ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

জিনিসপত্রের দাম বেড়ে জনজীবনের ওপর মারাত্মক প্রভাব ফেলবে অনুৎপাদনশীল খাতে বিদ্যুত ব্যবহারে রেশনিং করার পরামর্শ এফবিসিসিআইর

বিদ্যুত ও গ্যাসের দাম বাড়ানোর উদ্যোগ আত্মঘাতী

প্রকাশিত: ২৩:০৬, ২২ মে ২০২২

বিদ্যুত ও গ্যাসের দাম বাড়ানোর উদ্যোগ আত্মঘাতী

অর্থনৈতিক রিপোর্টার ॥ বিদ্যুত ও গ্যাসের দাম বাড়ানোর উদ্যোগের কঠোর সমালোচনা করেছে ব্যবসায়ী ও শিল্পপতিদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআই। অন্তত ছয় মাস সময় নিয়ে বিশ্ব পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করা দরকার বলে মনে করছে সংগঠনটি। ব্যবসায়ীদের মতে, বিদ্যুত ও গ্যাসের দাম বাড়ানোর সময় এখন নয়। এতে করে ভোগপণ্যসহ জিনিসপত্রের দাম বেড়ে জনজীবনের ওপর মারাত্মক প্রভাব ফেলবে। সরকারকে বেকায়দায় ফেলতে এ উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। করোনা মহামারী আর ইউক্রেন যুদ্ধ বিশ্বজুড়ে যে সঙ্কট তৈরি করেছে, তার মধ্যে বিদ্যুত ও গ্যাসের দাম বাড়ানোর উদ্যোগটি আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত বলে মনে করছে এফবিসিসিআই। শিল্প রক্ষায় বিদ্যুত ও গ্যাস নিয়ে সিদ্ধান্তটি আমলাদের পরিবর্তে রাজনীতিকদের মাধ্যমে নিতে আহ্বান জানানো হয়েছে। আমলাদের সমালোচনা করে বলা হয়, দাম বাড়ানোর যে চেষ্টা হচ্ছে, সেটি সঠিক নয়, সরকারকে বেকায়দায় ফেলার শামিল। এছাড়া গ্যাস-বিদ্যুতের দাম আগামী ২০ বছরে কোন সালে কত হারে বাড়ানো হবে, তার একটি আগাম পরিকল্পনা সরকারের কাছে চেয়েছেন ব্যবসায়ীরা। শুধু তাই নয়, অনুৎপাদনশীল খাতে বিদ্যুত ব্যবহারে রেশনিং করার পরামর্শ দেয়া হয়েছে। এতে করে উৎপাদন ও রফতানিমুখী খাত প্রয়োজনীয় বিদ্যুত পাবে বলে আশা করা হচ্ছে। শনিবার বিদ্যুত ও গ্যাসের মূল্যবৃদ্ধির প্রস্তাবের ওপর রাজধানীর মতিঝিলে এফবিসিসিআই মিলনায়তনে সংগঠনটি সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করে। সম্প্রতি পাইকারি বিদ্যুতের দাম ৫৮ শতাংশ বাড়ানোর সুপারিশ করেছে বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশনের কারিগরি মূল্যায়ন কমিটি। এরপর থেকেই গ্যাস-বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর উদ্যোগের বিষয়ে আপত্তি জানাচ্ছে দেশের শীর্ষ পর্যায়ের ব্যবসায়ীরা। অবশেষে ফেডারেশন অব বাংলাদেশ চেম্বার অব কমার্স এ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি (এফবিসিসিআই) থেকে এ বিষয়ে আনুষ্ঠানিক আপত্তি জানানো হলো। সংবাদ সম্মেলনের শুরুতে এফবিসিসিআই সভাপতি মোঃ জসিম উদ্দিন বিভিন্ন উন্নয়ন কর্মকা-ে বিশাল অর্জনের জন্য প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং বর্তমান সরকারকে ধন্যবাদ জানান। তিনি বলেন, সারাদেশে শতভাগ বিদ্যুতায়ন, করোনা মোকাবেলায় বাংলাদেশ ১২১টি দেশের মধ্যে পঞ্চম এবং দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে প্রথম হয়েছে। স্বল্পোন্নত থেকে উন্নয়নশীল দেশে পদার্পণ, অবকাঠামো উন্নয়ন, দারিদ্র্য হার হ্রাস, শিক্ষিতের হার বৃদ্ধি এবং জুনে পদ্মা সেতু চালুসহ বিশ্বের দ্রুততম অগ্রসরমান অর্থনীতি হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে বাংলাদেশ। কিন্তু রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ এবং মহামারী পরিস্থিতির কারণে সারাবিশ্ব এখন এক সঙ্কটময় পরিস্থিতির মধ্যে যাচ্ছে। বাংলাদেশও এ সঙ্কট থেকে মুক্ত নয়। তিনি বলেন, বৈশ্বিক মহামারী ও ইউক্রেন-রাশিয়ার সঙ্কটে বিশ্বব্যাপী খাদ্যপণ্য, শিল্পের কাঁচামাল, পরিবহন ব্যয়, জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধিতে ব্যবসা পরিচালনার খরচ বেড়েছে। মূল্যস্ফীতিও বেড়েছে। এই দুঃসময়ে পাইকারি পর্যায়ে গ্যাস ও বিদ্যুতের মুল্যবৃদ্ধির প্রভাব মূল্যস্ফীতিকে উস্কে দেবে। এফবিসিসিআই সভাপতি বলেন, দাম বৃদ্ধির এখন সঠিক সময় না। অন্তত ছয় মাস সময় নিয়ে বিশ্ব পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করা দরকার। এখন দাম বাড়ালে উৎপাদন খরচ দ্বিগুণ হয়ে যাবে। দেশীয় শিল্প বন্ধ হয়ে যাবে। মোঃ জসিম উদ্দিন বলেন, অভ্যন্তরীণ পরিস্থিতিতে চরম অসময় যাচ্ছে। এ পরিস্থিতিতে বিদ্যুত ও গ্যাসের মূল্যবৃদ্ধির সময় এটা নয়। যে চেষ্টা হচ্ছে, সেটি আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত, সরকারকে বেকায়দায় ফেলার শামিল। এই মুহূর্তে গ্যাস ও বিদ্যুতের মূল্য না বাড়াতে সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়ে তিনি আরও বলেন, বিদ্যুত ও গ্যাসের দাম বাড়লে সব ধরনের পণ্যের দাম বাড়বে। এর প্রভাব পড়বে জনজীবনের ওপর। এটা চলতে থাকলে দেশে অরাজক পরিস্থিতি তৈরি হতে পারে। তার দায়ভার তখন সরকারকে নিতে হবে। এফবিসিসিআই সভাপতি বলেন, এরপরও যদি দাম বাড়ানোর চেষ্টা করা হয়, তাহলে সেটি ব্যবসায়ীদের ওপর না চাপিয়ে বিদ্যুত খাতের তহবিল থেকে ভর্তুকির মাধ্যমে সমন্বয় করা হোক। এই দুঃসময়ে পাইকারি পর্যায়ে গ্যাস ও বিদ্যুতের মূল্যবৃদ্ধির প্রভাবে বহুমাত্রিক মূল্যস্ফীতি উস্কে দিয়ে এর বহুমুখী নেতিবাচক প্রতিক্রিয়ার উদ্ভব হবে দেশে। এতে করে কৃষি শিল্প সেবা এবং সার্বিকভাবে সাধারণের জীবন ও জীবিকা নির্বাহের ক্ষেত্রে অচলাবস্থার সৃষ্টি করবে। সর্বোপরি অর্থনৈতিক উন্নয়নের চলমান ধারা মারাত্মক প্রতিবন্ধকতার সম্মুখীন হবে। তিনি বলেন, দেশ এখন স্বল্পোন্নত থেকে উন্নয়নশীল দেশে পদার্পণ করেছে। আগামী ২০৩০ সাল নাগাদ টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (এসডিজি) নিয়ে কাজ করছে সরকার। এই উন্নয়নশীল দেশে পদার্পণ এবং এসডিজির লক্ষ্য বাস্তবায়েন ব্যবসায়ীদের সর্বাগ্রে ভূমিকা রাখতে হবে। সবার জন্য সুলভ উন্নত নিরবচ্ছিন্ন এবং টেকসই জ্বালানি ও বিদ্যুত নিশ্চিত করতে সরকার বদ্ধপরিকর। কিন্তু জ্বালানি ও বিদ্যুত খাত বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন (বার্ক) আইনের বিধান অনুযায়ী স্বচ্ছতা, মানসম্মত দক্ষতা ও জবাবদিহিতা সহকারে সুচারুভাবে পরিচালিত হচ্ছে না। বরং এই খাতে সর্বত্র অদক্ষতা, যথেচ্ছ অনিয়ম, অস্বচ্ছতা স্পষ্ট হয়ে উঠেছে এবং আইনের বিপরীতে পরিচালিত হচ্ছে। এ অবস্থায় সমগ্র বিদ্যুত ও জ্বালানি ব্যবস্থার আমূল সংস্কার না করে এ খাতে বিরাজমান অব্যবস্থাপনার অহেতুক দায়ভার জাতীয় অর্থনীতি এবং জনগণের জীবন ও জীবিকা নির্বাহের সকল ক্ষেত্রে সংক্রমিত করা কোনভাবেই সমীচীন হবে না। তবে করোনার সঙ্কটময় পরিস্থিতি প্রশমিত হলে এবং ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধ পরিস্থিতি বন্ধ হওয়ার পর দাম বাড়ানোর প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করলে ব্যবসায়ীদের সেক্ষেত্রে আপত্তি থাকবে না বলেও দাবি করেন এফবিসিসিআই সভাপতি। কুইক রেন্টালের সমালোচনা করে তিনি বলেন, এক সময় এটির প্রয়োজনীতা ছিল। এখন আর তার প্রয়োজনীয়তা নেই। কুইক রেন্টাল বিদ্যুত কেন্দ্র বন্ধ করা উচিত। অদক্ষ বিদু্যুত কেন্দ্রগুলো বন্ধ করা উচিত। গ্যাসচালিত বিদ্যুত কেন্দ্রগুলো অকার্যকর অবস্থায় পড়ে আছে। সরকার সেদিকে মনোযোগ না দিয়ে বিদ্যুত ও গ্যাসের দাম বাড়ানোর পরিকল্পনা করছে। সরকারের ভুল পরিকল্পনার খেসারত শিল্প খাত বহন করতে পারে না। এফবিসিসিআই সভাপতি বলেন, বিদ্যুত ও গ্যাসের মূল্যবৃদ্ধি না করে এখন সরকারের উচিত হবে জ্বালানি ও বিদ্যুত খাতের আমূল সংস্কার আনা। অবৈধ সংযোগ বিচ্ছিন্ন করা। বিদ্যুতের অতিরিক্ত উৎপাদন বন্ধ করে অহেতুক খরচ কমিয়ে আনা। এর জন্য ব্যবসায়ীরা সরকারকে সব ধরনের সহযোগিতা দেবে। বাংলাদেশ চেম্বার অব ইন্ডাস্ট্রিজের সভাপতি আনোয়ার উল আলম চৌধুরী পারভেজ বলেন, দেশে এখন ডলার সঙ্কট চলছে। ইউক্রেন রাশিয়ার যুদ্ধের কারণে পণ্যের দাম বাড়ছে। এখন যদি বিদ্যুত ও গ্যাসের মূল্যবৃদ্ধি করা হয়, উৎপাদন খরচ বাড়বে। যার প্রভাব পড়বে ভোক্তার ওপর। এখন বিদ্যুত ও গ্যাসের মূল্যবৃদ্ধির সময় নয়। রিহাব সভাপতি আলমগীর শামসুল আলামিন বলেন, বিশ্ববাজারে ঝড় চলছে। এ অবস্থায় ইচ্ছামত দাম বাড়িয়ে দেশের ব্যবসা-বাণিজ্যকে ধ্বংসের দিকে ঠেলে দেবেন না। বিকেএমইএর নির্বাহী সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম বলেন, করোনা পরিস্থিতি কাটিয়ে আমরা রফতানিতে বেশ ভাল করতে ছিলাম। এ অবস্থায় বিদ্যুত ও গ্যাসের দাম বাড়ানো হলে রফতানিকারকদের উৎপাদন খরচ বেড়ে যাবে। এতে বিশ্ববাজারে রফতানি প্রতিযোগিতা থেকে ছিটকে পড়বে দেশের পোশাক খাতের উদ্যোক্তারা। বিদ্যুত ও গ্যাসের মূল্য বাড়ানোর চেষ্টার পেছনে আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্র রয়েছে বলে দাবি করে ন্যাশনাল এ্যাসোসিয়েশন অব স্মল এ্যান্ড কটেজ ইন্ডাস্ট্রিজ বাংলাদেশ (নাসিব) সভাপতি মির্জা নুরুল গনি শোভন। তিনি দাবি করেন, এর থেকে সরে আসতে হলে দরকার সরকারের রাজনৈতিক দূরদর্শী সিদ্ধান্ত। এর বাইরে আমলাতন্ত্রের সিদ্ধান্তে কোন কাজ হবে না। এ সময় আরও উপস্থিত ছিলেন, এফবিসিসিআইয়ের সাবেক প্রথম সহ-সভাপতি মোহাম্মদ আলী, বিটিএমএ সভাপতি মোহাম্মদ আলী খোকন, বিজিএমইএর সহসভাপতি মোহাম্মদ শহীদুল্লাহ আজিম, প্রথম সহ-সভাপতি মোস্তফা আজাদ চৌধুরী বাবু, সহ-সভাপতি আমিন হেলালী, হাবিব উল্লাহ ডন প্রমুখ।
×