ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

মমতাজ লতিফ

রমনা কালীবাড়ি গণহত্যা

প্রকাশিত: ২০:৫৮, ১৯ মে ২০২২

রমনা কালীবাড়ি গণহত্যা

বড় একটি গণহত্যা সংঘটিত হয়েছিল ’৭১ সালের ২৬-২৭ মার্চে রমনা কালীমন্দির ও মা আনন্দময়ী আশ্রমে। করোনা মহামারী শুরু হওয়ার আগে, সম্ভবত ১৮ সালে ’৭১-এর ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির প্রতিনিধি হিসেবে বিচারপতি শামসউদ্দীন চৌধুরী মানিকসহ রমনা কালী-মন্দির এলাকায় ভ্ক্তুভোগীদের এবং হত্যার শিকার স্বজনদের বক্তব্য শুনতে গিয়েছিলাম। কথা দিয়েছিলাম এর ওপর তা নিয়ে কলাম লিখব। কিন্তু করোনা মহামারীর তা-বে ভুলে ছিলাম। মনে হলো, এতদিন না লেখার কারণে নিজেই নিজের কাছে অপরাধী হয়ে গেলাম। উল্লেখ্য, ২০০০ সালের ১৪ সেপ্টেম্বর জাতীয় প্রেসক্লাবে গণতদন্ত কমিশনের সাংবাদিক সম্মেলনে প্রদত্ত বক্তব্যের একটি কপি উপস্থিত ব্যক্তিদের কাছ থেকে পেয়েছিলাম, যাতে সেই ’৭১-এর ২৬-২৭ মার্চের ভয়াবহ অভিজ্ঞতার বর্ণনা পেয়েছি। বলা বাহুল্য, ধ্বংসপ্রাপ্ত রমনা কালীমন্দির ও আশ্রমটি আওয়ামী লীগের প্রথম আমলে নির্মিত হয় নতুনভাবে। বর্তমানে এতে নিয়মিত পূজা-অর্চনা হয়। আশ্রমে অতিথিরা বাস করেন। বর্তমান সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের দক্ষিণ দিকে বাংলা একাডেমির উল্টো দিকে প্রায় দুই একর জমির ওপর রমনা কালীমন্দির ও মা আনন্দময়ীর আশ্রম প্রতিষ্ঠিত ছিল। ইতিহাসবিদ মুনতাসীর মামুনের মতে, শঙ্করাচার্যের অনুগামী এক সম্প্রদায়ের দ্বারা রমনা কালীমন্দির প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। প্রায় পাঁচ শ’ বছর আগে বদরীনারায়ণের যোশী মঠের সন্ন্যাসী গোপালগিরি ঢাকায় এসে একটি আখড়া স্থাপন করেন। পরে হরিচরণ গিরি ঐ আখড়াস্থলে নির্মাণ করেন মূল মন্দিরটি। প্রায় তিন শ’ বছর আগে নির্মিত মন্দিরটিই ১৯৭১ সালের ২৭ মার্চ পাকিস্তানী হানাদার বাহিনীর হামলায় বিধ্বস্ত হয়। এ সময় কালীমন্দিরের পুরোহিত ছিলেন শ্রীমৎ স্বামী পরমানন্দ গিরি। মন্দিরটির ১২০ ফুট উঁচু চূড়া বহুদূর থেকে দেখা যেত। সাত মার্চের জনসভায় বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ভাষণ দানের বহুল প্রচারিত আলোকচিত্রে কালীমন্দিরের এই চূড়া রমনার ল্যান্ডমার্ক হিসেবে চোখে পড়ে। কালীবাড়ির সামনের দীঘিটি ইতিহাসবিদ ড. দানির মতে ভাওয়ালের রানী বিলাসমনি কাটিয়েছিলেন। এই দীঘি এখনও এখানকার বাসিন্দাদের পানির সমস্যা মেটায়। রমনা কালীমন্দিরের উত্তর পাশে ছিল মা আনন্দময়ীর আশ্রম। শাহবাগের মা নামে পরিচিত এই সন্ন্যাসিনী ছিলেন ঢাকার নবাবের শাহবাগ বাগানের তত্ত্বাবধায়ক রমনীমোহন চক্রবর্তীর স্ত্রী। বাজিতপুর থেকে চাকরি নিয়ে তিনি ঢাকায় এসেছিলেন। তার ভক্তরা রমনা ও সিদ্ধেশ্বরী কালীবাড়িতে দুটি আশ্রম তৈরি করে দিয়েছিলেন। এ মন্দির ও আনন্দময়ী আশ্রমে সন্ন্যাসী, ভক্ত ছাড়াও সাধারণ কর্মজীবী অনেক মানুষ পরিবার পরিজন নিয়ে বসবাস করতেন। এ মন্দির ও আশ্রমের হত্যাযজ্ঞ নিয়ে যে গণতদন্ত কমিশন হয় তাতে সাক্ষ্যদানকারীরা ভয়াবহ হত্যা ও ধ্বংসযজ্ঞের বিবরণ দিয়েছিলেন। সাক্ষ্যে বলা হয়Ñ ২৫ মার্চের কালরাতের পর ২৬ মার্চ সকাল এগারোটার দিকে পাকিস্তানী বাহিনী প্রথম মন্দির ও আশ্রম অঙ্গনে প্রবেশ করে। তারা মন্দির ও আশ্রমবাসীদের মন্দির থেকে বের না হবার জন্য বলে। তাদের সঙ্গে খাজা খয়ের উদ্দিনকেও দেখা গেছে, যে ’৭০-এর নির্বাচনে পুরনো ঢাকা থেকে মুসলিম লীগের প্রার্থী হয়ে নির্বাচনে আওয়ামী লীগ প্রার্থীর কাছে পরাজিত হয়েছিল। ২৭ মার্চ গভীর রাতে রমনায় ধ্বংসযজ্ঞ ও হত্যাকা- প্রধানত তারই উদ্যোগে সংঘটিত হয়েছিল। সেই পাক হানাদার বাহিনীকে পথ দেখিয়ে নিয়ে যায়। ২৭ মার্চ রাত দু’টার দিকে পাকিস্তানী বাহিনী সান্ধ্য আইনের ভেতর রমনা কালীমন্দির ও মা আনন্দময়ী আশ্রম ঘেরাও করে। শুরু করে ভারি গোলাবর্ষণ। তাদের সার্চলাইটের তীব্র আলোয় গোটা রমনা এলাকা আলোকিত হয়ে যায়। তারা মন্দিরে ঢুকে মূর্তির দিকে বিস্ফোরক ছুড়ে দেয় এবং গোলাবর্ষণ করে। ফলে মূর্তিসহ মন্দিরের পেছনের অংশ দেয়ালসহ উড়ে যায়। এরপর মন্দির ও আশ্রম ধ্বংস করা হয়। এ সময় মন্দির ও আশ্রমের ঘুমন্ত, জাগ্রত মানুষেরা আতঙ্কিত হয়ে ‘পাকিস্তান জিন্দাবাদ’ ধ্বনি দিয়ে প্রাণ বাঁচানোর জন্য দৌড়াদৌড়ি শুরু করে। মেয়েরা শাখা খুলে, সিঁদুর মুছে ফেলে। অনেকে লুকানোর চেষ্টা করে। পাকিস্তানী সেনারা তাদের খুঁজে বের করে পুরুষ ও মহিলাদের সঙ্গে শিশুদেরও লাইনে দাঁড় করায়। এরপর সবার সামনে রমনা কালীমন্দিরের পুরোহিত পরমানন্দ গিরিকে কলেমা পড়তে বাধ্য করে এবং তার পর পরই তার পেট বেয়নেট দিয়ে ফেড়ে গুলি করে হত্যা করে! এভাবে অনেককে কলেমা পড়িয়ে হত্যা করে! কুৎসিত আনন্দ উল্লাস- করতে করতে তারা বলে- ‘নৌকায় ভোট দেবার মজা বোঝ এবার।’ এরপর বাকি পুরুষদের ব্রাশফায়ার করে হত্যা করে। ভয়াবহ এ দৃশ্য দেখে মহিলারা আর্তচিৎকার আরম্ভ করলে তাদের বন্দুক দিয়ে পেটানো হয়। ফলে অনেকে অজ্ঞান হয়ে পড়ে। এরপর পাকিস্তানীরা মৃতদেহগুলো জড়ো করে পেট্রোল দিয়ে আগুন ধরিয়ে দেয়। এতে মৃতদের সঙ্গে অনেক আহতও পুড়ে মারা যায়। এ সময় পাকি সেনারা দু’জন যুবককে ধরে ‘জয় বাংলা’ ধ্বনি দিতে বাধ্য করে এবং পরে মুখের ভিতর গুলি করে হত্যা করে তাদের। এই হত্যাযজ্ঞের সময় রমনা কালী মন্দির ও আনন্দময়ী আশ্রম আগুনে দাউ দাউ করে জ্বলছিল। আশ্রম ও মন্দিরের গোয়ালে প্রায় ৫০টির মতো গরু ছিল। অসহায় পশুগুলোকেও পাকসেনারা পুড়িয়ে মারে। পাকিবাহিনী ভোর ৪টার দিকে ফিরে যাবার সময় লাইনে দাঁড় করিয়ে রাখা মহিলাদের থেকে বেশ কয়েকজন যুবতী মেয়েকে ধরে নিয়ে যায়, যাদের আর কখনো ফিরে পাওয়া যায়নি। কয়েকজন সাক্ষ্যদাতা এই মেয়েদের সংখ্যা প্রায় এক ডজন বলে উল্লেখ করেন। পাকিস্তানীরা নির্দেশ দেয়- বেঁচে থাকারা যেন পরদিনই ভারতে চলে যায়। স্মরণ করা যেতে পারে- ১৯৭২ সালের ৩১ জানুয়ারি দৈনিক পূর্বদেশ এ রমনা কালীমন্দির ও আনন্দময়ী আশ্রম ধ্বংসের ওপর প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছিল, ’৭১-এর এপ্রিল মাসের শেষ দিকে অথবা মে মাসের প্রথম দিকে ধ্বংসপ্রাপ্ত মন্দির ও আশ্রমে পুনরায় পাকিস্তানীরা হামলা চালায়। স্বাধীতার পর মন্দির ও আশ্রমের ভগ্নাবশেষ গণপূর্ত বিভাগের কর্মকর্তারা শ্রমিক দিয়ে বুলডোজার চালিয়ে নিশ্চিহ্ন করে দেয় এবং ধ্বংসস্তূপ সরিয়ে নেয়া হয়। তদানীন্তন রেসকোর্স ময়দান আগে ঢাকা ক্লাবের নিয়ন্ত্রণে ছিল। স্বাধীনতার পর জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান মদ, জুয়া ও রেসখেলা বন্ধ করে দেয়ার পর রেসকোর্সের স্থানটুকু গণপূর্ত বিভাগের হাতে ন্যস্ত করা হয়। মন্দির ও আশ্রমবাসী যারা পাকিস্তানী হানাদার বাহিনীর হামলার পর পালিয়ে গিয়ে বিভিন্ন স্থানে আশ্রয় নিয়েছিলেন, তারা স্বাধীনতার পর পর এখানে ফিরে আসেন। তারা যথারীতি অস্থায়ী মন্দির গড়ে পূজাঅর্চনা শুরু করেন। পুনরায় ঘরবাড়ি তৈরি করে এখানে বসবাসের উদ্যোগ নেন। রমনার অদূরে জাতীয় তিন নেতার মাজার সংলগ্ন শাহবাগ জামে মসজিদের খাদেম ও রমনা কালীমন্দিরের পুরোহিত পরমানন্দ গিরির ঘনিষ্ঠ বন্ধু আবদুল আলী ফকির স্বাধীনতার পর রমনা কালীমন্দির ও মা আনন্দময়ী আশ্রমের ভক্ত শিক্ষক ও অন্যান্য বাসিন্দারের নিয়ে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে দেখা করে এই ঐতিহাসিক মন্দির ও আশ্রম নির্মাণের জন্য একটি স্মারকলিপি প্রদান করেন। তার সঙ্গে পরমানন্দ গিরির স্ত্রী সুচেতা গিরি এবং মা আনন্দময়ী আশ্রমের সন্ন্যাসিনী জটালী মাও ছিলেন। ১৯৭৩ সালে রমনা কালী মন্দির ও মা আনন্দময়ী আশ্রমের বাসিন্দাদের পোস্তগোলায় পাঠিয়ে দেয়া হয়। শ্মশান সংলগ্ন বালুর মাঠে তারা বসতি শুরু করেন। তাদের কিছু তাঁবু সরবরাহ করা হয়। কেউ কেউ ঘর তোলেন। তাদের জন্য রেশনেরও ব্যবস্থা করা হয়। কিন্তু বঙ্গবন্ধু হত্যার পর জিয়াউর রহমান ক্ষমতায় আসার পর পুলিশ তাদের সে স্থান থেকেও উৎখাত করে। ওরা তাদেরকে ভারতে চলে যেতে বলে। সেখানে স্থাপন করা হয় সেনা ক্যাম্প। তখন থেকে আশ্রমবাসীরা এখানে ওখানে ছড়িয়ে পড়েন। অনেকে ভারতে চলে যান। সুচেতা গিরি ১৯৯৭ সালে ভারতে চলে যান। জটালী মা মারা যান এর কয়েক বছর আগে। এদিকে রমনায় প্রতি বছরই মন্দির নির্মাণ এবং শারদীয় দুর্গোৎসব ও কালী পূজার উদ্যোগ নেয়া হয়। কিন্তু কোন বারই সে উদ্যোগ সফল হয়নি। প্রতিবারই পূজায় বাধা দেয়া হয়। শুধু ১৯৮২ সালে একবার কালী পূজার অনুমতি দেয়া হয়েছিল। ১৯৮৪ সালে মন্দির ও আশ্রম ফিরিয়ে দেয়ার দাবি জানিয়ে ঢাকার দেওয়ানি আদালতে একটি মামলা দায়ের করা হয়। আদালত বাদী ও সরকারের ওপর স্থিতাবস্থা বজায় রাখার নির্দেশ দেয়। সরকার পক্ষ আদালতকে জানায় যে, সরকার কর্তৃক মন্দিরের দেবোত্তর সম্পত্তি অধিগৃহীত হয়নি। তা সত্ত্বেও শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধাঞ্জলি নিবেদন কিংবা পূজার আয়োজনে বার বার সেখানে যেতে বাধা দেয়া হয়েছে। এরই ধারাবাহিকতায় গত ২৭ মার্চ, ২০০০ তারিখেও শহীদদের উদ্দেশে স্মৃতি অর্পণে দেশের বরেণ্য নাগরিকদের বাধা দেয়া হয়। রমনা কালীমন্দির ও মা আনন্দময়ী আশ্রমের গণহত্যা ও ধ্বংসযজ্ঞ সম্পর্কে তদন্ত করতে গিয়ে গণতদন্ত কমিশন দীর্ঘ ঊনত্রিশ বছর পর ’৭১-এর সেসব ক্ষতিগ্রস্ত, শহীদ পরিবারের সদস্যদের খুঁজে বের করেছে, যারা এই নৃশংসতা প্রত্যক্ষ করেছেন এবং স্বজন হারিয়েছেন। তারা পরস্পরের সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপন শহীদ পরিবারের পুনর্বাসন এবং গণতদন্ত কমিশনের কার্যক্রমে সহায়তা প্রদানের জন্য একটি কমিটি গঠন করেছিলেন। কমিটির নাম ছিল ‘শ্রী শ্রী রমনা কালীমন্দির ও শ্রীমা আনন্দময়ী আশ্রম ধ্বংস ও হত্যাযজ্ঞ ক্ষতিগ্রস্ত ও শহীদ পরিবার পুনর্বাসন কমিটি।’ §এই তদন্ত ও সাক্ষ্য প্রমাণ পাকিস্তানী হানাদার বাহিনীর যুদ্ধাপরাধ ও মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধের একটি বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ দলিল হিসেবে বিবেচিত হবে। §মুক্তিযুদ্ধের সঠিক ইতিহাস এবং মুক্তিযুদ্ধের চেতনা প্রতিষ্ঠার স্বার্থে রমনার ঐতিহাসিক কালীমন্দির ও আশ্রম পুনর্নির্মাণ প্রয়োজন। §এই গণহত্যার শহীদদের নামের তালিকা সংবলিত একটি স্মৃতি ফলক নির্মাণ, যা নির্মীয়মাণ স্বাধীনতা কমপ্লেক্সের সম্পূরক হিসেবে বিবেচিত হবে। §গণতদন্ত কমিশন পাকিস্তানী হানাদার বাহিনীর হাতে নিহতদের নাম সংগ্রহের চেষ্টা করে এ পর্যন্ত ৫০ জনের নাম সংগ্রহ করেছে। অনেক সাক্ষী ও ভুক্তভোগী বিভিন্ন সময়ে দেশ ত্যাগ করেছেন। §স্থানের শহীদ পরিবারের সরকারী সাহায্য-সহযোগিতা প্রদানের ব্যবস্থা গ্রহণ দেশবাসীর দাবি। বর্তমানে কালীমন্দির পুনর্নির্মাণ হয়েছে এবং এখানে নিয়মিত পূজা-অর্চনা অনুষ্ঠিত হচ্ছে। উল্লেখ্য, মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে যেন এই গণহত্যার ঘটনাটি লিপিবদ্ধ থাকে, সংশ্লিষ্টদের সে ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে অবশ্যই। লেখক : শিক্ষাবিদ
×