ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

ডাঃ মোঃ শহীদুল্লাহ সিকদার

অপরিহার্য ও ঐতিহাসিক প্রত্যাবর্তন

প্রকাশিত: ০০:৩৬, ১৮ মে ২০২২

অপরিহার্য ও ঐতিহাসিক প্রত্যাবর্তন

স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের বিশ্ব ইতিহাস অনেক দীর্ঘ। আমাদের দেশে প্রত্যাবর্তনের ইতিহাস অতটা দীর্ঘ না হলেও খুবই গুরুত্বপূর্ণ। স্বদেশ প্রত্যাবর্তন কতটা অপরিহার্য হতে পারে একটি জাতির জন্য সেটি বাংলাদেশের দুটি তারিখের দিকে দৃষ্টিপাত করলেই বোঝা যায়। একটি ১৯৭২-এর ১০ জানুয়ারি বাঙালী জাতির অবিসংবাদিত নেতা জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর স্বাধীন বাংলাদেশের মাটিতে প্রথম পদার্পণ, অন্যটি হলো ১৯৭৫ পরবর্তীতে পাকিস্তানমুখী যাত্রারত বাংলাদেশে ১৯৮১-এর ১৭ মে জাতির জনকের কন্যা স্বাধীনতাকামী বাঙালী জাতির ত্রাণকর্তা শেখ হাসিনার স্বদেশ প্রত্যাবর্তন। স্বাধীনতার আকাক্সক্ষা বাঙালীর অনেক পুরনো। শত শত বছর ধরে বাঙালী, বিজাতীয়দের দ্বারা শাসিত হয়েছে। বাংলার সন্তান সূর্যসেন, প্রীতিলতা, ক্ষুদিরাম জীবন দিয়েছেন। কমরেড মুজাফফর আহম্মেদ, নেতাজী সুভাস বোস, শেরে বাংলা একে ফজলুল হক, হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী, মওলানা ভাসানীসহ অনেকেই আজীবন বাংলাদেশের মানুষের মুক্তির জন্য কাজ করেছেন। অবশেষে সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের নেতৃত্বে বাংলাদেশ স্বাধীনতা লাভ করে কিন্তু অব্যাহত থাকে মুক্তির সংগ্রাম। স্বাধীন বাংলাদেশের কাক্সিক্ষত যাত্রা শুরু করতে নেতার জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করতে থাকে গোটাজাতি। ’৭১-এর ১৬ ডিসেম্বরের বিজয় লাভের পর থেকে ’৭২-এর ১০ জানুয়ারি পর্যন্ত এবং ’৭৫ এ ১৫ আগস্টের পর, ’৮১-এর ১৭ মে পর্যন্ত, দেশ একটি জাতীয় নেতৃত্বের অপেক্ষায় দিন গুনতে থাকে। ’৭১-এর মহান মুক্তিযুদ্ধে ৩০ লাখ শহীদের রক্ত, ২ লাখ মা বোনের সম্ভ্রম এবং অযুত লাখ মানুষের অবর্ণনীয় আত্মত্যাগের বিনিময়ে যে স্বাধীন বাংলাদেশ আমরা পেলাম তার যাত্রা যেন শুরু হয়েও গতিহীন, কা-ারিবিহীন, লক্ষ্যহীন হয়ে পড়ে একজন মানুষের, একজন নেতার অনুপস্থিতিতে। তিনি তো একজন ব্যক্তি নন, তিনি হলেন সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশের প্রতিটি মানুষের মস্তিষ্কের নিউরোন এবং হৃদয়ের অলিন্দ যা ছাড়া জাতি অচল, তাঁর স্পর্শবিহীন জাতি নিথর। পাকিস্তানের কারাগার থেকে মুক্তি পেয়ে বঙ্গবন্ধু ১০ জানুয়ারি যখন সদ্য স্বাধীন বাংলার মাটিতে পা রাখলেন, মনে হলো প্রতিটি বাঙালী বঙ্গবন্ধুর স্পর্শে উজ্জীবিত হয়ে স্বাধীন বাংলাদেশে পূর্ণ স্বাধীনতার স্বাদ উপভোগের আনন্দে মেতে উঠেছে। বাংলাদেশ ৯ মাস রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে বিধ্বস্ত ব্রিজ-কালভার্ট, সড়কপথ-রেলপথ বিধ্বস্ত, স্কুল-কলেজ, অফিস-আদালত, শিল্প-কলকারাখানা, ব্যবসা-বাণিজ্য, কৃষি ব্যবস্থাও নতুন করে শুরু করার প্রয়োজন পড়ে। এই বিধ্বস্ত বাংলাকে প্রত্যাশার দেশ হিসেবে নির্মাণের পথে বঙ্গবন্ধু যখন জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করে এগিয়ে যাচ্ছিলেন, তখনই দেশী-বিদেশী মুক্তিযুদ্ধের পরাজিত শক্তি জাতির পিতাকে সপরিবারে নৃসংশভাবে হত্যা করে। বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বকে হারিয়ে জাতি কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে পড়ে, দিকভ্রান্ত হয়ে পড়ে। মুক্তিযুদ্ধের বাংলাদেশকে পেছনের দিকে ঘুরিয়ে দেয় খুনী চক্রের নেতৃত্বে পরাজিত শক্তি। সৃষ্টি কর্তার অপার কৃপায় আবির্ভূত হন আধুনিক বাংলাদেশ নির্মাণের কাণ্ডারি জাতির জনকের কন্যা শেখ হাসিনা। তিনি বঙ্গবন্ধুর নৃশংস হত্যাকা-ের পর ৬ বছর জার্মানি, ব্রিটেন, ভারতে নির্বাসিত ছিলেন ছোট বোন শেখ রেহানাকে নিয়ে। ১৯৮১-এর ১৭ মে তিনি স্বদেশে প্রত্যাবর্তন করেন। এটি বাঙালী জাতির জীবনে ঐতিহাসিক স্বদেশ প্রত্যাবর্তন। বৃষ্টিভেজা দিনে আনন্দাশ্রুতে সিক্ত হয়ে সেদিন বাঙালী জাতি শেখ হাসিনাকে স্বাগত জানায়, আবার নতুন করে স্বাধীনতার ধারায় বুক বেঁধে অমিত সম্ভাবনাকে সামনে রেখে পথ চলতে শুরু করে। তার আগে ১৯৮১-এর ফেব্রুয়ারিতে আওয়ামী লীগের কনফারেন্সে শেখ হাসিনাকে সভাপতি করা হয়। বঙ্গবন্ধু যেমন আওয়ামী লীগের সভাপতির চেয়ে বড় হয়ে জাতির নেতা হিসেবে আবির্ভূত হন, তেমনি শেখ হাসিনাকেও মানুষ আওয়ামী লীগের সভাপতির চেয়ে বড় করে মুক্তিযুদ্ধের বাংলাদেশের নেতা হিসেবে বিবেচনায় নেয়। তিনি আসলেন, আওয়ামী লীগকে ঐক্যবদ্ধ ও শক্তিশালী করেন, পাশাপাশি মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের সকল রাজনৈতিক দল ও শক্তিকে ঐক্যবদ্ধ করার চেষ্টা করেন। ১৫ দল, ১১ দল ও সর্বশেষ ১৪ দলীয় জোট গঠন ও এর নেতৃত্ব প্রদান করেন। শুধু রাজনৈতিক শক্তি নয়, এর বাইরেও তিনি সমাজের বিভিন্ন শ্রেণী-পেশার মানুষকে ঐক্যবদ্ধ করেন। পাকিস্তানী ধারায় চলতে থাকা পশ্চাৎমুখী বাংলাদেশকে আবার মুক্তিযুদ্ধের ধারায় ফিরিয়ে আনার জন্য তাকে অনেক ঝুঁকি নিতে হয়েছে। তাকে হত্যার চেষ্টা করা হয় ১৯ বার। দেশের মানুষের ভাগ্য পরিবর্তনের জন্য মুক্তিযুদ্ধের ধারায় বাংলাদেশ নির্মাণের জন্য তিনি নিরন্তর কাজ করে যাচ্ছেন। স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলন, পঁচাত্তরের এবং একাত্তরের খুনীদের বিরুদ্ধে অন্দোলন, জনমত তৈরি এবং এদের বিচারের জন্য তিনি নিজের মেধা ও দৃঢ়তাকে কাজে লাগিয়ে ধীরে ধীরে এগিয়ে যান। বাংলাদেশে আজও অনেক সমস্যা আছে, মুক্তিযুদ্ধের বাংলাদেশ বা বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের বাংলাদেশ নির্মাণের ক্ষেত্রে এখনও অনেক পথ পাড়ি দিতে হবে। দুর্নীতিমুক্ত শাসন ব্যবস্থা চালু করা বর্তমান সময়ের একটি অন্যতম বড় চ্যালেঞ্জ। ৩০ লাখ শহীদের স্বপ্নের বাংলাদেশ, বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের বাংলাদেশ নির্মাণের জন্য দুর্নীতিমুক্ত বাংলাদেশ তৈরি করা আজকের অপরিহার্য কর্তব্য। ইতোমধ্যেই বঙ্গবন্ধুকন্যা দুর্নীতির বিরুদ্ধের জিরোটলারেন্স নীতি গ্রহণ করেছেন। ইতোমধ্যেই বাংলাদেশ অনেক দূর এগিয়েছে। সাম্প্রতিক সময়ে করোনা মহামারী নিয়ন্ত্রণে বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা সাফল্যের পরিচয় দিয়েছেন। বাংলাদেশ এখন উন্নয়নের রোল মডেল হিসেবে বিশ্বদরবারে প্রতিষ্ঠিত সত্য। শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বাংলাদেশ অনুন্নত দেশ থেকে উন্নয়নশীল দেশের মর্যাদা লাভ করেছে। উন্নয়নের যাত্রা অব্যাহত থাকলে শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আগামী কয়েক বছরেই বাংলাদেশ উন্নত দেশের কাতারে শামিল হতে পারবে। তিনি অনেক পুরস্কার পেয়েছেন, তাঁর অনেক সাফল্য রয়েছে। সবচেয়ে বড় সাফল্য নিজ দলের অনেক বর্ণ চোর, বিশ্বাস ঘাতক ও বাম-প্রগতিশীল মিত্র শক্তির অনেক অতিবিপ্লবীয় অসহযোগিতার পরেও মেধা, পরিশ্রম ও সাহস দিয়ে ’৭১ ও ’৭৫-এর খুনীদের বিচারের ব্যবস্থা করতে পেরেছেন। সেটিই হলো সবচেয়ে বড় সাফল্য। শেখ হাসিনা তাঁর যোগ্যতা দিয়ে আওয়ামী লীগকে ঐক্যবদ্ধ করেন, মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তিকেও ঐক্যবদ্ধ করেন এবং ’৭৫ পরবর্তী পাকিস্তানপন্থী পেছন দিকে হাঁটতে থাকা বাংলাদেশকে মুক্তিযুদ্ধের ধারায় ফিরিয়ে আনেন। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু নেই, কিন্তু তাঁর সুযোগ্য কন্যা শেখ হাসিনা রয়েছেন। তিনি এলেন, মানুষকে আশায় বুক বাঁধতে শক্তি জোগালেন, দেশবাসীকে ঐক্যবদ্ধ করলেন এবং সবাইকে সঙ্গে নিয়ে মুক্তিযুদ্ধের পরাজিত শক্তিকে আবারও পরাজিত করলেন। ১৭ কোটি বাঙালীর কাছে ফিরিয়ে দিলেন মুক্তিযুদ্ধে সৃষ্ট বাংলাদেশকে। তিনি না এলে এটি সম্ভব ছিল না। শেখ হাসিনার স্বদেশ প্রত্যাবর্তন মানে মুক্তিযুদ্ধের বাংলাদেশ দেশবাসীর কাছে ফিরে আসা। সাম্প্রতিক করোনার মতো দেশের সকল সঙ্কটে বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা মায়ের মমতায় জীবনের ঝুঁকি নিয়ে এগিয়ে গেছেন। তিনি কন্যা, জননী, সংগ্রামী, যোদ্ধা, দার্শনিক, শিল্পী। তিনি নেতা, সফল রাষ্ট্রনায়ক। পিতার অবর্তমানে একই ক্যানভাসে বঙ্গবন্ধুর আদর্শে- হাজার বছরের বঞ্চিত বাংলার সকল শ্রেণীর মানুষের স্বপ্ন এবং দর্শনকে এঁকে চলেছেন নিজস্ব মেধা ও মননে। তাঁর ফিরে আসা দেশ ও জাতির জন্য অপরিহার্য ও ঐতিহাসিক প্রত্যাবর্তন। লেখক : অধ্যাপক, সাবেক উপ-উপাচার্য, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ^বিদ্যালয়
×