ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

ঋতু বৈচিত্র্যে খেয়ালি প্রকৃতি

প্রকাশিত: ২১:৫৪, ২১ মে ২০২২

ঋতু বৈচিত্র্যে খেয়ালি প্রকৃতি

এবারের নববর্ষ শুরু হয়েছে খেয়ালি প্রকৃতি নিয়ে। বৈশাখী ঝড় হয়নি। তবে কয়েক হাজার মাইল দূরে মহাসাগরে সৃষ্টি হওয়া ঘূর্ণিঝড় ‘অশনি’ নাস্তানাবুদ করে ছেড়েছে। বৈশাখের লাল কৃষ্ণচূড়া জানান দিয়েছিল ধরণী আগুনের আভা পাবে। তা পেয়েছিলও। এর মধ্যে অশনির প্রভাবে সেই যে বৃষ্টি শুরু হলো তা সহজে থামছেই না। এই বৃষ্টি এই রোদ। মেঘমঞ্জুরির খেলা। আগাম বরষার নাচন। গ্রীষ্ম না বর্ষা ঠাহর করা যায় না। ঝড়ো বাতাসে উঠতি বোরো আবাদের জমিতে জলাবদ্ধতা কৃষকদের মাথায় বাজ ফেলেছে। ধান কাটার খেত মজুর মিলছে না। যাও পাওয়া যায় মজুরি চড়া। এর মধ্যেই জ্যৈষ্ঠে মধুমাস শুরু হয়েছে। আমের রাজধানী চাঁপাইনবাবগঞ্জ রাজশাহী থেকে আম ছড়িয়ে পড়েছে সারাদেশে। সাতক্ষীরা নওগাঁ রংপুরের আম বাজারে নেমেছে। মধুমাসের এই মধুফল আষাঢ় শ্রাবণ পার করে আশ্বিনে গিয়ে ঠেকে। লিচু নেমেছে। লিচু কম সময় বাজারে থাকে। কাঁঠালও নেমেছে। কাঁঠালের আরেক নাম এঁচোড়। কাঁচা এঁচোড়ে রান্না করা তরকারিকে বলা হয় গরিবের গোশত। পাকা জাম খেলে জিহ্বার রং আসে। তরমুজ বাঙ্গি বেল কতবেল লটকনসহ বাংলার মধু সংস্কৃতির মধুমাসের কত যে ফল। বাঙালীর ঐতিহ্যে গ্রামের মানুষ এখনও মধুমাসের মধুফল পাঠায় জামাই বাড়িতে। অনেকে মেয়ে-জামাইকে মধুফলের জন্য নাইওর আনে। হিন্দু ধর্মাবলম্বীরা মধুমাসের ফলফলাদি নিয়ে পালন করে জামাইষষ্ঠি। এবারের বৈশাখে দেখা মিলছে বর্ষার। ঋতু বৈচিত্র্যে আষাঢ়-শ্রাবণ বর্ষাকাল। অশনির থাবায় বর্ষা এবার আগাম আঘাত করেছে। নদীর পানি একটু করে বাড়ছে। আষাঢ়-শ্রাবণ পার করে ভাদ্র-আশ্বিনেও টেনে নিতে পারে। গত কয়েক বছর ধরে তাই ঘটছে। সময়ের ঋতু সময়ে থাকছে না। একেবারে ওলটপালট। এবারের বৈশাখ জ্যৈষ্ঠেই বর্ষার কাব্য শুরু হয়েছে মানব মনে। ঘরের কোনে লুকিয়ে থাকা ছাতি উঁকি দিয়ে গৃহবাসীর হাতে উঠেছে। জ্যৈষ্ঠে বর্ষার রূপ প্রকৃতিপ্রেমীদের আনন্দ দিয়েছে। বৃষ্টির রিমঝিম তালে মেঘেরা উচ্চ শব্দে মৃদঙ্গ বাজিয়ে বিদ্যুত তীব্র ঝলক দিয়ে বর্ষাকে আগাম ডেকে এনেছে। মেঘ বৃষ্টি রোদের ধ্রুপদ ছন্দ। কখনও অবারিত বারিধারা। ঋতু ক্যানভাসে রোমান্টিকতা ও মধুর বেদনা এঁকে দিয়েছে। মেঘেদের ক্লাসিক্যাল নাচনে যে কত ব্যঞ্জনা! বৃষ্টিতে মানব হৃদয়ের ভাবাবেগ অতি দ্রুত ছুটে ব্যাকুল করে দেয়। মধুর বেদনাও চোখের কোন থেকে অশ্রুর স্রোতরেখায় ঠোঁটের প্রান্তে পৌঁছে। বৃষ্টির নূপুরের ধ্বনীতে দূরে ও কাছে অনুভবে হৃদয় দিয়েই হৃদয়ের কাছে চলে যাওয়া। বৃষ্টিতে মানুষ ও প্রকৃতিও যেন একাকার হয়ে যায়। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ বর্ষাকে খুব কাছে থেকে দেখেছেন। বৈষ্ণব কবিরা বলেছেন বর্ষাভিসার। কত কথা বর্ষাকে নিয়ে। ডাহুকের ডাকে হৃদয় ভেঙ্গে যায় কোন বিরহীর। এর মধ্যেই হলুদ বরণ গায়ক দল (ব্যাঙ) হেড়ে গলায় ঘ্যাঙর ঘ্যাঙর সুর তোলে। মন্দ লাগে না। পুরাণের কথা কালো মেঘ দেখে কৃষ্ণকে মনে পড়ে যায় রাধার। কত না আবেগে বারিধারাকে মাথায় নিয়ে নীপ বনে ছুটে যায় কৃষ্ণের কাছে। কবিগুরু লিখেছেন ‘এসো নীপবনে ছায়া বিথী তলে এসো করো স্নান নবধারা জলে...’। বর্ষার প্রতীকী ফুল কদম এখনও ফোটেনি। তার আগেই নীপ (কদম) বনের সুর ভেসে আসছে। টানা বৃষ্টি ধান ক্ষেতে জলের মাতামাতি বৃষ্টি ভেজা পাখির অবিরাম ডেকে যাওয়া কোন এক সুদূরের ডাক নিয়ে আসে হৃদয়ের মধ্যিখানে। আকাশজুড়ে ভেসে আসে নানা বর্নের মেঘ। মেঘমেদুর, মেঘপুষ্প, জলদ, মেঘাগম, মেঘবহ্নি, মেঘযামিনী, জলধর মেঘগুলোই বেশি ভাসে। মেঘের আরেক পারেই রঙধনু। জলেভেজা কেতকি (কেয়া) দূর থেকে সুবাস এনে দেয়। গ্রামের ঝাউবনে, বাঁশ বাগানে, নদী তীরে চর এলাকায় ফোটে নাম না জানা কত বনফুল। যা দৃষ্টিতে এসে মন রাঙ্গিয়ে দেয়। বর্ষা না আসতেই গ্রামের জলাশয়ে নদীতে জেলেরা মাছ ধরতে নেমেছে। কিশোররা ঠেলা জাল নিয়ে ঘুরছে। সুযোগ পেলেই মাঝ ধরতে কাদা পানির মধ্যে জাল ঠেলছে। বৃষ্টির মধ্যে কেউ ছিপ (বড়শি) ফেলেছে। প্রকৃতি নিয়ে যত গান রচিত হয়েছে তার মধ্যে বরষা এগিয়ে। উপমহাদেশের বড় শিল্পীরা বর্ষাকেই আবেগের সুরে টেনে এনেছেন বেশি। যেমন হেমন্তের কণ্ঠে ‘এই মেঘলা দিনে একলা ঘরে থাকে না তো মন, কাছে যাব কবে পাব ওগো তোমার নিমন্ত্রণ..’। সতীনাথের কণ্ঠে ‘এলা বরষা যে সহসা মনে তাই রিমঝিমঝিম গান গেয়ে যাই...’। লতা মঙ্গেশকরের কণ্ঠে ‘আষাঢ় শ্রাবণ মানে নাতো মন ঝর ঝর ঝর ঝর ঝরেছে তোমাকে আমার মনে পড়েছে..’। সাবিনা ইয়াসমিনের কণ্ঠে ‘বরষার প্রথম দিনে ঘন কালো মেঘ দেখে আনন্দে যদি কাঁপে তোমার হৃদয় সেদিন তাহার সঙ্গে করো পরিচয়..’। এবারের গ্রীষ্ম বর্ষার গানের সুর তুলে এনেছে। প্রকৃতি এভাবেই মানুষকে কাছে টেনে আনে। সেই রঙের ধারাতেই এসেছে রঙধনু। রঙধনুর কয়টি রং এ নিয়ে বিতর্ক সেই আাদিকাল হতে। বিজ্ঞানের ব্যাখ্যা- রঙধনু সৃষ্টি হয় পানির ফোটায় সূর্যালোকে। বৃষ্টির কনা জলীয় বাষ্প মিশ্রিত বাতাসের মধ্য দিয়ে সূর্যের আলো যাওয়ার সময় আলোর প্রতিসরনে বর্ণালীর সৃষ্টি। বর্ণালীর ভাগ হয়ে যায় কয়েকটি রঙে। ধনুকের মতো বাঁকা হয়ে আকাশে নেতিয়ে পড়ে। নিউটন এসে জানান রঙধনুর রং ৭টি। একবিংশ শতকের বিজ্ঞানীরা বলছেন, রংধনুর রং ৮টি। নির্দিষ্ট সময়ে পানির ফোটার মধ্যে আলোকরশ্মি কয়েকটি রঙে ৪০ থেকে ৪২ ডিগ্রী কোনে বাঁকা হয়ে একটি সারিতে অবস্থান নেয়। দেশে দেশে শিল্পীরা রঙধনু নিয়ে ছবি এঁকেছেন গান গেয়েছেন কবিতা লিখেছেন। বৃষ্টিতে ছাতা থাকবে না তা কি হয়। আকাশে মেঘ। বৃষ্টির আভাস। পথে বের হয়েছেন। সঙ্গে ছাতাটিও নিয়েছেন। বৃষ্টি ঝরা শুরু হলো। বাতাসও উঠল। ছাতাটি মেলে ধরলেন। হঠাৎ বাতাসের ধাক্কায় ছাতাটি গেল উল্টে। স্প্রিং খসে পড়ল। কিই না বিপাকে পড়তে হয় তখন। বৃষ্টিতে এমন অবস্থা অনেকেরই হয়েছে। গ্রামে রোদ বৃষ্টিতে ফসলের মাঠে কৃষকদের মাথায় থাকে মাথাল (বাঁশের কাঠিতে বোনা)। ছাতার বিকল্প হিসাবে এই মাথাল বাঙালী সংস্কৃতির একটি অংশ। কৃষকের মাথায় মাথাল ও লাঠি প্রাচীন আমলে রাজশাহী অঞ্চলের গম্ভীরা গানের সংস্কৃতিতে এসেছে। যা নানা-নাতির সংলাপে বড় একটি অংশ। বছরের অনেকটা সময় ছাতা ঘরের কোনেই থাকে। কোথাও ঝুলিয়ে রাখা হয়। আধুনিক ছাতা ফোল্ড করে আলমারি অথবা ওয়ার্ডরূপেও রাখা হয়। ধুলোও জমে। ছাতা মেললে ধুলা উড়িয়ে সোজা নাসিকায়। যাদের ধূলি এ্যালার্জি শুরু হয় হাঁচির উৎপাত। তবু ওই ছাতা নামের বস্তুটি হাতে না নিলেই নয়। বারিধারার দিন এসেই গিয়েছে। এর মধ্যেই গ্রামের মেঠো পথে ছাতা মেরামতকারী টাইকরদের হাঁক শোনা যায়- আছে ছেঁড়াফাটা কলপি বাঁকা স্প্রিং নষ্ট লাঠি ভাঙ্গা ছাতা। টনক নড়ে গৃহস্থ কিষাণ চাষী মজুরদের। কখন বৃষ্টি নামবে কেউ জানে না। নগরীতে সামান্য বৃষ্টিতেই রিকশাচালকরা চড়া ভাড়া দাবি করে। তখন মনে হয় বড় জলজটের মধ্যে হেঁটে বাড়ি পৌঁছা ভাল। এই অবস্থায় একমাত্র সাহায্যকারী বস্তুটির নাম ছাতা। একটা সময় ছাতার হাতল বাংলা ‘ঢ’ বর্ণের মতো বাঁকানো থাকত। বর্তমানে এই বাঁকানোকে কতই না দৃষ্টি নন্দন করে তোলা হয়েছে। ছাতার কাপড়েও এসেছে পরিবর্তন। এখন কালো কাপড়ের ছাতার সঙ্গে নানা বর্ণের কাপড় ব্যবহার হয়। কোন কাপড়ে নক্সাও থাকে। এবারের প্রকৃতিতে বৈশাখ এসেছে নানা রঙে নানা নক্সায় নানা বর্ণে। সমুদ্র হক, বগুড়া
×