ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

শাকিল আহমেদ মিরাজ

সাইমন্ডস- বর্ণময় চরিত্রের অকাল সমাপ্তি

প্রকাশিত: ২১:৪৩, ১৮ মে ২০২২

সাইমন্ডস- বর্ণময় চরিত্রের অকাল সমাপ্তি

শেন ওয়ার্ন ছিলেন বিশ্ব ক্রিকেটের ব্যতিক্রম এক চরিত্র। মাঠে শতাব্দীর সেরা ডেলিভারি, বল হাতে রেকর্ডের পর রেকর্ড, সঙ্গে মদ-জুয়া, নারী কেলেঙ্কারি তাতে যোগ করেছিল বহুমাত্রিকতা। আলোর বিপরীতে ৫২ বছর বয়সী সুপারস্টারের অন্য জগতের বেশিরভাগ জায়গাজুড়েই ছিল বিতর্ক। এ্যান্ড্রু সাইমন্ডসও ছিলেন বর্ণময় চরিত্রের অধিকারী। ছিল বিতর্ক। তবে তাতে নারী, কেলেঙ্কারি বা জুয়া নয়, ছিল বদ মেজাজ আর নিয়ম ভাঙার খেয়ালি সব অধ্যায়। নৈপুণ্যে ও অর্জনের বিচারে ওয়ার্ন যদি হন কিংবদন্তি, তবে সাইমন্ডস ছিলেন সময়ের চেয়ে এগিয়ে থাকা এক ক্রিকেটার। শুধু পরিসংখ্যান দিয়ে যার বিচার করা সম্ভব নয়। গ্রেট ইয়ান চ্যাপেলের চোখে,‘প্রতিপক্ষের জন্য এ্যান্ড্রু ছিল ভয়ের কারণ। যে কোন পরিস্থিতিতে সে নিয়মিত চার-ছক্কা মারত। আর ফিল্ডিংয়ের সময় এমন সব ক্যাচ ধরত এবং রান আউট করত, যা খেলার মোড় ঘুরিয়ে দিত’। স্ত্রী, সন্তান, পরিবার, বন্ধুদের কাছে সাইমন্ডস যে কতটা ভালবাসার পাত্র ছিলেন, সেটিই এখন নতুন করে সামনে উঠে আসছে। সেই সাইমন্ডস মাত্র ৪৬ বছর বয়সেই না ফেরার দেশে। সড়ক দুর্ঘটনা কেড়ে নিল তার প্রাণ। দু-দুটি বিশ্বকাপজয়ী দলের গর্বিত সদস্য, সাবেক অসি-অলরাউন্ডারের এমন মৃত্যুতে বিশ্ব ক্রিকেটে চলছে শোকের মাতম। রডনি মার্শ, ওয়ার্নের পর সাইমন্ডসÑ মাত্র দুই মাসের ব্যবধানে তিন তারকার শোকে মুহ্যমান ক্রিকেট অস্ট্রেলিয়া। সাইমন্ডসের জন্ম ১৯৭৫ সালের ৯ জুন ইংল্যান্ডের বার্মিংহামে। আফ্রো-ক্যারিবিয়ান ও ডেনিশ/সুইডিশ বংশোদ্ভূত পিতা-মাতার সন্তান তিনি। তবে তিন মাস বয়সে সাইমন্ডসের দত্তক পিতা-মাতা তাকে অস্ট্রেলিয়ায় নিয়ে যান। জন্ম ও বেড়ে ওঠার মতোই ক্রিকেট জীবনের শুরুতে তার উভয় দেশের ঘরোয়া লিগে পদচারণা ছিল। ১৯৯৫ সালে গ্লুচেস্টারশায়ারের হয়ে ১৬টি ছক্কাসহ ২৫৪ রান করলে ইংল্যান্ডের ‘এ’ দল থেকে ডাক পান তিনি। কিন্তু সাইমন্ডস সেই প্রস্তাব নাকচ করে দেন। খেলেন অস্ট্রেলিয়ার হয়ে। ১৯৯৮ সালে ওয়ানডেতে অভিষেক হয় তার। এরপরই লেখেন রূপকথার সব গল্প। ১৯৯৮ থেকে ২০০৯ সাল পর্যন্ত ক্যারিয়ারে অস্ট্রেলিয়ার হয়ে দুটি বিশ্বকাপ জেতেন সাইমন্ডস। এর মধ্যে ২০০৩ সালে অসিদের অপরাজিত চ্যাম্পিয়ন হওয়ার অন্যতম কারিগর ছিলেন তিনি। তবে জাতীয় দলে ১৯৯৮ সালে ডাক পেলেও তিনি নিয়মিত ছিলেন না। দলের কেউ ইনজুরিতে পড়লে তার স্থলাভিষিক্ত হিসেবে সুযোগ পেতেন সাইমন্ডস। বেশির ভাগ ম্যাচে নামাই হতো না তার। এভাবে চার বছর কাটিয়ে দেন তিনি। তারপর ২০০৩ সালের বিশ্বকাপে মহাকাব্য রচনা করে জাতীয় দলে নিজের জায়গা পাকাপোক্ত করে নেন সাইমন্ডস। বিশ্বকাপের ওই ম্যাচে মাত্র ৮৬ রানে ৪ উইকেট হারিয়ে বিপর্যয়ে পড়া দলকে এনে দেন ৩১০ রানের বিশাল সংগ্রহ। পাকিস্তানের ওয়াসিম আকরাম, ওয়াকার ইউনিস, শোয়েব আখতারদের সমন্বয়ে গড়া বোলিং ইউনিটের বিপক্ষে ১২৫ বলে ১৪৩ রানের অপরাজিত ইনিংস খেলেন সাইমন্ডস। ৮২ রানের জয় দিয়ে বিশ্বকাপ আসর শুরু করে অজিরা। দেশের হয়ে ১৯৮ ওয়ানডে ম্যাচে ৩৯.৭৫ গড়ে ৫০৮৮ রান করার পাশাপাশি বল হাতে শিকার করেন ৮২ উইকেট। ওয়ানডেতে এ অলরাউন্ডারের সেঞ্চুরি সংখ্যা ৬টি, যেখানে ফিফটির সংখ্যা ৩০টি। হার্ডহিটার ব্যাটার হিসেবেই সাইমন্ডসের কদর ছিল বেশি। যে কারণে তাকে টেস্ট ক্রিকেটের যোগ্য মনে করত না ক্রিকেট অস্ট্রেলিয়া (সিএ)। তা ছাড়া প্রথম বিভাগের ক্রিকেটেও তার পরিসংখ্যান খুব একটা ভাল ছিল না। ফলে ওয়ানডেতে অভিষেকের অনেক পর ২০০৪ সালে সাদা পোশাকে অভিষেক হয় তার। আর শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে টেস্ট শুরুর প্রথম ইনিংসে ডাক মারেন। দুই ম্যাচে চার ইনিংস মিলিয়ে করেন মাত্র ৫৩ রান। ফলে বাদ পড়েন তিনি টেস্ট দল থেকে। এরপর এক বছর আট মাস পর আবার সাদা পোশাকে জাতীয় দলের দুয়ার খোলে তার। এরপর ২৬ টেস্ট ম্যাচে ৪০.৬১ গড়ে ১৪৬২ রান করেন। এই সংস্করণে ২ সেঞ্চুরি ও ১০ ফিফটির মালিক সাইমন্ডস শুরুর মতোই ক্যারিয়ার শেষ করেন ডাক মেরে। এদিকে ১৪টি২ ম্যাচে দুই ফিফটিতে ৪৮.১৪ গড়ে ৩৩৭ রান করেন সাইমন্ডস। এই সংস্করণে এই হার্ডহিটারের ফিফটির সংখ্যা দুটি, যেখানে আছে ৮৫ রানের অপরাজিত সর্বোচ্চ রানের ইনিংস। ২০০৯ সালে নাটকীয়ভাবে বিশ্বকাপের দল থেকে বাদ পড়েন তিনি। মদপান করে মাঠে নামাসহ তার বিরুদ্ধে একাধিক অভিযোগে বিরক্ত ক্রিকেট অস্ট্রেলিয়া সে বছর তাকে তৃতীয়বারের মতো সাসপেন্ড করে এবং বোর্ডের সঙ্গে তার কেন্দ্রীয় চুক্তি বাতিল করে। এরপর অসিদের হয়ে মাঠে আর দেখা যায়নি তাকে। অবশ্য এরপরের সময়টা কাটিয়েছেন ইন্ডিয়ান প্রিমিয়ার লিগে। সেখানে ব্যাট হাতে দ্যুতি ছড়ালেও জাতীয় দলের দরজা আর খোলেনি তার জন্য। অবশেষে ২০১২ সালের ফেব্রুয়ারিতে সবধরনের ক্রিকেট থেকে অবসরের ঘোষণা দেন। সাইমন্ডসের অকাল মৃত্যুতে শোকস্তব্ধ এ্যাডাম গিলক্রিস্ট, ডেভিড ওয়ার্নার, স্টিভেন স্মিথ, ড্যালেন লেহম্যানসহ বর্তমান ও সাবেক তারকা ক্রিকেটার। ২০০৮ সালে সাইমন্ডসকে ‘বানর’ বলে বিতর্কের জন্ম দিয়েছিলেন হরভজন সিং। মাঙ্কিকেট কেলেঙ্কারি ভুলে সাবেক ভারতীয় স্পিন লিজেন্ডও আজ শোকাহত। শোক জানিয়েছেন বাংলাদেশ, শ্রীলঙ্কা, পাকিস্তান, ইংল্যান্ডসহ বিশ্বের সব ক্রিকেট খেলুড়ে দেশ। অহেতুক ঝামেলা, অতিরিক্ত মদ্য ও ধুমপান, অখেলোয়াড় সুলভ আচরণসহ বিভিন্ন কারণে ক্যারিয়ারে বেশ কয়েকবার তাকে মাঠের বাইরে থাকতে হয়েছে। কিন্তু ব্যক্তিজীবনে সাইমন্ডস ছিলেন অসাধারণ। স্ত্রী, কাছের বন্ধু, পরিবারের সদস্যদের কাছে ছিলেন অনেক প্রিয়। সাইমন্ডস যেখানে মারা গেছেন, সেখানে একটি চিঠি রেখে এসেছেন তার বোন লুসি, যা হৃদয় ছুঁয়ে যাওয়ার মতো। তিনি লিখেছেন, ‘অনেক তাড়াতাড়ি চলে গেলে! শান্তিতে ঘুমাও এ্যান্ড্রু। আরেকটা দিন যদি আমরা বেশি পেতাম, আরেকটি ফোন কল...। আমার হৃদয় ভেঙে গেছে। আমার ভাই, আমি সবসময় তোমাকে ভালবাসব।’ বাল্যবান্ধবী এ্যাঙ্গিলিকাল ক্যাথড্রিলের সঙ্গে ১১ বছর প্রেম করার পর ২০০৪ সালে তাকে বিয়ে করেন। এক বছর পরই তাদের ছাড়াছাড়ি হয়ে যায়। ওই বছরই লরার সঙ্গে পরিচয়। দীর্ঘ প্রেম থেকে পরিণয়। পুত্রসন্তান জন্মের পর ২০১৪ সালে দুজনে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন। কয়েক বছর আগে লরা এক সাক্ষাতকারে জানিয়েছেন, ব্যক্তিজীবনে সাইমন্ডস অনেক দায়িত্বশীলন, সন্তান পরিবারের জন্য যেকোনো ত্যাগ স্বীকারে সদা প্রস্তুত। কন্যার জন্মের সময় তাই আইপিএল থেকে ছুটি নিয়ে দেশে ফিরে গিয়েছিলেন। মাছ ধরতে, সবজি ফলাতে পছন্দ করতেন। ২০০৯ সালে খেলোয়াড়ি জীবন শেষে কুইন্সল্যান্ডের ট্রান্সভিলে বসত গাড়েন। সেখানেই গত শনিবার রাতে ব্যক্তিগত গাড়ি রাস্তা থেকে খাঁদে পড়ে তার মর্মান্তিক মৃত্যু হয়। সেই লরার জীবন, সন্তানদের জীবনে এখন শূন্যতা, শুধুই হাহাকার।
×