ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১

নাজনীন বেগম

শিশুদের সুস্থ-সুন্দর জীবন

প্রকাশিত: ২১:০৭, ২০ মে ২০২২

শিশুদের সুস্থ-সুন্দর জীবন

বাংলাদেশ উন্নয়নের ক্রমবর্ধমান অভিযাত্রায় সামনের দিকে ছুটে চলেছে। নাগরিকের পাঁচটি মৌলিক অধিকার অর্জনের মাত্রাও দৃষ্টিনন্দনভাবে ফুটে উঠছে। খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান, শিক্ষা এবং স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনাকে সার্বিক জনগোষ্ঠীর হাতের নাগালে পৌঁছে দিতে নান উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে। খাদ্যে আমরা স্বয়ংসম্পূর্ণই শুধু নই, বিশ্বে আমাদের অবস্থান নজর কাড়াও। আর বস্ত্র শিল্পে বাংলাদেশের আন্তর্জাতিক খ্যাতিই শুধু নয়, রফতানি বাণিজ্যে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন জাতীয় অর্থনীতির সমৃদ্ধ খাত। দেশের অবকাঠামোর উন্নয়ন প্রক্রিয়া যে মাত্রায় এগিয়ে যাচ্ছে তা বিস্ময়করভাবে আলোর মুখ দেখার অপেক্ষায়। শিক্ষা ব্যবস্থাপনায় করোনার চরম দুর্ভোগে অবরুদ্ধতার কঠিন জাল ফেলা হলেও বর্তমানে তা সামলানো সময়ের অনিবার্য চাহিদা। আবার করোনার প্রভাবে যে মাত্রায় স্বাস্থ্যখাতের অনিয়ম, দুর্নীতি ও নানামাত্রিক সঙ্কট উন্মোচন হয়েছে সেখান থেকে উত্তরণের নানা পদক্ষেপ নিত্যনতুন সম্ভাবনার ইঙ্গিত দিচ্ছে। সব মিলিয়ে দেশ হরেক রকম কর্মকা-ে, বহুমাত্রিক ধারায় চলমান রয়েছে। তবে জাতির ভবিষ্যত কারিগরদের জীবনমান বর্তমান সময়ে কোন্ পর্যায়ে সেটাও উঠে আসা অত্যন্ত জরুরী। ক্ষুদে প্রজন্ম গত ২ বছর যেভাবে স্থবিরতার চরম কোপানলে আবর্তিত ছিল সেখান থেকে নতুন সময় তাদের জন্য কতখানি অবারিত তাও ভাববার বিষয়। করোনার চরম দুঃসময়ে সবার আগে বন্ধ করে দেয়া হয় শিক্ষা প্রতিষ্ঠান সেই ২০২০ সালের ১৭ মার্চ থেকে। পরবর্তীতে আর কোন পরীক্ষাই শুধু নয়, শ্রেণী পাঠ নিয়েও পড়তে হয় এক প্রকার বিপন্নতার আবর্তে। প্রযুক্তির বিশ্বে নতুন করে যে শ্রেণী পাঠের সূচনা করা হয় তা মূলত সংশ্লিষ্টদের অভিজ্ঞতা এবং প্রশিক্ষণ ছাড়াই। যা শিক্ষক শিক্ষার্থী উভয়ের জন্যই প্রযোজ্য। শুধু তাই নয়, বিশেষ করে ক্ষুদে প্রজন্ম যাদের প্রযুক্তির বিশ্ব থেকে দূরে রাখাটাই উত্তম বলে বিবেচিত হতো সেখানে একরকম বাধ্য হয়ে অনলাইনে শিক্ষা কার্যক্রম চালানো হয়েছে। এতে সংশ্লিষ্টদের বিড়ম্বনাও বেড়েছে। এছাড়া করোনাকালে গৃহে আবদ্ধ থাকার কারণে শিশুদের শারীরিক ও মানসিক বিকাশেও প্রায় অচলাবস্থা দেখা দিয়েছে। খেলার মাঠ থেকেও স্বাস্থ্যবিধি রক্ষায় তাদের দূরে থাকতে হয়। আর মানসিক সমৃদ্ধির জন্য সংস্কৃতির পরিচর্যাও বাধাগ্রস্ত হতে সময় লাগেনি। সঙ্গত কারণে নতুন প্রজন্ম পিছিয়ে পড়তে থাকে বিভিন্ন প্রাসঙ্গিক কর্মকা- থেকে। গৃহবন্দী হয়ে থাকার কারণে অনলাইনভিত্তিক শ্রেণী পাঠে মনোযোগ দিতে গিয়ে তারা প্রযুক্তির প্রতি ক্রমাগত আসক্ত হয়ে পড়ে। ধারণা করা অমূলক ছিল না শিশু-কিশোরদের পাঠক্রমের চাইতেও বেশি নজর পড়েছে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের নেতিবাচক প্রতিক্রিয়ায়। করোনার কারণে সুস্থ সাংস্কৃতিকবোধও এক প্রকার অবরুদ্ধতার জালে আটকে পড়ে। কারণ সংস্কৃতি একটি চলমান ও গতিশীল প্রক্রিয়া। সেখানে নিয়তই পরিচর্যা ও পরিশীলিত মনোবৃত্তি সুস্থ সাংস্কৃতিক চর্চার নিয়ামক। সেটার ব্যত্যয়ে শুধু যে সংস্কৃতির অঙ্গহানি হয় তা কিন্তু নয়। তার চেয়েও বেশি বিপন্নতার শিকার হয় সমাজের আধুনিক ও নতুন প্রজন্ম। সংস্কৃতির প্রতিনিয়ত চর্চার সুফলে জাতির যে মনোবিকাশ সেটাও করোনার চরম দুর্বিপাকে অসহনীয় অবস্থায় ঠেকে। বাংলাদেশ এই মুহূর্তে উন্নয়নশীল একটি রাষ্ট্র। উন্নয়নের ক্রমবর্ধমান অভিযাত্রায় নানামাত্রিক সঙ্কটও মাথাচাড়া দিয়ে উঠতে সময় লাগে না। এটা শুধু বাংলাদেশ নয়, সারা পৃথিবীর উন্নয়ন কর্মযজ্ঞের অবশ্যম্ভাবী গতি প্রকৃতি। সেই অষ্টাদশ শতাব্দীতে ইংল্যান্ডের শিল্প বিপ্লব নতুন আবিষ্কারে সমাজে অনেক কিছু উপহার দিলেও তার নেতিবাচক প্রক্রিয়ায় বিভিন্ন প্রকার অসঙ্গতিও দৃশ্যমান হতে থাকে। সামাজিক ন্যায়নীতি অনাচারের পর্যায়ে জনগোষ্ঠীকে বিব্রতকর অবস্থায় ফেলে দেয়। নারী নির্যাতন বেড়ে যায়, কিশোর অপরাধ সহিংস অবস্থায় রূপ নেয়- আত্মহত্যার মাত্রা বৃদ্ধি পাওয়ার অস্বস্তিকর চিত্র সমাজবদ্ধ মানুষকে ভাবিয়ে তোলে। বিভিন্ন সমাজ গবেষক ও বিজ্ঞানী এমন সব সামাজিক অসাম্য বৈষম্যের প্রতিকার খুঁজতে গিয়ে অনেক গবেষণালব্ধ তথ্যও হাজির করেন। বিভিন্ন তথ্য উপাত্তে প্রতীয়মান হতে থাকে প্রযুক্তিকে মানুষ যত তাড়াতাড়ি আয়ত্তে আনতে সক্ষম হয় সে তুলনায় চেতনা সেভাবে এগিয়ে যেতে পারে না। ফলে নিত্যনতুন বৈজ্ঞানিক আবিষ্কারের সঙ্গে দ্বন্দ্ব বিরোধ তৈরি হয় প্রচলিত সংস্কার আর মূল্যবোধের। সেই অষ্টাদশ শতাব্দীতে নজির হিসেবে উপস্থাপন করা হয়Ñ পরিবার পরিকল্পনার ওষুধ আবিষ্কার হলেও তা গ্রহণ করার অনীহার কারণে জন্মনিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি সফল হতে বার বার হোঁচট খেয়েছে। বিশেষ করে আমাদের মতো তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোতে। বর্তমান সময়েও প্রযুক্তির সুফলের চাইতে গ্রহণ করার মানসিকতার অভাবের কুফলই বেশি দৃশ্যমান হচ্ছে। বিশেষ করে ক্ষুদে ও কিশোর প্রজন্মের প্রযুক্তির বিশ্বে আসক্তি বাড়াটা কতখানি বিপজ্জনক হয়েছে তা সত্যিই দুর্ভাগ্য। নতুন প্রজন্ম বৈজ্ঞানিক আবিষ্কারকে যথার্থভাবে কাজে না লাগিয়ে তার বিপরীত প্রবাহে আসক্ত হয়ে পড়ায় সমস্যা ঘনীভূত হতে দেরি হয়নি। তার ওপর করোনার কারণে খেলার মাঠে যাওয়া থেকে শুরু করে সুস্থ সাংস্কৃতিক চর্চার উপরও পড়ে এক অনাকাক্সিক্ষত দুর্ভোগ। সার্বিক পরিস্থিতিতে শিশু-কিশোরদের শারীরিক ও মননচর্চায় এসেছে এক চরম অভিঘাত। যার দূষণ থেকে বের হয়ে আসতে নতুন করে সব ধরনের মনন বিকাশের উপকরণগুলো নবউদ্যমে শিশুদের নজরে নিয়ে আসাও সংশ্লিষ্ট অভিভাবকদের অপরিসীম দায়বদ্ধতা। দেশের ভাবি ও উদীয়মান প্রজন্ম যদি তার গড়ে ওঠার স্বাভাবিক গতি প্রবাহ থেকে ক্রমাগত বঞ্চিত হতে থাকে তাহলে স্বপ্নের সোনার বাংলা ও প্রযুক্তির আধুনিক বাংলাদেশ গড়ার সম্ভাবনাও পিছিয়ে যাবে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার মিলিত স্বপ্নের যে অনন্য বাংলাদেশ তাকে অভীষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছাতে গেলে শিশু-কিশোরদের জীবন গড়ার সম্ভাবনাময় দিকনির্দেশনা তাদের সামনে নিয়ে আসতে হবে। জাতি হিসেবে আবহমান বাংলার যে চিরায়ত বৈভব আর ঐশ্বর্য তা এই অঞ্চলের এক অভাবনীয় সম্ভার। যা এদেশের মানুষের সার্বিক জীবন ও মনন চর্চার সমৃদ্ধ অনুষঙ্গ। সেখানে শরীর ও মনোবিকাশের চমৎকার উৎসগুলো অবিমিশ্র হয়ে আছে। শ্যামল বাংলার নদ-নদীর অববাহিকায় সবুজ প্রান্তর যে মাত্রায় স্নিগ্ধতার পরশ বুলিয়ে দেয় সেখান থেকেই কোলের সন্তানরা জীবন-যাপনের অন্যতম উপাদানগুলো খুঁজে পায়। যান্ত্রিক সভ্যতার ক্রমোন্নয়নে সবুজ প্রকৃতি তার স্বভাবজাত বৈশিষ্ট্য কোন এক সময় হারাতে বসে। উচ্ছ্বল, অবারিত, সুষম প্রকৃতি বৈজ্ঞানিক আবিষ্কারের নেতিবাচক প্রতিক্রিয়ায় উন্মুত্ত আস্ফালনে চিরায়ত নৈসর্গিক সম্ভারকে বিপর্যস্ত করতে উদ্যত হয়। ক্রমাগত কার্বন নিসরণের বিধ্বস্ততায় সুষম প্রকৃতি নিঃস্ব অসহায় হয়ে পড়ে। চরম উষ্ণতায় বিশ্বজুড়ে যে অসহনীয় দাবদাহ তাতে কোমল প্রকৃতি তার অকৃত্রিম দানকে বিপন্নতার আবর্তে ঠেলে দেয়Ñ যা সর্বমানুষের জন্য চরম অশনিসঙ্কেত। আর ক্ষুদে ও নতুন প্রজন্ম জীবন গড়ার শুরুতেই যে অভিঘাতের মুখোমুখি হয় তাতে স্বাভাবিক গতিপ্রবাহ বিপরীত দিকে মোড় ঘুরে যায়। যা শুধু শারীরিক বিপর্যয়কে ডেকে আনে তা কিন্তু নয়, মানসিক বিকাশকেও নানা মাত্রিকে অসহনীয় করে তোলে। শরীর স্বাস্থ্য দুর্বল হয়, মননচর্চা বিপত্তির আবর্তে পড়ে। জীবন তৈরির সুস্থ ও স্বাভাবিক উপকরণের অপর্যাপ্ততায় শিশু-কিশোররা পথভ্রষ্ট হয়। লক্ষ্যচ্যুত হওয়ার আশঙ্কাও দেখা দেয় পদে পদে। এখান থেকে বের হয়ে আসতে গেলে স্বাভাবিক কর্মপদ্ধতিকে পুনরায় জাগিয়ে তোলা ছাড়া আর কোন পথ খোলা থাকে না। অবকাঠামোর দৃশ্যমান উন্নয়নে সারাদেশ এখন বিক্ষিপ্ত কর্মপ্রকল্পে অনেকটাই নেতিবাচক প্রতিক্রিয়ায় আবর্তিত। রাস্তাঘাটের চরম অব্যবস্থাপনায় স্বাভাবিক চলাফেরা এখন বিপন্নতার আবর্তে। বহুতল ভবন নির্মাণের হিড়িকে খোলা, উন্মুক্ত প্রান্তর দেখাই যায় না। খেলার মাঠও অনিশ্চয়তার কবলে। ফলে শিশু-কিশোরদের শরীরচর্চা ও মনন বিকাশে হরেক রকম বিপত্তি মাথাচাড়া দিয়ে উঠছে। জনসংখ্যা বাড়ছে। পাল্লা দিয়ে ভবন, গাড়ি ও অন্যান্য সামগ্রী বেড়ে যাওয়ার দৃশ্য চমৎকৃত হওয়ার মতোই। তবে যা সব থেকে জরুরী সেই জায়গা কিংবা স্থান একেবারেই সীমিত। শুধু তাই নয়, কমে যাওয়ার চিত্রও দুর্ভাগ্যজনক। তাহলে দেশের আগামীর প্রজন্ম সুস্থ ও স্বাভাবিকভাবে বেড়ে ওঠার সুসংহত চিত্র নিয়ে নতুন করে ভাবতে হবে। বহুতল ভবনের আশপাশে কিছু জায়গাজুড়ে খেলার মাঠ তৈরি করা নতুন প্রজন্মের জন্য অত্যাবশ্যক। আর সাংস্কৃতিক চর্চার সুষ্ঠু পরিবেশও যেভাবেই হোক আয়োজন করতে হবে। বিশেষ করে গান, কবিতা, নাটক, উপস্থিত গল্প বলা যা এক সময় শিক্ষা-প্রতিষ্ঠানই আয়োজন করতো, তাকে নতুন মাত্রা দেয়াও আবশ্যক। দেশ ও জাতি গড়ার এমন সব কর্মপ্রকল্প শিশু-কিশোরদের জন্য উন্মুক্ত করে দেয়াও সচেতন দায়বদ্ধতা। আর পরিবার থেকেই এমন সব মানসম্মত উপকরণগুলো সন্তানদের সামনে নিয়ে আসতে হবে সীমিত পরিসরে। পরবর্তীতে বৃহত্তর সামাজিক অঙ্গনেও তার বহুবিধ সম্প্রসারণে সংশ্লিষ্টদের যথাযথ উদ্যোগ ও ভূমিকা দেশের ভাবি কর্ণধারদের উপযুক্ত ও যোগ্য নাগরিক হিসেবে গড়ে তুলতে নিয়ামক শক্তি হিসেবে বিবেচিত হবে। শুধু প্রাতিষ্ঠানিক জ্ঞান অর্জন নয়, সৃজন ও মনন দ্যোতনায় সম্পৃক্ত হয়ে পরিপূর্ণ মানুষ হবার সাধনায় সর্বশক্তি নিয়োগ করতে হবে। লেখক : সাংবাদিক
×