বিশেষ প্রতিনিধি/স্টাফ রিপোর্টার, কক্সবাজার ॥ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দেশের পর্যটন এলাকাগুলোতে পর্যটকদের জন্য সব ধরনের সুযোগ সুবিধার ব্যবস্থার পাশাপাশি প্রাকৃতিক সৌন্দর্য রক্ষার তাগিদ দিয়ে বলেছেন, তার সরকার কক্সবাজারের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য এবং জীববৈচিত্র্য অটুট রেখে এর সার্বিক উন্নয়ন নিশ্চিত করতে বিভিন্ন প্রকল্প বাস্তবায়ন করে যাচ্ছে। কক্সবাজারকে বিশ্বের অন্যতম প্রধান পর্যটন কেন্দ্রে পরিণত করা হবে। সে জন্য তিনি সবাইকে বিশেষ করে কক্সবাজারবাসীকে অপরিকল্পিত স্থাপনা নির্মাণ না করার অনুরোধ জানান।
বুধবার কক্সবাজার উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের নব-নির্মিত পরিবেশ-বান্ধব বহুতল ভবনের উদ্বোধন অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের এই ভূখণ্ড রক্ষায় সবার দায়িত্বের কথাও স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন। প্রধানমন্ত্রী গণভবন থেকে ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে কক্সবাজারের বীর মুক্তিযোদ্ধা মাঠে আয়োজিত গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয় এবং কক্সবাজার উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ আয়োজিত অনুষ্ঠানে ভার্চুয়ালি যুক্ত হন। তিনি বলেন, পর্যটকদের জন্য ব্যবস্থা থাকবে, সঙ্গে সঙ্গে প্রাকৃতিক সৌন্দর্যগুলো যেন নষ্ট না হয়।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, আমরা যদি বাংলাদেশের দিকে তাকাই তাহলে এই সমুদ্রসীমা, পাহাড় সবকিছু মিলিয়ে অত্যন্ত চমৎকার একটি ভূখণ্ড আমরা পেয়েছি, যেটা জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান আমাদের উপহার দিয়েছেন। এই ভূখ-কে আকর্ষণীয় করা, উন্নত করা এবং এর প্রাকৃতিক পরিবেশটা রক্ষা করা- এটা আমাদের সকলেরই একান্তভাবে প্রয়োজন।
কোভিড মহামারীতে পর্যটনের ক্ষতি হলেও এই সময়ে কক্সবাজারের ভিড় কমায় প্রকৃতি ও জীববৈচিত্র্যের জন্য ভাল কিছুও যে হয়েছে, সে কথা অনুষ্ঠানে তুলে ধরে সরকারপ্রধান বলেন, একটা উপকার আমরা পেয়েছি। যেহেতু কোন পর্যটক সেখানে যেতে পারে নাই, কক্সবাজারের হারিয়ে যাওয়া লাল কাঁকড়া, সেগুলো যেমন ফিরে এসেছে, কিছুদিন ডলফিনও দেখা গেছে। আমাদের কাছিমগুলো, তাদের প্রজনন ক্ষেত্র ছিল সেগুলোও কিন্তু হারিয়ে যাচ্ছিল।
সৈকতে লাল কাঁকড়ার বসবাসের জায়গা এবং কাছিমের প্রজননক্ষেত্রগুলো বেড়া দিয়ে সংরক্ষণ করতে কক্সবাজার উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যানকে নির্দেশ দিয়েছিলেন বলেও অনুষ্ঠানে জানান প্রধানমন্ত্রী। সেই নির্দেশনা অনুযায়ী কিছু কাজ ইতোমধ্যে সম্পন্ন হওয়ায় কক্সবাজার উন্নয়ন কর্তৃপক্ষকে ধন্যবাদ জানিয়ে শেখ হাসিনা বলেন, পর্যটকদের জন্য ব্যবস্থা থাকবে, সঙ্গে সঙ্গে প্রাকৃতিক সৌন্দর্যগুলো যেন নষ্ট না হয়।
ছোটবেলায় সৈকতে লাল কাঁকড়ার পেছনে ছোটার গল্প অনুষ্ঠানে শুনিয়ে বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা বলেন, কোনদিন ধরতে পারিনি। এরা এত চালাক থাকত, দৌড়াতে দৌড়াতে কখন যে গর্তে ঢুকে যেত, চেষ্টা করেছি বের করতে, কিন্তু কখনও পারিনি। এই স্মৃতিগুলো ভুলব কি করে। তিনি বলেন, দেশী-বিদেশী পর্যটকদের আকৃষ্ট করতে কক্সবাজারকে আন্তর্জাতিক মানের পর্যটন কেন্দ্র হিসেবে গড়ে তুলতে আশপাশের উন্নয়ন পরিকল্পনা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে ইতোমধ্যে একটি মাস্টার প্ল্যান তৈরি করার জন্য সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে নির্দেশ দেয়া হয়েছে।
তিনি বলেন, আমাদের বিশাল সমুদ্র সীমায় পর্যটনের ক্ষেত্র আরও প্রসারিত করার মাধ্যমে এই জায়গাটাকে দেশী-বিদেশী পর্যটকদের কাছে আকর্ষণীয় করার উদ্যোগ আমরা নিতে যাচ্ছি। তাছাড়া যেহেতু এটা আন্তর্জাতিক এয়ার রুটে পড়ে, তাই কক্সবাজার বিমানবন্দরকে একটি আন্তর্জাতিক মানের বিমানবন্দর হিসেবে প্রতিষ্ঠায় সরকারের কাজ চলমান রয়েছে। এই বিমানবন্দর যখন সম্পন্ন হবে তখন পশ্চিমা দেশগুলো থেকে প্রাচ্যে যাতায়াতকারী বিমানগুলো এখান থেকে রিফুয়েলিং করার মাধ্যমে এটি একটি রিফুয়েলিং কেন্দ্র হিসেবে গড়ে উঠবে বলেও তিনি আশাবাদ ব্যক্ত করেন।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, রিফুয়েলিংয়ে বিভিন্ন দেশ বিভিন্ন সময়ে অগ্রাধিকার পায়। এক সময় হংকং ছিল, এর পর থাইল্যান্ড অথবা সিঙ্গাপুর এখন দুবাই। কিন্তু এখন কক্সবাজারই হবে আন্তর্জাতিক আকাশ পথে রিফুয়েলিংয়ের একটা কেন্দ্র। পাশাপাশি এখানে তাঁর সরকার ক্রিকেট স্টেডিয়াম করেছে, ফুটবল স্টেডিয়ামও করার মাধ্যমে আন্তর্জাতিক খেলাধুলা আয়োজনের সব ধরনের ব্যবস্থা এখানে থাকবে। মেরিন ড্রাইভ যেটি কক্সবাজার থেকে টেকনাফ পর্যন্ত করা হয়েছে সেটা একেবারে চট্টগ্রাম পর্যন্ত করা হবে।
গৃহায়ন ও গণপূর্ত প্রতিমন্ত্রী শরীফ আহমেদের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠানে মন্ত্রণালয়ের সচিব মোঃ শহীদ উল্লাহ খন্দকার বক্তৃতা করেন। কক্সবাজার উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান লে. কর্নেল (অব) ফোরকান আহমেদ স্বাগত বক্তৃতা করেন। অনুষ্ঠানে কক্সবাজার উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের কর্মকা- এবং নব-নির্মিত ভবনের ওপর একটি ভিডিও চিত্র প্রদর্শন করা হয়।
তার সরকার ইতোমধ্যে কক্সবাজারে অনেকগুলো উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়ন করে যাচ্ছে উল্লেখ করে সরকার প্রধান মহেশখালী, কুতুবদিয়া, সোনাদিয়া, শাহপরীর দ্বীপ, সেন্ট মার্টিনসহ বিভিন্ন দ্বীপাঞ্চলের উন্নয়নে গৃহীত বিভিন্ন পদক্ষেপের উল্লেখ করেন। তিনি বলেন, আজকে মহেশখালীতে গভীর সমুদ্র বন্দর যেমন তৈরি হচ্ছে, বিদ্যুত কেন্দ্র তৈরি হচ্ছে এবং বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল গড়ে ওঠায় বিনিয়োগ হচ্ছে এবং একে একটি ডিজিটাল আইল্যান্ড হিসেবে ঘোষণা দেয়া হয়েছে। ভবিষ্যতে এই মহেশখালীর উন্নয়ন দেশীয় এবং আন্তর্জাতিকভাবে বিস্ময়ের সৃষ্টি করবে উল্লেখ করে তিনি বলেন, পাশাপাশি টেকনাফে বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চলের সঙ্গে এর সমুদ্র সৈকতও যাতে আন্তর্জাতিক মানের যাতে হয় সে পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে।
অতীতে জাতির পিতার সঙ্গে কক্সবাজার সফরকালে যোগাযোগ ব্যবস্থার দুরাবস্থার কথা স্মরণ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, কক্সবাজারবাসীর দীর্ঘদিনের দাবি অনুযায়ী দোহাজারি থেকে ঘুমধুম পর্যন্ত রেললাইন নির্মাণ এবং চমৎকার একটি রেলস্টেশন নির্মাণের কাজও এগিয়ে চলেছে। ঢাকা-চট্টগ্রাম হাইওয়ের ন্যয় কক্সবাজার অবদি হাইওয়ের কাজও চলছে। পাশাপাশি সিলেট থেকে কক্সবাজার সরাসরি বিমান চলাচল চালু হয়েছে। পর্যায়ক্রমে আমাদের অন্যান্য অঞ্চল যেমন বরিশাল, রাজশাহী এবং সৈয়দপুরসহ যতগুলো বিমানবন্দর রয়েছে সেখান থেকে কক্সবাজারের সঙ্গে সরাসরি বিমান চলাচল চালুর বিষয়ে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে ইতোমধ্যেই তার নির্দেশ প্রদানের কথা জানান প্রধানমন্ত্রী।
তিনি বলেন, কক্সবাজারে একটি বেসরকারী বিশ^বিদ্যালয় স্থাপনের অনুমোদন সরকার দিয়েছে, সেখানে একটি মেডিক্যাল কলেজ করা হয়েছে, হাসপাতাল স্থাপনের পাশাপাশি উন্নতমানের কনভেনশন সেন্টার এই কক্সবাজারেই করা হবে। যাতে যে কোন ধরনের সেমিনার-সিম্পোজিয়াম সেখানে আয়োজনের পাশাপাশি পর্যটকদের জন্যও আকর্ষণীয় হয়।
কক্সবাজারে ‘সি এ্যাকুরিয়াম’ প্রতিষ্ঠার কথা পুনরোল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, এদেশে এ ধরনের এ্যাকুরিয়াম পরিচালনায় দক্ষ জনবলের অভাব থাকায় তার সরকার এ ব্যাপারেও কাজ করে যাচ্ছে। তিনি এ সময় ’৯১ সালের ঘূর্ণিদুর্গতদের কক্সবাজার খুরুশকুলে আশ্রয়ণ প্রকল্পের আওতায় বহুতল ফ্লাট বাড়ি নির্মাণ করে দেয়ার কথাও উল্লেখ করেন। তিনি বলেন, এই ফ্লাটের অধিবাসীরা অধিকাংশই মৎস্যজীবী হওয়ার কারণে সেখানে একটি দৃষ্টিনন্দন আধুনিক শুঁটকির হাট করে দেয়ার পাশাপাশি সেখানকার সি-বীচ উন্নয়নেরও পদক্ষেপ নেয়া হবে।
যে সব দেশে বরফ পড়ে সেসব দেশে বরফ গলানোর জন্য অপরিশোধিত লবণের ব্যবহার হয় উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী লবণের উৎপাদন বাড়ানো এবং এ অঞ্চলের লবণ চাষীদের জন্য আরও সুযোগ সৃষ্টির পাশাপাশি উন্নত প্রযুক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে লবণ উৎপাদনের প্রয়োজনীয়তারও উল্লেখ করেন। তিনি বলেন, চিংড়ি চাষীদের জন্য তার সরকার সেখানে চিংড়ির পোনা উৎপাদনের যেমন ব্যবস্থা নিয়েছে তেমনি যশোর থেকে উৎপাদিত চিংড়ির পোনা হেলিকপ্টার বা বিমানে কক্সবাজারে পাঠানোর উদ্যোগও সরকার নিয়েছে।
প্রাকৃতিক সম্পদে ভরপুর এই দেশের সার্বিক উন্নয়ন তার সরকারের একমাত্র লক্ষ্য উল্লেখ করে জাতির পিতার কন্যা বলেন, সমুদ্র, পাহাড় এবং সবুজে ঘেরা সমতল ভূমির এই চমৎকার ভূখ-কে জাতির পিতা আমাদের উপহার দিয়ে গেছেন। কাজেই একে আরও উন্নত-সমৃদ্ধ করার পাশাপাশি এর প্রাকৃতিক পরিবেশ ও সম্পদ রক্ষা করাটা একান্তভাবেই প্রয়োজন। তিনি এ সময় দেশের একমাত্র কোরাল দ্বীপ সেন্ট মার্টিনের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য রক্ষার সঙ্গে দ্বীপটির নিরাপত্তা নিশ্চিত করাও একান্তভাবে অপরিহার্য বলে উল্লেখ করেন।
কক্সবাজারে সেনাবাহিনীর ১০ পদাতিক ডিভিশন স্থাপনসহ কক্সবাজার থেকে পার্বত্য চট্টগ্রাম পর্যন্ত স্থল সীমানা রক্ষায় বর্ডার গার্ডের জন্য নতুন নতুন ‘বিওপি’ প্রতিষ্ঠা এবং যাতায়াত ব্যবস্থার উন্নয়নে তার সরকারের প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখার কথা বলেন প্রধানমন্ত্রী। পর্যটকদের জন্য বিনোদনের ব্যবস্থা রাখার পাশাপাশি এখানকার প্রাকৃতিক সৌন্দর্য এবং জীববৈচিত্র্য যেন অটুট থাকে সেদিকে লক্ষ্য রাখার জন্য কক্সবাজার উন্নয়ন কর্তৃপক্ষকে আহ্বান জানান প্রধানমন্ত্রী। বিশেষ করে লাল কাঁকড়া, কাছিম এবং অন্যান্য সামুদ্রিক জীবের বিচরণ ও প্রজনন ক্ষেত্র এবং শামুক-ঝিনুক, লতা-গুল্ম প্রভৃতির সুরক্ষা নিশ্চিত করার আহ্বান জানান তিনি।
সরকারপ্রধান বলেন, গোটা কক্সবাজার ঘিরেই আমাদের অনেক অনেক উন্নয়ন পরিকল্পনা রয়েছে সেজন্যই ‘কক্সবাজার উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ’ করে দিয়েছি। কাজেই পর্যটনকে আকর্ষণীয় করতে আজকাল অনেক ধরনের ব্যবস্থা নেয়া হয়, সেসব ব্যবস্থাও আমরা ধীরে ধীরে আমরা নেব। কেন না বাংলাদেশে বিশ্বে সবথেকে সুন্দর এবং উন্নত সমৃদ্ধ দেশ হিসেবে গড়ে উঠুক সেটাই আমাদের লক্ষ্য।
তার সরকার ইতোমধ্যেই করোনাকালীন অর্থনৈতিক ক্ষতি পুষিয়ে উঠতে বিভিন্ন পদক্ষেপ নিয়েছে উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী দেশের প্রতি ইঞ্চি জমি কাজে লাগিয়ে উৎপাদন বাড়াতে দেশবাসীর প্রতি তার আহ্বান পুনর্ব্যক্ত করেন। দেশে এক ইঞ্চি জায়গাও পড়ে থাকবে না। কক্সবাজার সমুদ্র তট রক্ষায় জাতির পিতার ঝাউবন সৃষ্টির পদক্ষেপ টেনে এনে এর চারদিকে ঝাউবনের সবুজ বেষ্টনি গড়ে তোলার প্রয়োজনীয়তার কথা উল্লেখ করেন প্রধানমন্ত্রী।
আসছে আষাঢ় মাসে তার দল আওয়ামী লীগের সহযোগী সংগঠন কৃষক লীগের দেশব্যাপী অনুষ্ঠেয় বৃক্ষরোপণ কর্মসূচীর কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, এই কক্সবাজার সমুদ্র সৈকত পুরোটাই যদি আমরা ঝাউবন দিয়ে ঢেকে দিতে পারি তাহলে ঝড়-জলোচ্ছ্বাসসহ নানা প্রাকৃতিক দুর্যোগ থেকে রক্ষা পাওয়া যাবে। কাজেই প্রতিবছর সবাই মিলে এরকম ঝাউবন তৈরি বা ম্যানগ্রোভ বৃক্ষরোপণের উদ্যোগ গ্রহণের আহ্বান জানান তিনি।