ জুলাই পবিত্র ঈদ-উল-আজহা। তাই পরিবার পরিজনের সঙ্গে ঈদ করতে মঙ্গলবার থেকে শুরু হয়েছে ঈদযাত্রা। প্রথম দিনে ট্রেনের সিডিউল বিপর্যয় দেখা গেলেও বাস ও লঞ্চে ছিল না ভিড়। আবার কমলাপুর স্টেশনে ট্রেনের অগ্রিম টিকেট বিক্রির শেষ দিনও ছিল মঙ্গলবার। এদিন দেয়া হয় ৯ জুলাইয়ের টিকেট। সকাল ৮টায় শুরু হয় টিকেট বিক্রি।
শেষদিনে বেশ কয়েকটি কাউন্টার সাড়ে ৯টার পরই ফাঁকা হয়ে যায়। ফলে স্টেশন সংলগ্ন এলাকার বেশ কয়েক বাসিন্দা কয়েক মিনিটের মধ্যেই টিকেট কাটতে পেরেছেন। তারা জানিয়েছেন, অনলাইনে জানতে পারেন কাউন্টারে টিকেট আছে। পরে দ্রুত কাউন্টারে এসে টিকেট কাটেন তারা।
ট্রেনে ঈদযাত্রার প্রথম দিন মঙ্গলবার। সকাল থেকে রাজধানীর কমলাপুর রেলস্টেশনে রেলযোগে ঘরে ফেরার আনুষ্ঠানিক যাত্রা শুরু হয়। তবে ঈদযাত্রার প্রথম দিনেই তিনটি ট্রেন দেরিতে ছেড়েছে। এতে যাত্রীদের ভোগান্তি বেড়েছে। এদিন মোট ৩৭টি ট্রেন কমলাপুর থেকে ছেড়ে যায়।
স্টেশনের চিত্রও ছিল অন্য স্বাভাবিক দিনের মতোই। কর্মব্যস্ত অনেকেই পরিবার নিয়ে আগেভাগেই বাড়িতে চলে গেছেন। এ ছাড়া বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীদের বাড়ি যেতে দেখা যায়। এদিন নীলসাগর এক্সপ্রেস ট্রেনটি যায় নীলফামারীর চিলাহাটি। ট্রেনটি ৬টা ৪০ মিনিটে ছাড়ার কথা থাকলেও ১ ঘণ্টা দেরিতে কমলাপুর রেলস্টেশন ছেড়ে যায়। নীলফামারীর সৈয়দপুরে যাওয়ার জন্য অপেক্ষা করা এক যাত্রী জানান, ট্রেনটি ৬টা ৩৪ মিনিটে ছাড়ার কথা থাকলেও ১ ঘণ্টা দেরি করেছে।
জামালপুরের দেওয়ানগঞ্জ বাজারগামী তিস্তা এক্সপ্রেস ট্রেনটি সাড়ে ৭টায় ছাড়ার কথা থাকলেও ৭টা ৫৫ মিনিটে স্টেশনে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা যায় যাত্রীদের। সুন্দরবন এক্সপ্রেসের এক যাত্রী বলেন, পরিবার নিয়ে ঈদ করতে বাড়ি যাচ্ছি। ভোগান্তি যেন না হয় তার জন্যই টিকেট কেটেছি ট্রেনের। কিন্তু প্রথম দিনেই ট্রেন দেরি করে ছাড়ছে।
কমলাপুর রেলওয়ে স্টেশনের ম্যানেজার মোঃ মাসুদ সারোয়ার জানিয়েছেন, স্টেশনে ট্রেন দেরি করে আসায় ট্রেন ছাড়তে দেরি হয়েছে। নির্দিষ্ট সময়ে ট্রেন ছাড়ার সব প্রস্তুতি তাদের রয়েছে।
মঙ্গলবার সকালে ঈদযাত্রার প্রথম দিনেই ট্রেন ছাড়তে দেরি হওয়ার বিষয়ে সাংবাদিকদের তিনি বলেন, সব ট্রেনই সিডিউল অনুযায়ী ছেড়েছে। শুধু রংপুর এক্সপ্রেস, নীলসাগর এক্সপ্রেস, ধূমকেতু এক্সপ্রেস ও সুন্দরবন এক্সপ্রেস কিছুটা দেরিতে ছেড়েছে। ট্রেন বিলম্বে আসায় ছাড়তে দেরি হয়েছে। এটাকে আসলে সিডিউল বিপর্যয় বলা যাবে না। নির্দিষ্ট সময়ে ট্রেন ছাড়ার সব প্রস্তুতি আমাদের রয়েছে।
তিনি বলেন, সোমবার একটি ইঞ্জিন বিকলের ঘটনা ঘটেছে। সে কারণে ট্রেন আসতে দেরি হয়েছে। এখান থেকে ছাড়তেও দেরি হয়েছে। একটা সময় ছিল যখন সকালের ট্রেন বিকেলে, বিকেলের ট্রেন রাত ১২টায় বা পরের দিন এসেছে। এখন সে অবস্থা নেই। আমরা চাই মানুষের ঈদযাত্রা নিরাপদ করতে। সবাই আনন্দ করার জন্যই বাড়ি যাচ্ছে, এতে যেন কোন বিঘ্ন না ঘটে। আমাদের সব ধরনের প্রস্তুতি আছে। অনাকাক্সিক্ষত কোন ঘটনা না ঘটলে বা দুর্ঘটনা না হলে আমরা ঈদযাত্রার বাকি দিনগুলোতে ঠিক সময়েই ট্রেন ছাড়তে পারব।
ঈদে ট্রেন দুর্ঘটনার বিষয়ে তিনি বলেন, অনেকেই ঈদযাত্রায় তাড়াহুড়া করতে গিয়ে দুর্ঘটনার শিকার হন। আমাদের প্রতিটি স্টেশনে বলা আছে যেন যাত্রীরা নিরাপদে নামতে পারে। কেউ যেন ট্রেনের ছাদে উঠতে না পারে। কয়েক মিনিট বিলম্ব হলেও যাত্রীরা যেন নিরাপদে ওঠানামা করতে পারে সে বিষয়টি নিশ্চিত করতে বলা হয়েছে।
স্বাস্থ্যবিধির বিষয়ে তিনি বলেন, করোনার প্রাদুর্ভাব বেড়ে গেছে। আমরা যাত্রীদের বলেছি যেন তারা মাস্ক পরিধান করে। নিজে এবং অন্যদের নিরাপদে রাখে। মাস্ক পরতে উৎসাহিত করার বিষয়ে এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, প্ল্যাটফর্মে প্রবেশ করার সময়ই গেটে যাত্রীদের মাস্ক পরার কথা বলছি। কিন্তু কিছু কিছু বিষয় আছে আমরা বললাম কিন্তু সেটা পরে মানছে কি না। যে সচেতনতা দরকার এটা তারা মানছে কি না এটা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে।
অগ্রিম টিকেট ক্রয় ॥ মঙ্গলবার সকালে কমলাপুর রেলস্টেশনে গিয়ে দেখা যায়, দিনাজপুরগামী দ্রুতযান এক্সপ্রেস, লালমনিরহাটগামী লালমনি এক্সপ্রেস, কুড়িগ্রামগামী কুড়িগ্রাম এক্সপ্রেস এবং পঞ্চরগড়গামী পঞ্চগড় স্পেশাল পঞ্চগড় এক্সপ্রেসের কাউন্টারগুলো প্রায় ফাঁকা। দু’-একজন যারা আসছেন, তারা সঙ্গে সঙ্গে টিকেট পেয়ে যাচ্ছেন। তবে রংপুরগামী রংপুর এক্সপ্রেস ও নীলফামারীগামী নীলসাগর এক্সপ্রেসের কাউন্টারে কিছুটা ভিড় দেখা গেছে।
কাউন্টারে টিকেট আছে-বাসা থেকে অনলাইনে জানতে পেরে দ্রুত কাউন্টারে আসেন জাকির হোসেন। টিকেট কাটা শেষে তিনি বলেন, সকাল থেকে বেশ কয়েকবার অনলাইনে টিকেট কাটার চেষ্টা করেছি। কিন্তু পাচ্ছিলাম না। পরে দেখলাম কাউন্টারে টিকেট রয়েছে। এরই মধ্যে কাউন্টারগুলোতে ভিড় কম জানতে পারি। তাই বাসা কাছে হওয়ায় স্টেশনে চলে আসলাম। এসে দেখি কাউন্টার একেবারেই ফাঁকা। কয়েক মিনিটেই কুড়িগ্রাম যাওয়ার জন্য দুটি টিকেট পেয়ে যাই।
দ্রুতযান এক্সপ্রেসের কাউন্টারে গিয়ে দেখা যায়, লাইন পুরো ফাঁকা। এই কাউন্টারের বুকিং সহকারী নাহিদ সুলতানা বলেন, দ্রুতযান এক্সপ্রেসের টিকেট আছে। অন্যান্য দিনে এ সময় প্রচুর মানুষ থাকে। সকালেও একটু ভিড় ছিল। তবে পর্যাপ্ত টিকেট থাকলেও যাত্রী নেই। ৯ জুলাই রাতের টিকেট আছে আমাদের কাছে। ১০ তারিখ ঈদ, সে জন্য হয়ত অনেকে টিকেট নিচ্ছেন না।
৪২ ঘণ্টার পর টিকেট পেল আবু কাউছার ॥ ঈদযাত্রায় ট্রেনের অগ্রিম টিকেট পেতে ৩ জুলাই দুপুর ২টায় লাইনে দাঁড়ান মোঃ আবু কাউছার। টিকেট না পেয়ে ৪ জুলাইও লাইন ছেড়ে যাননি তিনি। অবশেষে ৪২ ঘণ্টা পর ৫ জুলাই সকালে বহু প্রত্যাশিত ‘সোনার হরিণ’ পান এ যুবক। দীর্ঘ অপেক্ষার পরে টিকেট পেয়ে খুশি কাউছার।
তিনি আরও বলেন, স্ত্রী ও দুই ছেলেমেয়ে নিয়ে রাজধানীর শনিরআখড়ায় থাকেন। গ্রামের বাড়ি দিনাজপুরের হিলিতে বাবা-মা ও ভাই-বোনদের সঙ্গে ঈদ-উল-আজহা উদযাপন করতে পরিবার নিয়ে যাবেন। তাই ট্রেনের অগ্রিম টিকেট পেতে রবিবার দুপুরে লাইনে দাঁড়ান। সোমবার টিকেট বিক্রি শুরু হলেও কাউন্টারে আসার পর পরই শেষ হয়ে যায় দিনাজপুর হয়ে পঞ্চগড়গামী একতা এক্সপ্রেসের টিকেট। ফলে মঙ্গলবার পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হয় তাকে। প্রায় ৪২ ঘণ্টা অপেক্ষার পর সকালে টিকেট পান।
স্বস্তি দৌলততিয়া-পাটুরিয়া রুটেও ॥ ট্রেনে কিছুটা দুর্ভোগ হলেও, সড়ক বা নৌপথে ঈদযাত্রায় একদম ভিড় নেই। নৌপথে দক্ষিণাঞ্চলগামী লঞ্চের টিকেট কেনায় যাত্রীদের কোন আগ্রহ নেই। ফলে ভিড় নেই লঞ্চে কাউন্টারগুলোতে। অন্যদিকে, সড়ক পথে টিকেট আগেই বিক্রি হয়ে গেছে। সেই টিকেটে মঙ্গলবার থেকে ঈদযাত্রা শুরু করেছে যাত্রীরা। গাবতলী বা সায়েদাবাদ কিংবা মহাখালী বাস টার্মিনালে গিয়ে দেখা গেছে, বাসে উঠতে যাত্রীদের কোন ভিড় নেই। বাসগুলোয় যাত্রীরা যথাসময়ে এসে উঠছেন এবং বাসগুলোও ছেড়ে যাচ্ছে।
তবে সবচেয়ে বেশি সুফল পাচ্ছে দৌলতদিয়া-পাটুরিয়া নৌরুট ব্যবহারকারী দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের যাত্রী ও যানবাহনের চালকরা। দীর্ঘ সিরিয়ালে আটকে না থেকে সরাসরি এসে ফেরিতে উঠছে যানবাহন। ফলে ভোগান্তি ও অপেক্ষা ছাড়াই ঈদে বাড়ি ফেরার স্বপ্ন দেখছে ঘরমুখো মানুষ। ঈদ-উল-আজহা উপলক্ষে অতিরিক্ত যাত্রী ও যানবাহনের চাপ সামাল দিতে এবার দৌলতদিয়া-পাটুরিয়া নৌরুটে যাত্রী ও যানবাহন পারাপারে চলাচলের জন্য ২১টি ফেরি দেয়া হয়েছে।
বিআইডব্লিউটিসির ডিজিএম শাহ মোঃ খালেদ নেওয়াজ বলেন, যাত্রী ও যানবাহন পারাপারে তাদের পর্যাপ্ত প্রস্তুতি রয়েছে। ঈদের চাপ শুরুর আগেই ২১টি ফেরি চলাচল করবে। প্রয়োজন হলে আরও ১টি ফেরি বাড়ানো হবে। এখন যেহেতু চাপ একটু কম, সে কারণে সামান্য ত্রুটিগুলো মেরামত করে নিচ্ছে ফেরিগুলো।