ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

ড. মিহির কুমার রায়

ধান কাটা নিয়ে বিপাকে কৃষক

প্রকাশিত: ২০:৪৬, ২৩ মে ২০২২

ধান কাটা নিয়ে বিপাকে কৃষক

বাংলাদেশের ভূ-প্রাকৃতিক অবস্থানে হাওড়াঞ্চলের বিশেষ গুরুত্ব রয়েছে। কারণ, এটি বিচ্ছিন্ন দুর্গম অঞ্চল যা দেশের ৭টি প্রশাসনিক জেলায় ও ৫৭টি উপজেলার মধ্যে বিস্তৃত, যাকে স্থানীয়ভাবে বলা হয় ভাটি অঞ্চল, যা জেলার প্রায় সাড়ে আট লাখ হেক্টর জমি নিয়ে গঠিত এবং প্রায় ২০ লাখ কৃষক ও সাধারণ মানুষ হাওড় অঞ্চলের বাসিন্দা। অন্যান্য অঞ্চল থেকে তাদের জীবনযাত্রা ভিন্ন প্রকৃতির। এখানকার কৃষি ব্যবস্থা, জীবন ও জীবিকা, এখানকার সংস্কৃতি ও অর্থনীতি ভিন্ন। বছরের প্রায় অর্ধেকেরও বেশি সময় এখানে পানি থাকে। যোগাযোগের মাধ্যম হলো নৌকা। এক ফসলি বোরো ধান হাওড় অঞ্চলের কৃষকদের প্রাণ। এখানে মূলত বোরো ধানেরই উৎপাদন ভাল হয়। বর্ষার পলিমাটি হাওড়ের নিম্নাঞ্চলে জমাট হয়ে কৃষির উৎপাদনে ইতিবাচক ভূমিকা রাখে। এই পুরো অঞ্চলে ধানের উৎপাদন হয় প্রায় ৫৫ লাখ মেট্রিক টন, যা দেশের মোট বোরো উৎপাদনের এক-চতুর্থাংশ। হাওড়াঞ্চলে সাধারণত একটা ফসল হয় বছরে। বাংলাদেশে মোট চাল উৎপাদনের জমির পরিমাণ প্রায় সোয়া কোটি হেক্টর, যার মধ্যে প্রায় ২০ লাখ হেক্টর বা ১৫ শতাংশ হাওড়াঞ্চলে। এক অর্থে দেশের মোট চাল উৎপাদনের ১৫ থেকে ২০ শতাংশ আসে সেখান থেকে। হাওড়ের চাল নষ্ট হওয়া মানে ১৭-১৮ লাখ টন চাল আমদানির দিকে তাকিয়ে থাকা, বৈদেশিক মুদ্রায় যার মূল্য বিশেষত বিদ্যমান আন্তর্জাতিক পরিস্থিতিতে ব্যয়বহুল। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতর সূত্রে জানা যায়, হাওড়ের ৭টি জেলায় মোট বোরো আবাদের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছিল ৯ লাখ ৪৭ হাজার ৬৭০ হেক্টর জমি। যার বিপরীতে ৯ লাখ ৫০ হাজার ৪০৬ হেক্টর জমিতে আবাদ হয়েছে। তবে পরিপূর্ণভাবে হাওড় এলাকায় আবাদ হয়েছে ৪ লাখ ৫১ হাজার ১৯৬ হেক্টর জমিতে। যারা জমি চাষ করে তারা প্রান্তিক চাষী। বড় চাষীদের অনেকেই অনুপস্থিত ভূস্বামী। তারা থাকেন শহরে। তাদের জমি চাষ করে গরিব কৃষক ও কামলারা। এখানে চাষাবাদে ও ফসল ফলানোর নিবিড়তা কম। অনেক জমি পড়ে থাকে পতিত। ফসল ফলানোর অনিশ্চয়তার কারণে এখানে আধুনিক চাষাবাদ পদ্ধতি তেমন গড়ে ওঠেনি। বাণিজ্যিক চাষাবাদের কথাও খুব বেশি চিন্তা করে না স্থানীয় কৃষক। জীবনধারণ পর্যায়ে এখানে চাষাবাদ করা হয়। হাওড় শুষ্ক মৌসুমে শুকিয়ে গেলে বিলের তলানিতে গিয়ে জমা হয় মাছ। প্রায় ১৩০ প্রজাতির মাছ বিচরণ করে এখানে। মাছ ধরা, প্রাকৃতিকভাবে মাছ পরিবর্ধন করানো এবং মাছ বিক্রি করা এখানকার মানুষের জীবিকার আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ অনুষঙ্গ। এক সময় সেখানে প্রচুর জলজ উদ্ভিদ ছিল। কালক্রমে হাওড়ের গভীরতা কমে গিয়ে সেখানে হোগলা ও নলখাগড়ার ঝোঁপ গজিয়ে ওঠে। এই অঞ্চলে প্রচুর জলসহিষ্ণু উদ্ভিদ যেমন হিজল ও করচ জন্মায়। বন্যার পানি চলে গেলে বিভিন্ন হাওড়ের তলানিতে প্রচুর ছোট মাছ, শামুক ও ঝিনুক পাওয়া যায়। কৃষকগণ তার কিয়দাংশ ভোগ করে, বাকি অংশ বিক্রি করে বাজারে। এটা তাদের আয়ের গুরুত্বপূর্ণ একটি উৎস। হাওড়ের চাষীরা হাঁস প্রতিপালনে খুব আগ্রহী। কোন প্রকার ক্রয়কৃত তৈরি খাদ্য ছাড়াই তারা প্রাকৃতিকভাবে প্রাপ্ত খাদ্য দিয়ে হাঁস প্রতিপালন করে থাকে। হাওড় অঞ্চলে অকালবন্যা নতুন কোন ঘটনা নয়। প্রায় প্রতিবছরই বন্যা হয়ে থাকে এই অঞ্চলে। তাতে ভেসে যায় কৃষকের পাকা ধান। অর্থনীতি খাদের কিনারায় গিয়ে দাঁড়ায়। এ বছর সুনামগঞ্জ, নেত্রকোনা ও কিশোরগঞ্জের নিম্নাঞ্চলের প্রায় ৫০০০ একর জমির ধান ইতোমধ্যেই তলিয়ে গেছে। অনেক বাঁধে দেখা দিয়েছে ফাটল। কৃষক ও এলাকাবাসী দিনরাত বাঁধের পাশে থেকে নিজেরাই বিনা শ্রমে বাঁধে মাটি কাটছেন, ফেলছেন। ভুক্তভোগী কৃষকদের জিজ্ঞেস করলে জানা যায়, যারা প্রকৃত জমির মালিক বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই তাদের বাঁধ নির্মাণ কমিটিতে রাখা হয় না। সঠিকভাবে বাঁধের কাজও হয় না। ফলে যা হওয়ার তাই হচ্ছে। অকালবন্যায় ভাসিয়ে নিয়ে যায় কৃষকের স্বপ্নের ফসল। অর্থনীতির মানদন্ডে হাওড় অঞ্চল থেকে যে ধান উৎপাদন হয়ে চাল আকারে দেশের কেন্দ্রীয় স্টকে জমা হয়, যার আর্থিক মূল্য ৩ হাজার ৫১৭ কোটি টাকা, তা দেশের জিডিপিতে অবশ্যই একটা প্রভাব ফেলবে। কারণ, দেশের সার্বিক উন্নয়নে হাওড় অঞ্চল থেকে শতকরা ১৮ ভাগ চাল খাদ্য নিরাপত্তায় সংযোজন হয়। শতকরা ২২ ভাগ গবাদিপশু এই অঞ্চলে লালিত পালিত হয়। মৎস্য ভা-ারে ভরপুর এই অঞ্চল দেশের আমিষের চাহিদা পূরণে এক গুরত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে। কিন্তু দেখা যাচ্ছে যে বর্ষার আগের দুটি মাসেই কৃষকরা একটা আতঙ্কের মধ্যে থাকে- পাহাড়ী ঢলের বন্যার পানি কখন আসবে? যেমন, এ বছর এরই মধ্যে সুনামগঞ্জ জেলার ছোট-বড় শতাধিক হাওড়ের মধ্যে ১৫টিতেই সীমান্তের ওপার থেকে নেমে আসা পাহাড়ী ঢলে বেড়েছে পানি। ভাঙছে বাঁধ। ইতোমধ্যেই তলিয়ে গেছে আনুমানিক ৭ হাজার হেক্টর বোরো ফসল। বন্যার পানি ঢুকেছে সিলেট শহরেও। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতর ১২টি বাঁধ ভেঙ্গে ৪৩৫০ হেক্টর জমির ফসল তলিয়ে যাওয়ার কথা স্বীকার করেছে। সময়মতো বাঁধের কাজ শেষ না করা, অর্থ ছাড় না করা, প্রকৃত কৃষকদের পিআইসির অন্তর্ভুক্ত না করার ফলেই দুর্বল বাঁধের কাজ হওয়ায় প্রথম ধাক্কায় বোরো ফসল পানিতে তলিয়ে কৃষকদের স্বপ্ন সাধ চুরমার হয়ে গেছে। এমন অভিযোগ হাওড়বাসীর। সুনামগঞ্জ জেলার ১২ উপজেলার ৪২টি হাওড়ে ৭২৭ টিপিআইসি ১৩৫টি ক্লোজারসহ মোট ৫৩২ কিলোমিটার বাঁধ নির্মাণ ও সংস্কারের জন্য সরকার পানি উন্নয়ন বোর্ডের মাধ্যমে ১২১ কোটি টাকা বরাদ্দ করে। বাঁধের কাজ শেষ করার কথা ছিল ২৮ ফেব্রুয়ারি। এর মধ্যেই সীমান্তের ওপার থেকে পাহাড়ী ঢল এসে ফসল রক্ষা বাঁধের সর্বনাশ করে সুনামগঞ্জবাসীকে চরম উদ্বিগ্ন করে তোলে। ইতোমধ্যে সেখানকার দিরাই, শাল্লা, তাহিরপুর ও ধর্মপাশায় বিভিন্ন ছোট-বড় হাওড়ের ধান তলিয়ে গেছে। আর যেগুলো এখনও তলিয়ে যায়নি, সেগুলোও রয়েছে ঝুঁকির মুখে। কিছুদিন আগে রাষ্ট্রপতি সুনামগঞ্জ এসেছিলেন ভাটির মানুষের সুখ-দুঃখ ভাগ করে নিতে। তিনি বলেন, রাষ্ট্রপতি হওয়ার জন্য যে প্রজ্ঞা, মেধা ও সংগ্রামকে লালন করেছেন তা হাওড়েরই দান। তাই আজ রাষ্ট্রপতির চেয়ে আমার বড় পরিচয় আমি হাওড়ী মানুষ। এজন্য তিনি ভাল করেই জানেন এখানকার প্রতিটি মানুষের জীবন-জীবিকার একমাত্র নির্ধারক হাওড়ের বোরো ধান। সত্যি বলতে কি, এখানকার মানুষের স্বপ্নের প্রতিটি উপাদানই হাওড়কেন্দ্রিক। কিন্তু প্রায় প্রতিবছর এই স্বপ্ন ভেঙ্গে চুরমার হয়ে যায় গুটিকতক কারণে। সুনামগঞ্জের ১১টি উপজেলার ৪২টি হাওড়ের প্রায় ২ লাখ ২০ হাজার ৮৫০ হেক্টর জমিতে ধান চাষ হয়। এই ফসল রক্ষার জন্য প্রতিবছর কোটি কোটি টাকা বরাদ্দ দেয়া হয়। এবারও বরাদ্দ দেয়া হয়েছে প্রায় ৬৯ কোটি টাকা। ২০১১ সালে এই বরাদ্দ ছিল ১২ কোটি টাকা। রাষ্ট্রপতি বলেন, ভাটির বুকে একটি কথা প্রচলিত আছে, বাঁধের জন্য যে পরিমাণ টাকা বরাদ্দ হয়, সেই টাকা ধাতব মুদ্রায় রূপান্তরিত করে বাঁধ দিলে তা ডুববে না। তারপরেও অধিকাংশ বছরই বাঁধ তলিয়ে যায়। কোন কোন বছর ভাগ্যবিধাতা সহায় হলে রক্ষা পায় কিছু। হাওড় পাড়ের অনেক বাঁধই স্থায়ীভাবে নির্মাণ করা সম্ভব। বাঁধের ওপর স্থায়ী বসতি স্থাপন ও পর্যটন স্পটও গড়ে তোলা সম্ভব। এখন বিশ্ব জলবায়ু পরিবর্তনের ধাক্কায় ইতোমধ্যে ব্যাপক পরিবর্তন ঘটে গেছে। যেমন- বাংলাদেশে প্রাপ্ত ২৬০ প্রজাতির মাছের মধ্যে ১৩০ প্রজাতির মাছ পাওয়া যায় মিঠাপানি বা হাওড় অঞ্চলে। কিন্তু কীটনাশক, রাসায়নিক সারের মাত্রাতিরিক্ত ব্যবহার বৃদ্ধি, পানির স্বাভাবিক প্রবাহে অপরিকল্পিত উন্নয়নের নামে বাধার ফলে মাছসহ অসংখ্য জলজ, প্রাণিজ ও উদ্ভিদের অস্তিত্ব আজ বিপন্ন। পানি কমে যাওয়ার ফলে শুকনো মৌসুমে হাওড়েও পানির পরিমাণ অনেক কমে যায়, মাছের স্বাভাবিক প্রজনন ব্যাহত, অতিবৃষ্টিতে হাওড় পানিতে ভরে গেলেও পানি স্থায়ী না হওয়া, হাওড়াঞ্চলের উদ্ভিদের সঙ্গে বৃষ্টির নিবিড় সম্পর্ক, স্বাভাবিক বৃষ্টি ব্যাহত হলে হিজল, করচ, বরুণসহ অন্যান্য উদ্ভিদ বিলীন হয়ে যাবে। বিচিত্র প্রজাতির পাখি তাদের খাদ্য ও আবাসস্থল হারিয়ে বিলুপ্ত হয়ে যাবে। হাওড় অঞ্চলে এক সময় কোথাও কোথাও গভীর জঙ্গল ছিল। সেখানে এখন ধু ধু করছে উদাস হাওড়। এখন হাওড়ের অর্থনীতি রক্ষায় কি করণীয়, তা নিয়ে ভাববার সময় এসেছে। যেমন- ১. মেঘালয় ও অসমে যে বৃষ্টি হয় তার একটা অংশ সংশ্লিষ্ট নদীগুলো হয়ে বাংলাদেশের হাওড়েই এসে জমা হয়। অতএণ্ড এ দুর্যোগ ঠেকানো সহজ ব্যাপার নয়। এটাও তো ঠিক যে, সীমান্তের ওপারে বছরে কোন্্ সময়ে কতটুকু বৃষ্টি হয় তার রেকর্ড আমাদের অজানা নয়। আবার সেখানে আগামী কয়েকদিন কী পরিমাণ বৃষ্টি হতে পারে, তারও আগাম তথ্য জানাও দুই দেশের মধ্যে বন্যা বা আবহাওয়া সংক্রান্ত তথ্য বিনিময় চুক্তি থাকার কারণে পাওয়া খুব একটা কঠিন বিষয় নয়। এসব তথ্য জানা থাকলে পাহাড়ী ঢল ঠেকানো না হোক, তার কারণে যাতে কম ক্ষয়ক্ষতি হয়, অন্তত সে ব্যবস্থা নেয়া যায় নিশ্চয়ই। ২. প্রাকৃতিক উপাদানগুলোর দিকে বিশেষ নজর দেয়া, যেমন- সময়ের আবর্তে পলি সংযোজিত হয়ে হাওড়ের জলাশয়গুলোর ভরাট হওয়ায় অল্প বর্ষায় প্লাবিত হওয়ার ঝুঁকি নিরসন এবং ড্রেজিংয়ের মাধ্যমে এই জলাধারগুলোর নাব্য বৃদ্ধি, বাঁধ নির্মাণের টেকসই প্রযুক্তি ব্যবহার। যার সঙ্গে এই অঞ্চলের ভৌগোলিক পরিবেশের সামঞ্জস্য থাকবে। পানি ব্যবস্থাপনায় এলাকার বাসিন্দাদের সম্পৃক্ত করে কর্ম পরিকল্পনা তৈরি, যা হবে একটি চলমান প্রক্রিয়া। ৩. হাওড় এলাকায় প্রাণপ্রবাহ হিসেবে চিহ্নিত নদী ও খালগুলো খনন করা। হাওড়ে পানির স্বাভাবিক চলাচল বন্ধ করে যত্রতত্র রাস্তা ও অবকাঠামো নির্মাণ বন্ধ। বিশেষজ্ঞ ও স্থানীয় মানুষের সম্মিলিত পরামর্শে নির্ধারিত সময়ে বাঁধ নির্মাণ সম্পন্ন ও প্রয়োজনমাফিক উঁচু করতে হবে। মিঠাপানির মৎস্যসম্পদ ( বিলুপ্তপ্রায় মাছ ও জলজ সম্পদ) রক্ষার্থে হাওড়ের বিলগুলোর সরকারী ইজারা পদ্ধতি সংস্কার করতে হবে। পানি উন্নয়ন বোর্ডের অসাধু কর্মকর্তা ও ঠিকাদারদের দুর্নীতি, দায়িত্ব পালনে গাফিলতি ও উদাসীনতা বন্ধ করে নজরদারি বাড়াতে হবে। হাওড় এলাকার আর্থসামাজিক উন্নয়ন বৃদ্ধি ও সরকারের সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনীর পরিধিও বাড়াতে হবে। ৪. একমাত্র নির্ভরশীল ফসল বোরো ধান চাষের বাইরে বিকল্প কৃষিশিল্প অর্থনীতি ও নতুন কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করতে হবে। হাওড় ও বিলসংলগ্ন এলাকায় খাসজমি বরাদ্দ বন্ধ করে সরকারীভাবে স্থানীয় জলজ উদ্ভিদ ও বৃক্ষের সমারোহে সবুজায়নের উদ্যোগ নেয়া দরকার। কেননা, ফসলের বাইরেও হাওড়াঞ্চলে প্রাণ ও প্রকৃতির একটা বিশাল জগত আজ বিপন্নপ্রায়। হাওড় উন্নয়ন বোর্ডকে আরও সক্রিয় ও গতিশীল করতে হবে। হাওড় উন্নয়নে মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়ন, প্রয়োজনে হাওড় উন্নয়নে পৃথক একটি মন্ত্রণালয় গঠন করতে হবে, যেখানে হাওড়ের মানুষ ও জনপ্রতিনিধিদের যোগ্য নেতৃত্ব ও অংশগ্রহণ থাকবে। ৫. কৃষি যান্ত্রিকীকরণের যুগে ৭টি জেলা বেষ্টিত হাওড় এলাকার ১ ফসলি জমিতে কেন এতদিনেও কৃষকদের যান্ত্রিকীকরণের ছোঁয়া (চাষাবাদ, মাড়াই, বাজারজাতকরণ) লাগেনি তা অনুসন্ধান করতে হবে। অথচ এই হাওড় অঞ্চল জাতিকে শুধু খাদ্য নিরাপত্তাই (চাল, ডাল, মাছ, মাংস, ডিম, দুধ) দেয়নি, তার সঙ্গে দিয়ে যাচ্ছে প্রকৃতির অপরূপ এক সুন্দর লীলাভূমি, যা মানসিক স্বাস্থ্য বিকাশের এক অপূর্ব ক্ষেত্র। ৬. শুধু হাওড়ই নয়, বর্তমানে সারাদেশে কৃষিকাজে শ্রমিক সঙ্কট একটি সাধারণ চিত্র হয়ে দাঁড়িয়েছে, যা সনাতনী ধারার কৃষির জন্য কিছুটা চ্যালেঞ্জ তো বটেই। দেশের যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নতি ও বিভিন্ন কাজের সুযোগ সৃষ্টি হওয়ায় গ্রাম থেকে শহরেও মানুষের চলাফেরার গতি অনেক বেড়েছে। তার সঙ্গে রয়েছে কর্মের বহুমুখিতা। ফলে, শ্রমিকরা কৃষিতে আর আগের মতো তাদের নিয়োজনে অগ্রাধিকার তালিকায় রাখছে না, বিশেষত আর্থিক নিরাপত্তাসহ উন্নত জীবনের আশায়। এই সমস্যার সমাধানের বিকল্প হতে পারে কৃষির যান্ত্রীকরণ যার জন্য প্রাতিষ্ঠানিক আয়োজন, সংগঠন, প্রশিক্ষণ ও অর্থায়ন জরুরী। বিশেষত হাওড় অঞ্চলের জন্য। ৭. দেশের বিশেষত উত্তর পূর্বাঞ্চল থেকে যে সকল মৌসুমি কৃষি শ্রমিক হাওড় অঞ্চলে আসে, তাদের সংবর্ধনা, আবাসন, খাওয়া-দাওয়া, চিকিৎসা ইত্যাদির জন্য একটি যথাযথ আয়োজন থাকা প্রয়োজন। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, হাওড়ে ধান মাড়াইয়ের জন্য খোলা তৈরি করা হয় এবং জমি থেকে ধান কেটে খোলায় নিয়ে আসা হয়, যা অনেক ক্ষেত্রে টিনের সেড কিংবা ত্রিপল দ্বারা বেষ্টিত। বিশেষত অসময়ে বৃষ্টির হাত থেকে ধান রক্ষা করার জন্য। কৃষি শ্রমিকরা ধান মাড়াই, শুকানো ও বাজারজাতকরণের প্রক্রিয়াটি শুরু করতে থাকে। এই ধরনের খোলা তৈরি এককভাবে কৃষকের পক্ষে সম্ভব হবে না। প্রয়োজন কৃষক সংগঠন, যার অনুপস্থিতি অনেক ক্ষেত্রে দেখা যায়। এ ক্ষেত্রে এলাকার সম্পদশালী অনুপস্থিত জমির মালিক, যারা জমি বর্গা দিয়ে শহরে বসবাস করছেন, তাদের সঙ্গে সেখানে মৌসুমি শ্রমিকদেরও আবাসনের থাকা খাওয়া চিকিৎসা ব্যবস্থা থাকবে। কাজ শেষে ভাগের ধান ও মজুরি নিয়ে নিরাপদে যাতে বাড়ি ফিরতে পারে, সে জন্য নিরাপদ ব্যবস্থা থাকা প্রয়োজন। লেখক : উন্নয়ন গবেষক ও ডিন, সিটি ইউনিভার্সিটি
×