ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

দরপত্রে প্রকিউরমেন্ট বিধিমালা লঙ্ঘন ব্যানবেইসের

প্রকাশিত: ১৯:৫১, ১৮ মে ২০২২

দরপত্রে প্রকিউরমেন্ট বিধিমালা লঙ্ঘন ব্যানবেইসের

স্টাফ রিপোর্টার ॥ একটি বিদেশি ব্র্যান্ডকে কাজ দিতেই নামমাত্র দরপত্র আয়োজন করেছে বাংলাদেশ শিক্ষাতথ্য ও পরিসংখ্যান ব্যুরো (ব্যানবেইস)। দরপত্র আহ্বানের ক্ষেত্রে একটি নির্দিষ্ট দেশের নাম উল্লেখ করে প্রয়োজনীয় পণ্যের ব্র্যান্ড নাম বা মডেল রাখা হয়েছে। সংশ্লিষ্টদের অভিযোগ, দরপত্রে একটি কোম্পানির নাম উল্লেখ থাকায় সেই কোম্পানি বাদে অন্য কারোর অংশ নেওয়ার সুযোগ নেই। এতে সংশ্লিষ্ট কোম্পানিটি একতরফা উচ্চদর প্রদান করার সুযোগ পাবে। দুটি প্রকল্পে কোনো প্রতিযোগী থাকবে না। সেন্ট্রাল প্রকিউরমেন্ট ইউনিট (সিপিটিইউ) বিধি ২৯(৩) অনুযায়ী কারিগরি দরপত্রে কোনো পণ্যের ট্রেডমার্ক, পেটেন্ট, নকশা বা ধরন, নির্দিষ্ট উৎস বা দেশের নাম বা কোনো কোম্পানির নাম উল্লেখ করা যাবে না। জানা গেছে, সরকারি প্রতিষ্ঠান ব্যানবেইস (বাংলাদেশ শিক্ষা তথ্য ও পরিসংখ্যান ব্যুরো) গত ৬ ও ৭ এপ্রিল ইন্টিগ্রেটেড এডুকেশন ইনফরমেশন ম্যানেজমেন্টে সিস্টেম (আইইআইএমএস) প্রকল্পে দুটি দরপত্র আহ্বান করে। আইডি নং ৬৮১৮৬৯ দরপত্রে প্রকল্প ব্যয় ৩০ কোটি টাকা এবং আইডি ৬৮২০৮৫ নং দরপত্রের প্রকল্প ব্যয় ধরা হয় ৭০ কোটি টাকা। অভিযোগ উঠেছে, দুটি দরপত্রের স্পেসিফিকেশনে একটি ক্রয়কারী আবশ্যকীয় পণ্যের ব্র্যান্ডনাম বা মডেল নাম উল্লেখ করা হয়েছে। দরপত্রে প্রতিটি ক্রয়কৃত আইটেমের ক্ষেত্রে ‘সিসকো’ (বিদেশি আইটি কোম্পানি) নামের একটি ব্র্যান্ডের নাম স্পষ্টভাবে উল্লেখ করা হয়েছে। এদিকে দরপত্র দুটি আহ্বানের পর এই শর্ত নিয়ে দেশে-বিদেশে ব্যাপক সমালোচনার ঝড় ওঠে। ব্যানবেইস সূত্রে জানা গেছে, এ ঘটনায় ইতোমধ্যে দুটি আন্তর্জাতিক ও ৩টি অভ্যন্তরীণ টেক কোম্পানি সরকারের কাছে লিখিতভাবে অভিযোগ দায়ের করেছে। নাম প্রকাশ না করার শর্তে একটি আন্তর্জাতিক দরদাতা কোম্পানি অভিযোগ করে বলেন, দরপত্রের একটি আবশ্যকীয় শর্তে উল্লেখ করা হয়েছে ক্রয়কৃত আইটেমগুলোর মান আন্তর্জাতিক আইটি কোম্পানি ‘সিসকো’ ব্র্যান্ড বা তার চেয়ে ভালো মানের হতে হবে। এছাড়া আইটেমগুলোর মডেলও সিসকো আইএসআর৪৪৫১-এক্স-এসইসি/কে৯ মডেলের হতে হবে বলে শর্ত দেওয়া হয়েছে। কিছু আইটেমের ক্ষেত্রে বৈশিষ্ট্য উল্লেখ করা হয়েছে যা ওইএম (অরজিনাল ইকুইপমেন্ট ম্যানুফ্যাকচারার) মালিকানা স্বত্বাধীন যেমন ফায়ারপাওয়ার এসজিআইপিএস, এএমপি, ইএসপি, ইআইজিআরপির মতো সুনির্দিষ্ট ব্র্যান্ডের নাম উল্লেখ করে দেওয়া হয়েছে। দরপত্রে ক্রয়কৃত আইটেমগুলোর লাইসেন্সিংয়ের ক্ষেত্রে বলা হয়েছে, দরদাতা কোম্পানিগুলো যেসব আইটেম সরবরাহ করবে সেগুলো অবশ্যই সিসকো এফপিআর-১১৫০ এবং সিসকো ফায়ারপাওয়ার থ্রেট ডিফেন্স সফটওয়্যারের কাছ থেকে লাইসেন্স নিতে হবে। দরপত্রে এমন কিছু শর্ত দেওয়া হয়েছে যেগুলো পূরণ করা শুধু একটি কোম্পানির পক্ষে সম্ভব। উদাহরণ হিসাবে তিনি বলেন, ডিএমজেড রাউটার ক্রয়ের স্পেসিফিকেশনে মেমরির চাহিদা উল্লেখ করা হয়েছে মিনিমাম ৮-গিগাবাইট ড্রাম যা একটি মাত্র বিশেষ কোম্পানির পক্ষে দেওয়া সম্ভব। দরপত্রে শর্ত প্রদানের ক্ষেত্রে বেশ কিছু অমিলেরও অভিযোগ আছে। যেমন নেটওয়ার্কিংয়ের বাইরের অংশ ১জি ব্যাকবোনের বলা হলেও অভ্যন্তরীণ সার্ভার ফার্ম জোন ১০জি ব্যাকবোনের উল্লেখ করা হয়েছে যা কোনোভাবেই যুক্তিসঙ্গত নয়। এ ধরনের নেটওয়ার্কিং ব্যবস্থা ভবিষ্যতে প্রকল্পে বড় ধরনের বাধার সৃষ্টি করবে এবং প্রকল্প বাস্তবায়নে অনিশ্চয়তা তৈরি করবে। খোদ ব্যানবেইসের একজন শীর্ষ কর্মকর্তা বলেন, দুটি দরপত্রই সেন্ট্রাল প্রকিউরমেন্ট ইউনিট (সিপিটিইউ) কর্তৃক অনুমোদিত পিপিএ-২০০৬ এবং পিপিআর ২০০৮ অনুযায়ী করা হয়নি। পিপিআর-২০০৮ (পাবলিক প্রকিউরমেন্ট বিধিমালা) অনুযায়ী দরপত্র আহ্বানের ক্ষেত্রে কোনো ক্রয়কারী আবশ্যকীয় পণ্যের ব্র্যান্ড নাম বা মডেল এবং নির্দিষ্ট দেশের বা অঞ্চলের নাম উল্লেখ করা যাবে না। সিপিটিইউর একজন কর্মকর্তা বলেন, দরপত্র দলিল বা রেট শিডিউলে কোনো পণ্যের ব্র্যান্ড বা দেশের নাম নির্দিষ্ট করে দিলে অন্য কোনো আন্তর্জাতিক কোম্পানি বা দেশীয় শিল্প প্রতিষ্ঠান দরপত্রে অংশ নিতে পারবে না। এতে অবাধ প্রতিযোগিতার সুযোগ কমে যাবে। সব দরদাতার প্রতি সম-আচরণ করা হবে না এবং একক মনোপলির কারণে প্রকল্প ব্যয় অনেক বেড়ে যাবে। অপরদিকে পিপিএ ২০০৬-এর ১৫(১) ধারা অনুযায়ী কোনো ক্রেতা এমন কোনো স্পেসিফিকেশন প্রস্তুত করতে পারবে না, যেখানে কোনো নির্দিষ্ট ওইএম (অরজিনাল ইকুইপমেন্ট ম্যানুফ্যাকচারার)-এর ট্রেডমার্ক, পেটেন্ট বা নকশা থাকে বা উৎপত্তি দেশ বা উৎপাদনকৃত দেশের নাম উল্লেখ থাকবে। বর্তমানে দেশের শিক্ষাব্যবস্থা ২৩ বছরের পুরোনো সফটওয়্যার দিয়ে চলছে। মূলত এই ব্যবস্থা পালটে দিতেই এই ইন্টিগ্রেটেড এডুকেশন ইনফরমেশন ম্যানেজমেন্ট সিস্টেম (আইইআইএমএস) প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়েছে। এই প্রকল্প বাস্তবায়ন হলে শিক্ষার্থীদের ভর্তি, রেজিস্ট্রেশন, পরীক্ষার ফলাফলসহ সব তথ্য সরকারের নিরাপদ তথ্যভান্ডারে সুরক্ষিত থাকবে। শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের ওয়েবসাইটের তথ্য অনুযায়ী এই প্রকল্পের মেয়াদ হবে ২০১৮ সাল থেকে জুন ২০২২ সাল পর্যন্ত। এখন প্রকল্পটির মেয়াদ আরও বাড়িয়ে ২০২৩ সাল পর্যন্ত করার পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে। বাংলাদেশ প্রতিযোগিতা কমিশনের চেয়ারপারসন মো. মফিজুল ইসলাম বলেন, দরপত্রে চাহিদা লিখতে পারা যাবে। কিন্তু কোনো কোম্পানির পণ্যের নাম দরপত্রে উল্লেখ করা যাবে না। এটা পাবলিক প্রকিউরমেন্ট বিধিমালা লঙ্ঘন। এটা টিকবে না।
×