ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

ইফতেখার আহমেদ খান

দুর্বল প্রশাসনিক ব্যবস্থার শিকার

প্রকাশিত: ২১:০৮, ২০ মে ২০২২

দুর্বল প্রশাসনিক ব্যবস্থার শিকার

অপরিপক্ব গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থায় প্রজাতন্ত্রের কাজে প্রশাসন বা আমলাতন্ত্রই মূল ভূমিকা নেয় এবং এই প্রক্রিয়ায় প্রশাসন ক্রমান্বয়ে স্বেচ্ছাচারী হয়ে ওঠে। তাছাড়াও বাংলাদেশের মতো উপনিবেশোত্তর দেশগুলোর বাস্তবতায় দেখা যায়, এর প্রশাসনযন্ত্রটি ঔপনিবেশিক প্রশাসনের অযৌক্তিক অহং থেকে মুক্ত হয়নি এখনও। বস্তুত নিয়মের কাঠামোকে ডিঙ্গিয়ে ব্যক্তিপরিচয়ের মাধ্যমে কার্যসিদ্ধির প্রচেষ্টাটি একটি দেশের শাসনপ্রক্রিয়ার গুণগতমানকে প্রশ্নবিদ্ধ করে ফেলে। সাম্প্রতিক রেলমন্ত্রীর আত্মীয়ের কা-টি এরই একটি নমুনা। রেলমন্ত্রীর আত্মীয় পরিচয়ে বিনা টিকেটে রেলভ্রমণ সিস্টেমের একটি ব্যত্যয়, যা প্রশ্নবিদ্ধ করে সংশ্লিষ্ট দফতরের কার্যপ্রণালীর ধারাকে। দেখা যাচ্ছে যে, রেলমন্ত্রী প্রথমে একবাক্যেই না করে দেন যে ব্যক্তিসমূহকে তিনি চেনেন না। বিস্ময়কর বিষয় হলো অপরাধী ব্যক্তি ও ব্যক্তিসমষ্টি সাদা কাগজে টিটির বিরুদ্ধে একটি অভিযোগ দায়ের করে। ওই অভিযোগের ভিত্তিতে মুহূর্তে উক্ত টিটিকে বরখাস্ত করে দেয় তার দফতর। এটি একটি সামন্ত-প্রহসন। দাফতরিক বাস্তবতায় একজন ব্যক্তির বিরুদ্ধে কোন অভিযোগ করা হলে তার নামে একটি কারণদর্শানো নোটিস জারি হয়। সেই নোটিসের উত্তর অভিযুক্তকে লিখিত আকারে পেশ করতে হয়। লিখিত নোটিস গ্রহণ বা বর্জন যাই হোক তাকে একটি প্যানেলের সামনে বসে মৌখিক ব্যাখ্যাও দিতে হয়। এরপরই সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। মূল কথা হলো প্রক্রিয়াগতভাবে প্রমাণ থাকতে হয়। এই প্রক্রিয়ায় যে শুধু প্রশাসনিক শাস্তি হয় তা নয়, এ রকমই একটা প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে বিষয়ের সুরহা দাফতরিক ব্যবস্থাপনার একটি প্রতিষ্ঠিত রীতিধারা। এখানে কি ঘটল? প্রশাসন কিন্তু অপরাধী ব্যক্তির পক্ষে চলে গেল। সেই তিন অপরাধী যদি মন্ত্রীর আত্মীয় না হয়ে সাধারণ নাগরিক হতেন, তবে কি সেই অভিযোগ রেলদফতর আমলে নিত? নাকি এত দ্রুত সুরাহা করত? টিটি শফিকুল ইসলামের মনে তখন কি বিরাজ করছিল, যখন তারই দফতর অপরাধীর পক্ষ হয়ে তাকে অনৈতিক শাস্তির সিদ্ধান্ত দিয়ে ফেলল! অবশ্য বিষয়টি ইতিবাচক পরিণতির দিকে মোড় নিচ্ছে। উপায়হীন হয়ে মন্ত্রী বলছেন ওই টিটিকে তিনি পুরস্কৃত করবেন। ইতোমধ্যে তাকে চাকরিতেও পুনর্বহাল করা হয়েছে। এখানেই আমাদের সংবাদমাধ্যমগুলোর সার্থকতা পরিস্ফুট হয়। এ কারণেই সংবাদমাধ্যকে বলা হয় রাষ্ট্রের/সরকারের চুতর্থ অঙ্গ। আমাদের গ্রামীণ বাস্তবতায় ছৈয়দবাড়ি, খাঁ বাড়ি, চৌধুরীবাড়ি, ভূ ইয়া বাড়ি ইত্যাদি শব্দগুলো বহুল প্রচলিত। ওই বাড়ির সদস্যরা বাড়ির/বংশের পরিচয়ে নানবিধ সুবিধা আদায় করে, অন্যায় করে যা সনাতন সমাজের বৈশিষ্ট্য। উপনিবেশকালের বাস্তবতায় দেখা যেত জমিদারের বৌ, জমিদারের নাতি, জমিদারের আত্মীয় পরিচয়ে সমাজে একটি বিশেষ স্থান ও প্রভাব থাকত। রেলমন্ত্রীর স্ত্রীর আনীত ভূমিকাটি সেই ফেলে দেয়া সামন্তশাসনের একটি নমুনা মাত্র। এখন স্বাধীনসত্তা হিসাবে বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রের অভ্যুদয়ের প্রেক্ষাপট বিশ্লেষণে এটি একটি উদার-আধুনিক গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র। এই গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের প্রশাসনিক আচরণ যদি সামন্তশাসনের আদলে হয়, তবে এত দুঃখ-কষ্টের স্বাধীনতার মূল্য কোথায়। এই বিষয়টিকে একটি গণতান্ত্রিক সমাজের শাসনব্যবস্থায় প্রশাসনিক স্বচ্ছতা ও জবাবদিহির আলোকে উপস্থাপন করার প্রয়াস পাচ্ছি। আমাদের এই বিশ্ব সভ্যতা বহু বহু সময় অতিক্রম করে এসেছে। রাষ্ট্র হওয়ার আগের জীবন আর রাষ্ট্র হওয়ার পরের জীবনে বিস্তর তফাৎ। জন লকের মতে, প্রকৃতির রাজ্যে মানুষ স্বাধীনভাবে বসবাস করত। কোন কেন্দ্রীয় নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা সেখানে ছিল না। মানুষ ছিল সীমাহীন সুখের অধিকারী। মানুষ আরও অধিক কল্যাণ তথাপি আরও অধিক সুখ নিশ্চিত করার জন্য রাষ্ট্র গঠন করেছে। অপরদিকে টমাস হবস রাষ্ট্র গঠনে মানবের ভয়াবহ প্রকৃতি বিশ্লেষণ করেছেন। তার মতে, প্রকৃতির রাজ্যে মানুষ হানাহানি কাটাকাটি করে মরত। সেখানে না ছিল সুখ, না ছিল কল্যাণ। এই মানুষকে শাসনের জন্য নিয়ন্ত্রণ জরুরী। এই নিয়ন্ত্রণের জন্যই গঠিত হয়েছে রাষ্ট্র। এটাই হবসের ঐতিহাসিক সার্বভৌমত্ব তত্ত্ব। রাষ্ট্র সর্বজনীনভাবে সমষ্টির কল্যাণ নিশ্চিত করবে। মূলত রাষ্ট্র গঠন সভ্যতায় যত ঘটনা ঘটেছে, সেসবের মধ্যে সবচেয়ে আলোচিত ঘটনা। জীবনের কল্যাণ সাধনই রাষ্ট্রের মৌল উদ্দেশ্য। রাষ্ট্রের উৎপত্তিতে যত ধরনের মতভেদ আছে সবার মর্মমূলে রাষ্ট্র উদ্ভবের উদ্দেশ্যকে এই কল্যাণবোধকেই বেছে নেয়া হয়েছে। কল্যাণ শব্দটির অর্থ একাঙ্গিক নয়, এর রয়েছে বহু আঙ্গিক। সমতা, ন্যায়বিচার সুষম বণ্টন, নীতির সর্বজনীনতা, উপযুক্ত ব্যক্তির উপযুক্ত স্থান নির্ধারণ, শিক্ষার মর্যাদা প্রতিষ্ঠাকরণ, জনগণ মনোনীত শাসক ইত্যাদি সবই কল্যাণের অন্তর্ভুক্ত। শিল্পবিপ্লব পরবর্তী গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থাকে আমরা যতই বুর্জোয়া বলে গালমন্দ দেই, অন্তর্গতভাবে এর রয়েছে বহু মূল্যবান উপাদান মানবসত্তার মর্যাদা নির্ধারণে। গণতন্ত্র মানে জনগণ দ্বারা নির্বাচিত শাসক। রাষ্ট্রের ছোট লোক, বড় লোক, শিক্ষিত-অশিক্ষত যে শ্রেণীরই হোক সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ যাকে রায় দেবে সেই হবে শাসক। এটা একটা মানবতার প্রতিষ্ঠা, একটি জ্ঞানের প্রতিষ্ঠা। গণতন্ত্র একটি ব্যাপক জ্ঞান। সাদা চোখে এই জ্ঞানের ব্যবচ্ছেদ এবং এর গুণের উপলব্ধি সম্ভব নাও হতে পারে। বাংলাদেশ একটি পরিপূর্ণ গণতন্ত্রের দেশ। এই দেশের শাসনে প্রশাসনিক স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি (অফসরহরংঃৎধঃরাব ধপপড়ঁহঃধনরষরঃু ধহফ ঃৎধহংঢ়ধৎবহপু) একটি অপরিহার্য উপাদান সুশাসন নিশ্চিতকরণে। আধুনিক রাষ্ট্রীয় শাসনব্যবস্থায় পৃথিবীর সব দেশেই অবিরাম গতিতে লোক প্রশাসনের কর্মকা- ব্যাপকভাবে বিস্তার লাভ করেছে। এই ক্রমবর্ধমান প্রশাসনিক ক্ষমতার যদি নিয়ন্ত্রণ না থাকে, তবে গণতান্ত্রিক সরকার তার প্রকৃত লক্ষ্য অর্জনে ব্যর্থ হতে পারে। খ. উ ডযরঃব বলেছেন- গণতান্ত্রিক সমাজে ক্ষমতার নিয়ন্ত্রণ প্রয়োজন। সুশাসন প্রক্রিয়াকে জোরদার করতে হলে যে বিষয়টি একান্ত জরুরী, তা হচ্ছে প্রশাসনিক জাবাবদিহি ও স্বচ্ছতা। জবাবদিহির মাধ্যমেই জনগণ সরকারের স্বৈরতান্ত্রিক মনোবৃত্তি ও আচরণকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে। সুশাসনের জন্য প্রয়োজন প্রশাসনিক জবাবদিহি অর্জন। প্রশাসনিক স্বচ্ছতা হচ্ছে জবাবদিহিতার মাধ্যমে অর্জিত ফল। সরকারী সিন্ধান্ত গ্রহণ ও বাস্তবায়ন এবং সেগুলো কিভাবে ও কতটুকু জনগণের কল্যাণে আসবে সে সম্পর্কে পরিষ্কার ধারণা থাকা উন্নত গণতান্ত্রিক সংস্কৃতির বৈশিষ্ট্য। প্রশাসনিক স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি তাই জনগণের ও সরকারের মধ্যে পারস্পরিক সম্পর্কযুক্ত। আধুনিক সংগঠন তাত্ত্বিকদের মতে, যে কোন সংগঠনেরই একটি বাহ্যিক পরিম-ল থাকে, যার মধ্য থেকে সংগঠনটি নিয়ত পরিচালিত হয় ও গতিশীল থাকে। সেক্ষেত্রে সংগঠনটি হচ্ছে উপ-ব্যবস্থা, এর বাহ্যিক পরিবেশ হচ্ছে অতিব্যবস্থা। উপব্যবস্থা তার অতি-ব্যবস্থা থেকে উপাদান সংগ্রহ করে সংগঠনের মধ্যে প্রক্রিয়াজাত করে আবার অতিব্যবস্থায় ফেরত দেয়। উৎপাদিত এই উপাদান পরিবেশ কর্তৃক গ্রহণীয় বা বর্জনীয় হতে পারে। গ্রহণীয় হলে সংগঠন তার প্রক্রিয়া অব্যাহত রাখবে। আর যদি বর্জনীয় হয় সংগঠন পুনরায় বিবেচনা করবে এবং এর ত্রুটিসমূহ খুঁজে বের করবে। যেমন, বর্তমানের রেলকা-টির মাধ্যমে রেলদফতরের সম্মাননীয় মন্ত্রীর প্রশাসনিক আচার প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে, যা কাজ নয়। লেখক : উন্নয়নকর্মী
×