ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

ওবায়দুল কবির

অবকাঠামোর উন্নয়নেই অর্থনীতির সমৃদ্ধি

প্রকাশিত: ২০:৪৩, ২২ মে ২০২২

অবকাঠামোর উন্নয়নেই অর্থনীতির সমৃদ্ধি

জনকণ্ঠ পত্রিকায় কাজ শুরু করেছি মাত্র কয়েকমাস আগে। ১৯৯৪ সালের কথা। জীবনের প্রথম বিমান ভ্রমণের সুযোগ পেলাম। আমার এক আত্মীয় ট্র্যাভেল এজেন্সির মালিক। আমাকে বিনামূল্যে একটি টিকেট অফার করলেন। তখন ট্র্যাভেল এজেন্সিগুলোকে টিকেট বিক্রির ওপর বছরে কিছু টিকেট বিনামূল্যে দেয়া হতো। প্রতিযোগিতার কারণে এয়ারলাইন্সগুলো সম্ভবত এখন এই সুবিধা তুলে নিয়েছে। আমি এই অফারটি গ্রহণ করলাম সানন্দে। সিঙ্গাপুরে তখন অনেক বন্ধুবান্ধব, আত্মীয়-পরিজন কর্মরত ছিলেন। বাংলাদেশীদের কাছে সিঙ্গাপুর তখন স্বপ্নের দেশ। ভাবলাম ওখানেই যাই। থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা হবে বিনা অর্থে। ঘোরাফেরাও হয়ে যাবে অনেকটা বিনা খরচে। ’৯৪ সালের ২৭ মার্চ গভীর রাতে বাংলাদেশ বিমানের ডিসি-১০ এয়ারক্রাফটে রওনা হলাম সিঙ্গাপুরের উদ্দেশে। বিমানের গন্তব্য ছিল টোকিওর নারিতা বিমানবন্দর। সিঙ্গাপুরে স্টপওভার। ফ্লাইটে জাপান যাচ্ছিলেন প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া। বর্ষণমুখর রাতে ঝড়ঝঞ্ঝায় সেই রোমাঞ্চকর আকাশ ভ্রমণের স্মৃতি আজও জ্বলজ্বল করছে। দুই ঘণ্টা পর উথাল-পাতাল বিমানযাত্রায় কিছুটা স্থিতি আসে। প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া যাত্রীদের সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাতে বিমানের ভিতর এক চক্কর ঘুরে যান। হাত নেড়ে যাত্রীরা তাঁর বদান্যতার জবাব দেন। সাধারণ ফ্লাইটে চলাচলের সময় সরকারপ্রধানের এই সৌজন্য সাক্ষাতের রীতি আমার বেশ ভাল লাগে। পরে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে একাধিকবার আকশপথে ভ্রমণের সুযোগ হয়েছে। তিনিও এভাবে যাত্রীদের সঙ্গে কুশল বিনিময় করেন সবসময়। আজকের মূল বিষয় সিঙ্গাপুর ভ্রমণ নয়। জীবনের প্রথম আকাশপথে বিদেশ ভ্রমণও নয়। একটি রাস্তার গল্প। সড়কপথে সিঙ্গাপুর থেকে কুয়ালালামপুর যাত্রার ছোট্ট অভিজ্ঞতা। আরও কয়েকটি বিষয়ভিত্তিক লেখায় আমি এই অভিজ্ঞতা বর্ণনা করেছি। এবার লেখার উদ্দেশ্য রাষ্ট্রের উন্নয়নে অবকাঠামো কতটা জরুরী সেটি নিয়ে আলোকপাত। বাংলাদেশের চলমান অবকাঠামো উন্নয়ন কর্মকা- নিয়ে অনেক কথা হচ্ছে। বিশেষ করে শ্রীলঙ্কার দুঃখজনক ঘটনার পর কিছু বুদ্ধিজীবী সতর্কতার নামে মানুষকে উস্কে দেয়ার চেষ্টা করছেন। তাদের লেখায় ঘুরেফিরে আসছে দেশের অবকাঠামো উন্নয়নে সরকারের গৃহীত কিছু প্রকল্পের কথা। বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলো এই ইস্যুটি কাজে লাগিয়ে চেষ্টা করছেন তাদের উদ্দেশ্য সাধনের। শ্রীলঙ্কার সঙ্গে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক পরিস্থিতির যোজন যোজন দূরত্ব। বাংলাদেশের অর্থনীতি আজ শক্ত ভিত্তির ওপর প্রতিষ্ঠিত। এর ভিত্তি আরও মজবুত হবে অবকাঠামো উন্নয়নের মাধ্যমে। উন্নত বাংলাদেশ গড়তে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার গ্রহণ করা উন্নয়ন কর্মকা- পরিচালনার কোন বিকল্প নেই। সেই গল্পে ফিরে যাই। সিঙ্গাপুরে অবস্থানের সময় এক আত্মীয়ের সঙ্গে যোগাযোগ হয়। তিনি মালয়েশিয়ার কুয়ালালামপুরে অবস্থান করছিলেন। তিনিও সিঙ্গাপুর থেকে সস্ত্রীক বেড়াতে গেছেন কুয়ালালামপুর। তখন পেজার নামে একটি ছোট্ট ডিভাইস চালু হয়েছে সিঙ্গাপুরে। মোবাইল ফোন চালুর আগে পেজার ছিল একটি যোগাযোগ মাধ্যম। মোবাইল ফোনের মতোই এর একটি নম্বর ছিল। পেজার বাহকের সঙ্গে যোগাযোগ করতে চাইলে একটি ল্যান্ড ফোন থেকে বার্তা পাঠানো হতো। ছোট্ট এই যন্ত্রটিতে এক ধরনের শব্দ হলে বুঝা যেত কেউ তার সঙ্গে যোগাযোগ করতে চাইছেন এবং এতে একটি ফোন নম্বর প্রদর্শিত হতো। পেজার বাহক তখন ল্যান্ড ফোন, কার্ড ফোন কিংবা ফোন বুথ থেকে ঐ নম্বরে যোগাযোগ করতেন। এভাবেই সিঙ্গাপুরে কর্মরত এক বন্ধুর পেজারের মাধ্যমে কুয়ালালামপুর অবস্থানকরী আত্মীয়ের সঙ্গে যোগাযোগ হয়। তিনি আমাকে কুয়ালালামপুর সফরের আমন্ত্রণ জানান। সেই বছরই বাংলাদেশীদের জন্য মালয়েশিয়ায় ভিসা পদ্ধতি চালু হয়েছে। এর আগে মালয়েশিয়া যেতে বাংলাদেশীদের ভিসা প্রয়োজন হতো না। সিঙ্গাপুর এবং থাইল্যান্ডে তখনও বাংলাদেশীদের জন্য পোর্ট এন্ট্রি ভিসা দেয়া হতো। আরও কয়েক বছর পর এই দুই দেশে প্রাক ভিসা পদ্ধতি চালু হয়। সিঙ্গাপুরে অবস্থিত মালয়েশিয়ান হাইকমিশন থেকে মাত্র একদিনে ভিসা সংগ্রহ করি। পরদিন বাসের টিকেট কেটে রওনা হয়ে যাই কুয়ালালামপুরের উদ্দেশে। বাসের টিকেটের দাম ছিল ২০ সিঙ্গাপুর ডলার। বাংলাদেশী টাকায় ৮শ’ টাকা। সিঙ্গাপুর থেকে দৃষ্টিনন্দন চার লেনের ওয়ানওয়ে হাইওয়ে ধরে কুয়ালালামপুর পৌঁছতে সময় লাগে ৫ ঘণ্টা। যাওয়া এবং আসার জন্য আলাদা দুটি চার লেনের রাস্তা। আজ থেকে ২৮ বছর আগে বিলাসবহুল বাসে হাইওয়ে ধরে চলতে চলতে চিন্তা করেছিলাম, এমন একটি রাস্তা কবে হবে বাংলাদেশে। এমন একটি বিলাসবহুল বাসে চড়ে আমরা কি কোনদিন ঢাকা থেকে যেতে পারব চট্টগ্রাম কিংবা কক্সবাজার? দেশে বিলাসবহুল বাস সার্ভিস চালু হলেও এমন একটি রাস্তা আজও স্বপ্নই থেকে গেছে। ঢাকা থেকে পদ্মা সেতু দিয়ে ভাঙ্গা পর্যন্ত রাস্তায় অবশ্য কিছুটা সেই আমেজ পাওয়া যায়। এমন একটি হাইওয়ে হতে পারত ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কটি। এমন মহাসড়ক হতে পারত ঢাকা-ময়মনসিংহ কিংবা ঢাকা-টাঙ্গাইল। অর্থ ব্যয় হয়েছে ঠিকই, শুধু একটু পরিকল্পনার অভাবে এগুলো হয়ে উঠতে পারেনি ক্রসিংশূন্য, যানজটমুক্ত ননস্টপ হাইওয়ে। ২২ বছর পর ২০১৬ সালে আবারও আমি সিঙ্গাপুর থেকে বাসে কুয়ালালামপুর গিয়েছি। হাইওয়েটি আগের মতোই ছিল। কুয়ালালামপুর থেকে পেনাং হয়ে রাস্তাটি সংযুক্ত হয়েছে থাইল্যান্ডের পাদাও সীমান্তে। মালয়েশিয়ার বুক চিরে আগামী শত বছরের পরিকল্পনায় তৈরি করা সাড়ে ৮শ’ কিলোমিটার রাস্তাটি মালয়েশিয়ার প্রথম উন্নয়নের সূচনা বলে মনে করা হয়। সুপরিসর সেই রাস্তার প্রধান বৈশিষ্ট্য হচ্ছে এর কোথাও ক্রসিং বা ইন্টার সেকশন নেই। টার্ন নেয়া কিংবা হাইওয়েতে প্রবেশের জন্য প্রয়োজনীয় দূরত্বে ইউলুপের মতো করা হয়েছে। বামদিকের সার্ভিসরোড ধরে কিছুদূর গিয়ে ইউলুপে উঠতে হয়। একইভাবে হাইওয়ে থেকে বের হয়ে যাওয়া এবং হাইওয়েতে প্রবেশের সময় এসব রাস্তা ব্যবহার করতে হয়। গাড়ি ছাড়া কোন মানুষের পক্ষে হাইওয়েতে ওঠা একেবারেই অবসম্ভব। এ কারণে দুর্ঘটনা না ঘটলে সাড়ে ৮শ’ কিলোমিটার হাইওয়েতে ট্রাফিক জ্যামের কোন সম্ভাবনা থাকে না। বিরতিহীন চলা যায় সিঙ্গাপুর থেকে থাইল্যান্ড সীমান্ত পর্যন্ত। ’৯৬ সালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্র সফরের সময় সড়কপথে নিউইয়র্ক থেকে বোস্টন এবং ওয়াশিংটন যাওয়ার সময় এমন আধুনিক হাইওয়ের দেখা পেয়েছি। ২০১২ সালে কানাডায় টরেন্টো থেকে সড়কপথে নায়েগ্রা জলপ্রপাত দর্শনেও আট লেনের এমন হাইওয়ে দেখেছি। প্রতিবেশী ভারতে এমন অনেক রাস্তা তৈরি হয়েছে। দিল্লী-আজমীর এক্সপ্রেসওয়ে এর মধ্যে সবচেয়ে আকর্ষণীয়। আমাদের দুর্ভাগ্য, শুধু সঠিক পরিকল্পনার অভাবে আমরা পিছিয়ে যাচ্ছি আধুনিক সড়ক যোগাযোগ থেকে। তখন মালয়েশিয়া সবেমাত্র উন্নত দেশ হয়ে ওঠার প্রক্রিয়া শুরু করেছে। কুয়ালালামপুর শহর তখনও আধুনিক সাজে সাজতে পারেনি। গোটা শহরে চলছিল নির্মাণযজ্ঞ। কোন কোন স্থানে মনে হয়েছে গোটা এলাকাটি যেন উল্টে ফেলা হয়েছে। পুরনো ভবনগুলো ভেঙ্গে নতুন শহর করা হচ্ছে। তৈরি হচ্ছে ফ্লাইওভার, এমআরটিসহ আধুনিক যোগাযোগ ব্যবস্থা। ২০০০ সালে মালয়েশিয়ান পামওয়েল কোম্পানির আমন্ত্রণে আবারও গিয়েছিলাম মালয়েশিয়া। শহর ছেড়ে আমাদের নিয়ে যাওয়া হয় গ্রামাঞ্চলে। পাম চাষ, তেল প্রক্রিয়াজাতকরণ পদ্ধতি এবং তেল থেকে উৎপাদিত সাবানসহ নানা পণ্য তৈরির প্রক্রিয়া দেখানো হয় আমাদের। তখন পরিচয় হয়েছিল মালয়েশিয়ান পামওয়েল কোম্পানির কর্মকর্তা জাহিদের সঙ্গে। লন্ডনে ব্যবসা-বাণিজ্যের ওপর পড়ালেখা করে জাহিদ এক্সিকিউটিভ হিসেবে যোগ দিয়েছেন তেল কোম্পানিতে। সুদর্শন, শিক্ষিত ও স্মার্ট জাহিদ সমসাময়িক বিশে^র সব খবরই রাখেন। বাংলাদেশ নিয়ে তার বিশেষ ধারণা ছিল। জাহিদ একদিন ঠাট্টা করে আমাকে বলেন, ‘বাংলাদেশের শাসন আমার হাতে ছেড়ে দাও। আমি পাঁচ বছরে দেশটিকে মালয়েশিয়ার কাছাকাছি পৌঁছে দিব।’ জিজ্ঞেস করলাম, কিভাবে? জাহিদের একটি মাত্র ফর্মূলা, ‘আধুনিক যোগাযোগ ব্যবস্থা গড়ে তুলে।’ ব্যবসা-বাণিজ্যে লেখাপড়া শেষ করে জাহিদ কুয়ালালামপুর বিশ^বিদ্যালয়ে মালয়েশিয়ার উন্নয়ন নিয়ে পিএইচডি করছিলেন। জাহিদ বলেন, ‘মালয়েশিয়ার উন্নয়নের প্রথম সোপান হচ্ছে থাই সীমান্ত পাদাও থেকে কুয়ালালামপুর হয়ে সিঙ্গাপুর পর্যন্ত সাড়ে ৮শ’ কিলোমিটার আধুনিক হাইওয়ে। তখনও মালয়েশিয়া অর্থনৈতিকভাবে সমৃদ্ধ হয়ে উঠতে পারেনি। রাস্তাটি তৈরি করতে মালয়েশিয়া সরকারকে অনেক কষ্ট করতে হয়েছে। বিদেশ থেকে ঋণ নিতে হয়েছে। জাতীয় বাজেট থেকে একটি বড় অংশ রাস্তায় বিনিয়োগ করতে হয়েছে। এরপর আর মালয়েশিয়াকে পিছনে ফিরে তাকাতে হয়নি।’ জাহিদের মতে, ‘এই হাইওয়ের মাধ্যমে মালয়েশিয়ার উত্তর-দক্ষিণ প্রান্তের মানুষের মধ্যে সেতুবন্ধন তৈরি হয়েছে। গ্রাম-গ্রামাঞ্চলের উৎপাদিত ফসল, প্রত্যন্ত অঞ্চলে অব্যবহৃত প্রাকৃতিক সম্পদ খুব সহজে পৌঁছে যাচ্ছে দেশের এক প্রান্ত থেকে অপর প্রান্তে। পরে মালয়েশিয়ায় এমন আরও অনেক আধুনিক হাইওয়ে তৈরি হয়েছে। যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়নে বদলে গেছে মানুষের আর্থ-সামাজিক অবস্থা। বাড়ছে শিক্ষিতের হার। দ্রুত বাড়ছে দেশের জিডিপির আকার। গড়ে উঠছে কল-কারখানা। আয় বাড়ছে মানুষের। তখন পাল্টে গেছে মালয়েশিয়ার চিত্র। গুরুত্বপূর্ণ এলাকাগুলো সাজানো হয়ে গেছে। নির্মাণযজ্ঞ ছড়িয়ে পড়েছে শহর থেকে গ্রামে।’ আজ থেকে ২২ বছর আগে মালয়েশিয়ান যুবক জাহিদ বাংলাদেশের যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়ন করে বাংলাদেশকে উন্নত দেশ করতে চেয়েছিলেন। এখন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা অনেকটা এগিয়ে গেছেন এই কাজে। উন্নয়নের জন্য মালয়েশিয়ার মানুষ যেমন মাহাথির মোহাম্মদকে সময় দিয়েছিল, তেমনি শেখ হাসিনাকে সময় দিয়েছে বাংলাদেশের মানুষ। ২০০৯ সালে ক্ষমতা গ্রহণ করে তিনি গত ১৩ বছরে দেশকে এগিয়ে দিয়েছেন অনেক দূর পর্যন্ত। বিশ্লেষণ করলে দেখা যাবে, উন্নয়নের মূলমন্ত্র দেশের যোগাযোগ ব্যবস্থা। আদিকাল থেকে বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চল ছিল অবহেলিত, মঙ্গাকবলিত। যমুনা নদীতে বঙ্গবন্ধু সেতু বদলে দিয়েছে দেশের উত্তরাঞ্চলের চিত্র। এখন অপেক্ষা দেশের দক্ষিণাঞ্চলের। পদ্মা সেতু খুলে দেয়া হলে দ্রুত পাল্টে যাবে দেশের দক্ষিণাঞ্চলের চিত্র। প্রস্তুতি না নিয়ে তৈরি করায় যমুনা সেতু সুফল পেতে সময় লেগেছে বেশ কয়েক বছর। প্রস্তুতি বলতে দুই পাশে সড়ক পথ তৈরি ছিল না। সড়কের সহজ যোগাযোগে যমুনা বহুমুখী সেতুর ফল পাওয়া যাচ্ছে শতভাগ। পদ্মা সেতু তৈরি হয়েছে প্রস্তুতি নিয়ে। সেতু তৈরি শেষ হবার আগেই উদ্বোধন করা হয়েছে রাজধানী থেকে সেতু পর্যন্ত এবং সেতু থেকে ভাঙ্গা পর্যন্ত আধুনিক রাস্তা। ভাঙ্গা ইন্টার সেকশন থেকে ভাগ হয়ে রাস্তা চলে গেছে দেশের দক্ষিণাঞ্চলীয় সকল জেলায়। পদ্মা সেতু চালু হবার পর থেকেই মানুষ এর সুফল পেতে শুরু করবে। দেশের অর্থনীতিতে যোগ হবে নতুন মাত্রা। বাড়বে জিডিপি। শুধু পদ্মা সেতু নয়, দেশে চলছে অন্তত এক ডজন মেগা প্রকল্পের কাজ। এর মধ্যে রাজধানীতে শেষ হবার পথে মেট্রোরেল প্রকল্প-৬। এর কাজ শেষ হলে উত্তরা থেকে ঘণ্টায় ৬০ হাজার মানুষ কমলাপুর পর্যন্ত চলাচলের সুযোগ পাবে। বাঁচবে মানুষের লাখ লাখ কর্মঘণ্টা, যা বর্তমানে যানজটের কারণে নষ্ট হচ্ছে। অর্থনীতিতে এর ইতিবাচক প্রভাব পড়তে বাধ্য। গাজীপুর-বিমানবন্দর বিআরটি প্রকল্প, বিমানবন্দর-কুতুবখালী এক্সপ্রেসওয়ে, বিমানবন্দর-সাভার ইপিজেড এক্সপ্রেসওয়ে প্রকল্পের কাজ শেষ হলে এই এলাকা যানজটমুক্ত হবে। এর বাইরেও রয়েছে মেট্রোরেলের আরও ৫টি প্রকল্প। পর্যায়ক্রমে এসব প্রকল্পও বাস্তবায়ন হবে। মেট্রোরেল প্রকল্পগুলো বাস্তবায়ন হলে রাজধানীতে পাওয়া যাবে আন্তর্জাতিক শহরের আমেজ। কুড়িল থেকে রূপগঞ্জ পর্যন্ত তিনশ’ ফুট রাস্তা তৈরির কাজও প্রায় শেষের পথে। চট্টগ্রামে নির্মাণ হচ্ছে কর্ণফুলী টানেল। প্রকল্প দুটি চালু হলে যানবাহন চলাচলের সুবিধা বৃদ্ধির পাশাপাশি আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বাংলাদেশের আয়না হিসেবে কাজ করবে। রাষ্ট্রীয় ইমেজ বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে বাড়বে বিদেশী বিনিয়োগ। দেশজুড়ে চলছে সড়ক-মহাসড়কে উন্নয়ন কাজ। কোন সড়ক চার লেন থেকে ৬ লেন করা হচ্ছে। কোনটি করা হচ্ছে চার লেনে উত্তরণ। এসব প্রকল্পের মাধ্যমে আগামী কয়েক বছরে পাল্টে যাবে দেশের যোগাযোগ ব্যবস্থার চিত্র। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, যোগযোগ ব্যবস্থা উন্নয়নে শেখ হাসিনা সরকারের উদ্যোগের কোন ঘাটতি নেই। প্রকল্পগুলো নেয়ার আগে প্রয়োজন ছিল একটু সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনা। প্রকল্পগুলো এমনভাবে নিতে হবে যাতে আগামী একশ’ বছর আর হাত দিতে না হয়। বাস্তবায়নাধীন ছয় বা চার লেন সড়ক নির্মাণ প্রকল্পগুলোকে আর একটু সংস্কার করে এক্সপ্রেসওয়ের মর্যাদা দেয়া যায়। এক্সপ্রেসওয়ের ধারণা হচ্ছে কোথাও ক্রসিং থাকবে না, রাস্তার পাশে থাকবে না হাটবাজার কিংবা বাসস্ট্যান্ড। যানবাহন কোথাও না থেমে গন্তব্যে পৌঁছতে পারবে। ফ্লাইওভার তৈরি না করেও শুধু কিছু ইউলুপ এবং সার্ভিস রোড তৈরি, রাস্তার ওপর থেকে বাসস্ট্যান্ড সরানো এবং রাস্তায় মানুষ ওঠার প্রতিবন্ধকতা তৈরি করেই ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কটিতে এক্সপ্রেসওয়ের সুবিধা দেয়া যেত। একইভাবে চট্টগ্রাম-কক্সবাজার হাইওয়ে, ঢাকা-ময়নসিংহ হাইওয়ে, ঢাকা-টাঙ্গাইল হাইওয়েসহ নির্মিত চার লেনের সকল সড়ক একই ব্যবস্থায় এক্সপ্রেসওয়ে করা যায়। এজন্য হয়ত বাড়তি কিছু অর্থ ব্যয় হবে, যা কোনভাবেই উড়াল সেতু নির্মাণের সমান নয়। এছাড়া নির্মাণাধীন ঢাকা বাইপাস, ঢাকা-সিলেট চার লেন, সিরাজগঞ্জ-রংপুর চার লেন ইত্যাদি সড়কে একটু বাজেট বাড়িয়ে এক্সপ্রেসওয়ের মতো করা যায় খুব সহজে। শুধু প্রয়োজন একটু সুদূর প্রসারী পরিকল্পনা। সময় নষ্ট না করে দেশের সড়ক বিভাগ কর্তৃপক্ষ বিষয়টি ভেবে দেখবেন। যেভাবে রাস্তাকেন্দ্রিক বাজার, শিল্প স্থাপনা, বাণিজ্যিক এলাকা গড়ে উঠছে আর কয়েক বছর পর চাইলেও এই ধারণা বাস্তবায়ন সম্ভব হবে না। লেখক : ডেপুটি এডিটর, জনকণ্ঠ
×