ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

অর্থনীতি সমিতির গবেষণা ॥ ২০ লাখ ৫০ হাজার কোটি টাকার বিকল্প বাজেট প্রস্তাবনা

দেশে কালো টাকা ৮৯ লাখ কোটি, পাচার ৮ লাখ কোটি

প্রকাশিত: ২২:৪২, ২৩ মে ২০২২

দেশে কালো টাকা ৮৯ লাখ কোটি, পাচার ৮ লাখ কোটি

অর্থনৈতিক রিপোর্টার ॥ ধনী-দরিদ্রের বৈষম্য কমিয়ে শোভন সমাজ বিনির্মাণে আগামী অর্থবছরের জন্য ২০ লাখ ৫০ হাজার কোটি টাকার বিকল্প বাজেট প্রস্তাবনা দিয়েছে বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতি। সংগঠনটির মতে, বৈদেশিক কিংবা দেশীয় ঋণ না নিয়েই সরকারের রাজস্ব আয় থেকে এই বাজেটের অর্থায়ন করা সম্ভব। এ লক্ষ্যে ২৭টি উৎস থেকে সরকারের আয় বাড়ানোর কথা বলছে অর্থনীতি সমিতি। এ ক্ষেত্রে কালো টাকা ও অর্থপাচার থেকে উদ্ধার প্রাপ্তির সর্বোচ্চ তাগিদ দিয়েছে সংগঠনটি। এছাড়া সম্পদ কর, বিদেশী নাগরিকদের ওপর কর, অনলাইন ব্যবসা-বাণিজ্যের ওপর করারোপ, বিলাসী পণ্যের ওপর বেশিহারে করারোপ এবং বিউটি পার্লার সেবালব্ধ খাতের ওপর থেকে কর আদায়ে জোর দেয়া হয়েছে। এসব জায়গা থেকে রাজস্ব আদায় বাড়ানো সম্ভব হলে দেশীয় উৎস থেকেই পুরো বাজেট ব্যয় মেটানো সম্ভব। অর্থনীতির সমিতির গবেষণা বলা হয়েছে- স্বাধীনতার ৪৬ বছরেই দেশে কালো টাকার আনুমানিক পরিমাণ ৮৯ লাখ কোটি টাকা এবং একই সময়ে দেশ থেকে অর্থপাচার হয়েছে প্রায় ৮ লাখ কোটি টাকা। কালো টাকা এবং পাচার হয়ে যাওয়া অর্থ উদ্ধার করে আগামী বাজেটের ব্যয় মেটাতে পারে সরকার। রবিবার সকালে বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতির অডিটরিয়ামে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতির সভাপতি অধ্যাপক ড. আবুল বারকাত আসন্ন ২০২২-২৩ অর্থবছরের জন্য বিকল্প জনগণতান্ত্রিক বাজেট প্রস্তাবনা তুলে ধরেন। উন্নয়ন এবং পরিচালন ব্যয় মিলে এই বাজেটের মোট আকার ২০ লাখ ৫০ হাজার ৩৬ কোটি টাকা। যা বর্তমান বাজেটের চেয়ে ৩ দশমিক ৪ গুণ বড়। আবুল বারকাত বলেন, সরকারের বাজেট শুরুই হয় টাকা-পয়সাকে মূল লক্ষ্যবস্তু ধরে নিয়ে। কিন্তু আমরা মনে করি, শোভন সমাজ নির্মাণে এই পদ্ধতির শুরুটাই ভ্রান্ত। কারণ টাকা-পয়সা কখনও মূল লক্ষ্য হতে পারে না, তা লক্ষ্য অর্জনের মাধ্যম হতে পারে মাত্র। আমাদের বাজেট প্রণয়নের কর্মকান্ড শুরু হচ্ছে শোভন জীবন নির্মাণে দেশের মানুষের জন্য কী কী প্রয়োজন তা দিয়ে। এরমধ্যে আছে, মানুষের সুস্বাস্থ্য, সুস্থ দীর্ঘায়ু। আমাদের দেশে উন্নয়নের কথা বললে বলা হয়, ৭১ বছর আয়ু। আমরা ৭১ বছর আয়ু গুরুত্বপূর্ণ মনে করি না। একদিকে জনগণের চাহিদা, অন্যদিকে টাকা-পয়সা। আমরা বাজেট ব্যালেন্সের পক্ষে নই। আমরা অর্থনীতি ব্যালেন্সেরও পক্ষে নই। আমরা সোশ্যাল ব্যালেন্সের পক্ষে। এছাড়া ২০৩২ সালের মধ্যে সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষকে আলোকিত ও শক্তিশালী মধ্যবিত্ত শ্রেণীতে পরিণত করা, বৈষম্য, দারিদ্র্য ও বহুমুখী দারিদ্র্য সর্বনিম্ন পর্যায়ে নামিয়ে আনারও তাগিদ দেয়া হয়েছে বাজেট প্রস্তাবনায়। অর্থনীতি সমিতির বাজেট প্রস্তাবনায় ৩৩৮টি সুপারিশ করা হয়। এ প্রসঙ্গে বারকাত বলেন, বৈষম্য-অসমতা-দারিদ্র্য দূর করতে শুধু আসন্ন বাজেটে নয়, আগামী অন্তত ৫ বছর সমাজ থেকে আয়, সম্পদ, স্বাস্থ্য ও শিক্ষা বৈষম্য ক্রমাগত হ্রাস করে এক সময় নির্মূল করার লক্ষ্যে যেতে হবে। বাজেটে আয় ও ব্যয়ের মৌলিক কাঠামোগত পরিবর্তন হতে হবে। বাজেটে অর্থায়নের উৎস নির্ধারণে দরিদ্র, নিম্নবিত্ত, বিত্তহীন, প্রান্তিক, নিম্ন মধ্যবিত্ত এবং মধ্য মধ্যবিত্ত শ্রেণীর ওপর কোন ধরনের কর দাসত্ব আরোপ করা যাবে না। তিনি আরও বলেন, করোনা মহামারীর আগে সামাজিক সুরক্ষা বেষ্টনীর আওতায় আসার যোগ্য ছিল ২ কোটি। যাদের ৭৫ শতাংশ এই সুবিধা পেতেন না। এই সংখ্যা কোভিডকালে বেড়ে কমপক্ষে সাড়ে ৩ কোটিতে দাঁড়িয়েছে। নিঃস্বতর হয়েছে অনানুষ্ঠানিক খাত। বেকার হয়েছেন কয়েক কোটি মানুষ। অবস্থা একই রকম থাকলে সামাজিক সুরক্ষা প্রাপ্তিযোগ্য মানুষের সংখ্যা দ্বিগুণ বাড়বে এবং বেড়েছে। এসব বিবেচনায় আমাদের প্রস্তাবিত জনগণতান্ত্রিক বাজেটে এটি হলো সর্বোচ্চ বরাদ্দ প্রাপ্তিযোগ্য খাত। এই খাতে সরকার যা বরাদ্দ করে থাকে তা যৌক্তিক নয়। যে কারণে আমরা নতুন ৮টি খাত অন্তর্ভুক্ত করেছি। তিনি বলেন, খাদ্য পণ্যের দাম স্বাভাবিক রাখতে বার্ষিক প্রাক্কলিত মূল্যস্ফীতি ৫ থেকে ৭ শতাংশের মধ্যে রাখতে হবে। সরকার যে মূল্যস্ফীতির কথা বলে সেটি প্রকৃত মূল্যস্ফীতির তুলনায় অনেক কম। শর্ত হলো, কর্মসংস্থান বাড়াতে হবে এবং ন্যায্য মজুরি নিশ্চিত করতে হবে। মূল্যস্ফীতি এমন কোন পর্যায়ে নেয়া যাবে না যা অর্থনীতিকে মূল্যস্ফীতির ঘূর্ণনচক্রের মধ্যে ফেলবে। এছাড়া খাদ্য মূল্যস্ফীতি কোন অবস্থাতেই বাড়ানো যাবে না। অর্থনীতি সমিতির সভাপতি বলেন, বাংলাদেশের আর্থিক ব্যবস্থা মূলত ব্যাংক নির্ভর। বেল আউট কর্মকা-ে বৃহৎ ঋণগ্রহীতাদের নির্বিচার নগদ অর্থ প্রদান কোনভাবেই সমীচীন হবে না। লক্ষ রাখতে হবে ব্যাংক ব্যবস্থাসহ আর্থিক খাতের কর্মকা-ের ফলে আমাদের দেশে যেন আর্থিক রেন্ট সিকিং পুঁজি প্রণোদিত না হয়- কিন্তু তাই হচ্ছে। তিনি বলেন, শ্রীলঙ্কার ঘটনা দেখার পরে বৈদেশিক ঋণ নিঃসন্দেহে আমাদের সবার এখন দুশ্চিন্তার বিষয়। বৈদেশিক ঋণ, অনুদানের রাজনৈতিক অর্থনীতি সম্পর্কে বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতির অবস্থান বরাবর খুবই স্বচ্ছ। এই মুহূর্তে আমাদের দেশের মানুষের মাথাপিছু দেনা ৩৮ হাজার টাকা যা জিডিপির তুলনায় বৈদেশিক ঋণ খুব বেশি নয়। বৈদেশিক ঋণ পরিশোধে আমাদের অবস্থা স্বস্তিদায়ক, আমরা এখন বিদেশে ঋণ দেই-এসবই সরকারী কাথা-বার্তা এবং আপাত দৃষ্টিতে স্বস্তিদায়ক। বৈদেশিক ঋণ নিয়ে এখন পর্যন্ত আমাদের অবস্থান বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, যখন থেকে আমরা একসঙ্গে ৪ থেকে ৫টি বৈদেশিক ঋণ নেয়া মেগা প্রকল্পের ঋণের সুদ পরিশোধ করা শুরু করব, তখন থেকে ঋণ পরিশোধ অবস্থা সবুজ না হলে লাল সঙ্কেতবাহী হওয়ার সম্ভাবনা প্রচুর। আনুমানিক সময় আমাদের হিসাবে ২০২৭-২৮ সাল। তিনি বলেন, শিক্ষা নিয়ে আমাদের নীতিগত প্রস্তাব, সরকারে যে বা যারাই থাকুন না কেন প্রথমেই নিঃশর্তভাবে স্বীকার করে নিতে হবে শিক্ষার মূল উদ্দেশ্য হলো জ্ঞান সমৃদ্ধ, বিচার বোধ সম্পন্ন, নৈতিক দৃষ্টিতে উন্নত ও সৌন্দর্য বোধ সমৃদ্ধ পূর্ণাঙ্গ মানুষ সৃষ্টি করা। আমরা জানি আমাদের শিক্ষা এটার সঙ্গে মেলে না। শিক্ষা খাতে বাজেট কোনভাবে ব্যয় হিসেবে দেখা যাবে না, সামাজিক বিনিয়োগ হিসেবে দেখতে হবে। জিডিপির অনুপাতে শিক্ষা খাতে সরকারী বরাদ্দ এখনও নিম্নমুখী। কালো টাকা ও পাচার হওয়া অর্থ উদ্ধারে সর্বোচ্চ জোর ॥ অর্থনীতি সমিতির প্রস্তাবনায় বলা হয় ১৯৭২-৭৩ থেকে ২০১৮-১৯ সাল পর্যন্ত ৪৬ বছরের বাংলাদেশের পুঞ্জিভূত কালো টাকার পরিমাণ ৮৮ লাখ ৬১ হাজার কোটি টাকা। আমরা এই পুঞ্জিভূত কালো টাকা থেকে দুই শতাংশ উদ্ধারের প্রস্তাব করছি। এতে এক লাখ ৭৭ হাজার ২৮৮ কোটি টাকা উদ্ধার হবে। একই সময়ে বাংলাদেশ থেকে হওয়া অর্থ পাচারের পরিমাণ কমপক্ষে ৮ লাখ কোটি টাকা। আমরা তার ১০ শতাংশ উদ্ধার করে বাজেটে আনার কথা বলছি। দুর্নীতি, কালোটাকা তথ্য পাচার বিষয়ে আমরা একটি স্বাধীন কমিশন গঠনের কথা বলছি। এর লক্ষ্য উদ্দেশ্য কার্যপরিধি বিস্তারিত কিভাবে কি হবে তা আমরা সরকারকে ও জানিয়ে দিয়েছি। অর্থনীতি সমিতির বিকল্প বাজেটে পরিচালন ব্যয় ধরা হয়েছে ৬ লাখ ৮৭ হাজার ৬৫৮ কোটি টাকা। আর উন্নয়ন ব্যয় ধরা হয়েছে ১৩ লাখ ৬২ হাজার ৩৮৭ কোটি টাকা। মোট বাজেটের মধ্যে বিভিন্ন কর থেকে ১৮ লাখ ৭০ হাজার ৩৬ কোটি টাকা আয়ের কথা বলা হয়েছে। এনবিআর আয় করবে ১১ লাখ ৯৯ হাজার ১০০ কোটি টাকা। রাজস্ব বোর্ড এর বাহিরে কর আদায় হবে ৬ লাখ ৭০ হাজার ৯৩৬ কোটি টাকা। অর্থনীতি সমিতি বিভিন্ন খাতের বেশ কয়েকটি প্রস্তাব সরকারের কাছে তুলে ধরে। আবুল বারকাত বলেন, দরিদ্র, নিম্ন মধ্যবিত্ত, মধ্যবিত্ত শ্রেণীকে আগামী কয়েকবছর সব ধরনের কর থেকে অব্যাহতি দিতে হবে। তাদের কর নেটের বাইরে রাখতে হবে। শিশুদের খেলার মাঠ ভেঙ্গে যে যেভাবে পারে, যা খুশি, তা করে। এ কারণে শিশু বিকাশে সমাজ কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের অধীনে আলাদা বিভাগ গঠন করতে হবে। ১৮ কোটি মানুষের দেশে সবকিছু ছোট্ট একটা শহর ঢাকা থেকে নিয়ন্ত্রিত হবে তা থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। বেকারত্ব বেশি থাকলে উচ্চ মূল্যস্ফীতি অনেকটা মড়ার ওপর খাঁড়ার ঘায়ের মতো হয়ে ওঠে। সেই সঙ্গে চলছে বৈশ্বিক পরিসরে মন্দাভাব ও রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ। এই পরিস্থিতিকে দুঃসময় আখ্যা দিয়ে আবুল বারকাত বলেন, এ সময় মানুষ জনকল্যাণকামী বাজেট প্রত্যাশা করে। সরকারী উদ্যোগে শোভন কর্মসংস্থান বৃদ্ধির বিকল্প নেই বলে মত দেন তিনি। তার আশা, এই বিপর্যয় মানুষের অন্তর্নিহিত শক্তি বৃদ্ধিও সুযোগ সৃষ্টি করবে। এই বাজেটে সবচেয়ে বেশি বরাদ্দপ্রাপ্ত খাত প্রস্তাব করা হয়েছে- সামাজিক নিরাপত্তা খাত, শিক্ষা ও গবেষণা, তথ্য ও প্রযুক্তি, প্রশাসন ও ও স্বাস্থ্যখাত। ২০২২-২৩ অর্থবছরের বাজেটে কৃষি-জলাভূমি সংস্কারে বিশেষ বরাদ্দের দাবি জানান আবুল বারাকাত। এ ছাড়া হাওড়-বিল অঞ্চলের মানুষদের জীবনের উন্নয়নে কর্তৃপক্ষ গঠন করে ২ লাখ কোটি টাকা বরাদ্দের দাবি জানান তিনি। জনগণতান্ত্রিক বাজেটের মূল লক্ষ্যের বিবরণ দেন আবুল বারাকাত। সেগুলো হলো- ২০৩২ সালের মধ্যে সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষকে আলোকিত ও শক্তিশালী মধ্যবিত্ত শ্রেণীতে পরিণত করা, বৈষম্য, দারিদ্র্য ও বহুমুখী দারিদ্র্য সর্বনিম্ন পর্যায়ে নামিয়ে আনা, পরজীবী লুটেরাদের সম্পদ সমাজের নিচের সারির মানুষের মাঝে বিতরণ করা, দেশীয় উন্নয়ন কৌশলে সবচেয়ে জোর দেয়া, কৃষি প্রক্রিয়াজাত শিল্প ও কৃষি জলাভূমিতে বেশি গুরুত্ব দেয়া, মানুষের জন্য শোভন কর্মসংস্থান নিশ্চিত করা। সংবাদ সম্মেলনে সূচনা বক্তব্য দেন অর্থনীতি সমিতির সাধারণ সম্পাদক মোঃ আইনুল ইসলাম। বিকল্প বাজেট সংবাদ সম্মেলনের ভিডিও কনফারেন্সে দেশের ৬৪টি জেলা, ১০৭টি উপজেলা এবং ২১টি ইউনিয়ন থেকে বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতির সদস্য এবং বিভিন্ন শ্রেণী-পেশার প্রতিনিধিরা যুক্ত ছিলেন। উল্ল্যেখ, আগামী ২০২২-২৩ অর্থবছরের জন্য প্রাথমিকভাবে ছয় লাখ ৭৭ হাজার ৮৬৪ কোটি টাকার বাজেট প্রস্তাবনা তৈরি করেছে সরকার। নতুন এই বাজেটে মোট দেশজ উৎপাদনে (জিডিপি) প্রবৃদ্ধি অর্জনের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হচ্ছে ৭ দশমিক ৫ শতাংশ। এতে মূল্যস্ফীতি ধরা হয়েছে ৫ দশমিক ৫ শতাংশ। আগামী ৯ জুন বৃহস্পতিবার জাতীয় সংসদে নতুন অর্থবছরের বাজেট উপস্থাপন করবেন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল।
×