ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

শাহ বুলবুল

লা চে, পেরু এবং গেরিলা যুদ্ধের অমীমাংসিত অধ্যায়

প্রকাশিত: ২১:৩০, ২০ মে ২০২২

লা চে, পেরু এবং গেরিলা যুদ্ধের অমীমাংসিত অধ্যায়

ডাক্তার আর্নেস্তো রাফায়েল গুয়েভারা দে লা সেরনা। জনযুদ্ধের ইতিহাসে যিনি অমরত্ব পেয়েছেন বিপ্লবী চে গুয়েভারা নামে। বাল্যবন্ধু আলবার্তো গ্রানাদোকে সঙ্গী করে আর্নেস্তো গুয়েভারা পেরুর মাটিতে প্রথমবারের মতো পা রাখেন ১৯৫২ সালের মার্চ মাসে। চিলি থেকে আতাকামা মরুভূমির কালমা ও চুকিকামাতা পেরিয়ে আর্নেস্তো গুয়েভারা স্পর্শ করেন পেরুভিয়ান শহর তাকনা। রাজধানী লিমায় পৌঁছার আগ পর্যন্ত অতিক্রম করেন তোরাতা, জুলিয়াকা, ইনকা অঞ্চল কুসকো, মাচুপিচু, হুনাকারামা এবং আন্দাহুয়াইলাস। এক পক্ষকালের বেশি দিন পর লিমা ত্যাগ করে যান পুকালপা। অবশেষে আসেন অনেক অনেক প্রতীক্ষিত ঠিকানাÑ সান পাবলো দে লরেতো গ্রাম। আমাজান নদীর পাড়ে জঙ্গল ঘেরা এই গ্রামের এক কোনেই আছে সান পাবলো কুষ্ঠ কলোনি। সান পাবলো দে লরেতো গ্রাম থেকে মাববো তামবো ভেলায় চড়ে লেতিসিয়ার উদ্দেশে পেরু ত্যাগ করেন জুনের শেষ সপ্তাহে যা কমরেড চে গুয়েভারার মোটর সাইকেল ডায়েরি নামে আজও ইতিহাসের এক দুঃসাহসিক বর্ণনা। বিপ্লবী চে গুয়েভারার সঙ্গে লাতিন আমেরিকার দক্ষিণা দেশ পেরুর সম্পর্ক আত্মার, রক্তের এবং মীমাংসাহীন এক গেরিলা যুদ্ধের। আর্নেস্তো গুয়েভারার বান্ধবী ও প্রথম স্ত্রী বিপ্লবী হিলদা বেনিতা গাদেয়া আকোস্তার মাতৃভূমি পেরু। চেÑহিলদা দম্পতি মেক্সিকোতে নির্বাসনকালে জন্ম নেয় তাদের একমাত্র কন্যা হিলদিতা। বিপ্লবী কন্যার জন্মভূমি মেক্সিকো হলেও পিতৃভূমি আর্জেন্টিনা এবং মায়ের সূত্রে সে একজন পেরুভিয়ান। এভাবেই হাতুন তাপাকের পেরু অবধারিত ভাগ্যের জোয়ারে মিশে গেছে আরেক সাহাসী গেরিলা যোদ্ধা চে গুয়েভারার সঙ্গে। ১৯৫৩ সালের ৭ জুলাই। ডাক্তার আর্নেস্তো গুয়েভারা বাল্যবন্ধু কার্লোস কালিসা ফেরার জরিলাকে সঙ্গী করে লাতিন আমেরিকায় তার চূড়ান্ত অভিযান শুরু করেন। এই অভিযানকালে তিনি সহযোদ্ধা কালিসা ফেরার জরিলাকে নিয়ে পুনরায় পেরুর মাটিতে পা রাখেন ১৯৫৩ সালের আগস্ট মাসে। লাতিন আমেরিকায় প্রথম অভিযানকালে চিলি পেরিয়ে পেরুর মাটি স্পর্শ করলেও এবার উত্তর দিক থেকে বলিভিয়া পেরিয়ে প্রবেশ করেন পেরুতে। লা পাজ থেকে কোপাকাবানার পথে তিতিকাকা পেরিয়ে অতিক্রম করেন পেরুর পুনো সীমান্ত। বিপ্লবী চে আরেকবার আসেন পেরুর ঘুমন্ত নগর কুজকো যা আজও প্রহেলিকার মতো অথচ আনমনা এক অভিমান নিয়ে তাকিয়ে রয় কতশত মাইল পাড়ি দিয়ে ফিরে আস এক বোহেমিয়ান অভিযাত্রীর পানে। কুজকো থেকে বোহেমিয়ান অভিযাত্রী পা রাখেন পাচাকুতির মাচু পিচু। লিমায় এসে আর্নেস্তো গুয়েভারা দে লা সেরনা দেখা করেন পেরুভিয়ান ডাক্তার হুগো পেস পেসেসতো এবং হুগোর সহকারী সেবিকা ঝোরাইদা বলুয়ার্তের সঙ্গে। এটাই লাতিন আমেরিকান দুজন মানব মানবীর দ্বিতীয় এবং শেষ দেখা। অনেকে মনে করেন, পেরুভিয়ান সেবিকা ঝোরাইদা বলুয়ার্তে ভবঘুরে আর্জেন্টাইন ডাক্তারের দেখা এমন একজন নারী যাকে তিনি মনে প্রাণে ভালোবাসতেন। জীবদ্দশায় তাদের আর কোন দিন মুখোমুখি দেখা না হলেও অব্যাহত ছিলো পরস্পরের পত্র যোগাযোগ। ইকুয়েডরের সঙ্গে পেরুর সীমান্ত অঞ্চল তুমবেস পেরিয়ে লা চে এবং জরিলা পা রাখেন বন্দরনগরী সান্তিয়াগো দে গুয়াইয়াকিল। ইকুয়েডরের বন্দর নগরী থেকে চে গুয়েভারার সহযোদ্ধা কালিসা ফেরার জরিলা জীবিকার সন্ধানে চলে যান ভেনেজুয়েলার পথে। কারাকাসের পথে না গিয়ে ভবঘুরে আর্জেন্টাইন চিকিৎসক আর্নেস্তো গুয়েভারা পানামা, কোস্তারিকা, নিকারাগুয়া, হনডুরাস সীমান্ত আর এল সালভাদোর অতিক্রম করে পৌঁছে গেলেন রক্তভূমি গুয়াতেমালা। আরমাস বাহিনীর গুয়াতেমালা আগ্রাসনের পর লা চে চিয়াপাস পেরিয়ে মেক্সিকোতে আসেন ১৯৫৪ সালের ২১ সেপ্টেম্বর। মেক্সিকোর মাটিতেই দেখা হয় বিপ্লবী ফিদেল কাস্ত্রো এবং ফিদেলের ছোট ভাই রাউল কাস্ত্রোসহ অন্যান্য কিউবান বিপ্লবীদের সঙ্গে। ১৯৫৬ সালের শেষ দিকে গহীন চর লাস কলোরাদাসে গ্রানমা নোঙ্গরের মাধ্যমে শুরু হয় কিউবা আক্রমণ। রক্তহীম করা দীর্ঘ এক গেরিলা যুদ্ধের পর ১৯৫৯ সালের প্রথম দিন ঘোষিত হয় কিউবার বিজয়। পৃথিবী জানলো লা চে নামক এক লাতিন বীরের অমর বীরত্ব গাঁথা। কিউবা দ্বীপ জয়ের পর বিপ্লবী চে স্বপ্ন দেখতেন অমর এক গেরিলা যুদ্ধের লেলিহান আগুনে জ্বলবে সমগ্র লাতিন আমেরিকার দুঃশাসন। তিনি ডাক দিলেন মহাদেশীয় গেরিলা যুদ্ধের। যে যুদ্ধের রণহুঙ্কার প্রতিটি ঘরে পৌঁছে দিতে কমান্ডার চে গুয়েভারাকে আবার ফিরে আসতে হয়েছিলো ইনকা বীর আতাহুয়ালপার দেশ পেরু। ১৯৫৯ সালে কিউবায় সফল বিপ্লবের পর থেকেই বদলে যায় সশস্ত্র বিপ্লবে পেরুর ইতিহাস। আর্জেন্টাইন বিপ্লবী কমরেড চে গুয়েভারার চোখে স্বপ্ন পাতে বহুকাল অপেক্ষায় থাকা পেরুভিয়ান যোদ্ধারা। পুনো থেকে আয়াকুচো, আদিবাসী অধ্যুষিত সানদিয়া থেকে জঙ্গলঘেরা মালদোনাদো, কুজকো থেকে পাজকো পাহাড়, আধিপত্যবাদের ক্ষত চাপি থেকে সুদূর লা মার প্রদেশÑসর্বত্র শোনা গেছে গেরিলা যুদ্ধের রক্তাক্ত মহড়া। কমরেড চে গুয়েভারার মহাদেশী গেরিলা যুদ্ধ প্রকল্পের আওতায় ১৯৬২ সালে পেরুভিয়ান বিপ্লবীদের নিয়ে গঠিত হয় দুর্ধর্ষ দুটি গেরিলা বাহিনীÑএমআইআর এবং ইএলএন। পেরুভিয়ান রেভেল বাহিনীর কমান্ডার লুয়েস দে লা পুয়েন্তে উসেদাকে করা হয় এমআইআর’র প্রধান কমান্ডার। দে লা পুয়েন্তে উসেদার বাহিনী বিপ্লবী চে গুয়েভারার রণকৌশল ‘ফোকো’ নীতি অবলম্বন করে আক্রমণ পরিচালনা করেন। পেরুভিয়ান ফোকোরা সমগ্র দেশকে মানকো কাপাক, পাচাকুতি ও তুপাক আমরোÑ এই তিন ভাগে ভাগ করে লড়াই অব্যাহত রাখলেও ব্যর্থ হন আন্দিয়ান অঞ্চলের আদিবাসী কৃষকদের সমর্থন আদায়ে। ১৯৬৫ সালে পাচাকুতির অভিযানকালে মেসা পেলেদার গহীন জঙ্গলে লড়াইরত কমান্ডার লুয়েস দে লা পুয়েন্তে উসেদারকে হত্যা করে পেরুর সামরিক বাহিনী। উসেদারকে হত্যা ও লাশ গুম করা হলে ব্যর্থ হয় বিপ্লবী চে গুয়েভারার পেরু অভিযানের একটা পর্ব। বিপ্লবী চে গুয়েভারার পেরুভিয়ান ফোকোরা ব্যর্থ হলেও তার মহাদেশীয় গেরিলা যুদ্ধে ইএলএনকে বিবেচনা করা হতো পেরুভিয়ান গেরিলা যুদ্ধের ভিত্তি হিসেবে। বিপ্লবী জাভিয়ের হেরাউদ এবং আলাইন ইলিয়াসের অধীনে ইএলএন বিপ্লবী যোদ্ধারা কিউবা থেকে বলিভিয়ার জঙ্গলঘেরা পাহাড়ী অঞ্চল পেরিয়ে তাকনা সীমান্ত দিয়ে প্রবেশ করেন পেরু। বিপ্লবী চে গুয়েভারা পেরুভিয়ান গেরিলাদের যাতায়াতের জন্য এই পথটি বেছে নিয়েছিলেন কারণ পেরুর জঙ্গলঘেরা তাকনা অঞ্চলটি বলিভিয়া ছাড়াও চিলি এবং ব্রাজিলের সঙ্গে সংযুক্ত। পেরুর জঙ্গলে আচমকা পরাজয় বিপ্লবী চে গুয়েভারাকে কিছুটা বিচলিত করলেও তিনি পূর্বাভিজ্ঞতাকে মূল্যায়ন করে সিদ্ধান্ত নেন আরেকটি গেরিলা বাহিনী গড়ে তোলার। বৈঠক করেন পেরুভিয়ান গেরিলা যোদ্ধা নেস্তর গুয়েভারার সঙ্গে। মৃত কমরেডদের রক্তের শপথ নিয়ে গঠন করা হয় ‘জাভিয়ের হেরাউদ ব্রিগেড’। লড়াইয়ের কৌশল হিসেবে হেরাউদ বাহনীর ঘাঁটি স্থাপন করা হয় আয়াকুচোর গহীন জঙ্গলে। সরকারী বাহিনীর আনাগোনার কারণে ১৯৬৫ সালের এপ্রিলের দিকে আয়াকুচোর জঙ্গল থেকে ঘাঁটি সরিয়ে নেওয়া হয় কেচুয়া আদিবাসী অধ্যুষিত লা মার প্রদেশের গহীন বনাঞ্চলে। জুন মাস নাগাদ গেরিলা বাহিনী হাচিকানদা চৌরাস্তা দখলে নিয়ে একটি সেতু ধ্বংস করে ফলে সাতিপো মহাসড়ক ধরে জুনিন অঞ্চলের যোগাযোগ বিছিন্ন হয়ে যায়। আনদামারাকা এবং হুয়ারিনার যুদ্ধেও সরকারী বাহিনীকে পরাজিত করে কমরেড চে গুয়েভারার পেরুভিয়ান গেরিলা বাহিনী। এ সময় যোদ্ধারা লা মার প্রদেশের চাপি হাকিয়েন্দা দখল করে এবং ভূস্বামী দুই ভাইকে হত্যা করা হয় কারণ তারা স্থানীয় কৃষক ও শ্রমিকদের ওপর নির্মম নির্যাতন চালায়। চাপি হাকিয়েন্দা দখল ও ধনাঢ্য কারিলো ভাইদের হত্যার খবরে নড়েচড়ে বসে পেরুভিয়ান সেনাবাহিনী। তারা গেরিলাদের ছদ্মবেশে অবস্থান নেয় লা মারের চাপি হাকিয়েন্দায়। বিশাল সেনাবাহিনীর বিপরীতে গহীন জঙ্গলে অবস্থান নেয় মাত্র তেরোজন গেরিলা যোদ্ধা। ১৯৬৫ সালের ১৭ ডিসেম্বর, পেরুভিয়ান সেনাবাহিনীর একটি চৌকস দল সমগ্র বনাঞ্চল ঘিরে ফেলে। তিনকোজ পাহাড়ী জঙ্গলের কাছে সংঘর্ষ শুরু হলে সেনাবাহিনী তিনজন গেরিলাকে হত্যা করে এবং অন্য গেরিলা যোদ্ধারা ছিন্নভিন্ন হয়ে পালিয়ে যায়। আপাতত নিঃশেষ হয় পেরুভিয়ান গেরিলা যুদ্ধে বিপ্লবী চে গুয়েভারার আরও একটি স্বপ্ন। অনেককেই মনে করেন, বিপ্লবী চে গুয়েভারার ইচ্ছে ছিলো পেরুভিয়ান গেরিলা বাহিনীর সাথে কাঁধেÑকাঁধ মিলিয়ে অস্ত্রহাতে লড়াই করবেন আয়াকুচোর জঙ্গলে। যদিও লুমুমবা খুনের প্রতিশোধ স্পৃহায় ১৯৬৫ সালে শুরুতে লড়াই করতে চলে যান কঙ্গোর তাংগানিকার। মৃত্যুদেশ বলিভিয়ার মাটিতে পা রাখেন ১৯৬৬ সালের নবেম্বরে। লা পাজ থেকে কোচাবামবা হয়ে আসেন নাকাহুয়াজুর গেরিলা ঘাঁটিতে। আবার শুরু হয় বারুদমাখা গেরিলা যুদ্ধের এক অমর উপাখ্যান। বলিভিয়ায় এসে বিপ্লবী চে গুয়েভারার পাশে থেকে হাতিয়ার ধরেন পেরুভিয়ান গেরিলা যুদ্ধে বেঁচে ফেরা তিন কমরেড চ্যাং নাভারো, গালবান হিদালগো এবং জোসে কাবেরা। চে গুয়েভারার গেরিলা বাহিনীতে যাদের সাংকেতিক নাম যথাক্রমে চিনো, ইউস্তাকিয়ো এবং নেগ্রো মেদিকো। কমরেড চে গুয়েভারার মতোই বলিভিয়ান রেঞ্জার বাহিনী নির্মমভাবে হত্যা করে তিন পেরুভিয়ান গেরিলা যোদ্ধাকে যাদের সমাধি রয়েছে কিউবার সান্তাক্লারায় চে গুয়েভারার সমাধি সৌধের পাশেই। মূলত : বিপ্লবের রাজকুমার কমরেড চে গুয়েভারার সাথে তাঁর তিন পেরুভিয়ান কমরেডকে হত্যার মাধ্যমে চিরতরে নিভে যায় রক্তদাগা গেরিলা যুদ্ধের অমীমাংসিত পেরুভিয়ান অধ্যায়।
×