ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১

নাজনীন বেগম

নারী নির্মাণ শ্রমিকের জীবন লড়াই

প্রকাশিত: ০০:১৪, ১৭ মে ২০২২

নারী নির্মাণ শ্রমিকের জীবন লড়াই

বাংলাদেশ উন্নয়ন অভিযাত্রায় দৃষ্টিনন্দনভাবে এগিয়ে যাচ্ছে। বিশেষ করে অবকাঠামো উন্নয়নে দেশ এখন অনন্য যাত্রাপথে শামিল হচ্ছে। দেশকে সামনের দিকে চালিত করার অদম্য কর্মপ্রকল্পে মজুরি শ্রমিকদের অংশগ্রহণ প্রবৃদ্ধির আবশ্যিক শর্ত। অবকাঠামো তৈরিতে নির্মাণ শ্রমিকদের কর্মযোগ একপ্রকার সময় বিশেষে। কারণ সরকার কর্তৃক পরিকল্পিত কাঠামো বাস্তবায়নে নির্দিষ্ট বাজেট এবং সময় নির্ধারণ করা থাকে। সঙ্গত কারণে নির্মাণ ব্যবস্থাপনার সঙ্গে জড়িত সকলেই সময়ের নির্দিষ্ট সীমানায় তাদের শ্রমকে বিনিয়োগ করে। শ্রেণী বিভক্ত সমাজে মানুষে মানুষে ফারাক যেমন দৃষ্টিকটু একইভাবে নারী পুরুষের বৈষম্যও এক অবধারিত বিভাজন প্রক্রিয়া। তার ওপর শ্রমিকের ন্যায্য পাওনা থেকে বঞ্চিত হওয়ার দৃশ্যও বহু বছরের এক অনাকাক্সিক্ষত ইতিবৃত্ত। ১ মে আন্তর্জাতিক শ্রম দিবস ও ৮ মার্চ বিশ্ব নারী দিবসের তাৎপর্যে শোষণ-বঞ্চনার রিক্ততার ইতিহাস আজও সংশ্লিষ্টরা বয়ে বেড়াচ্ছে। এখনও শ্রমিকদের প্রাপ্ত মজুরি নিয়ে প্রশ্ন উঠছে। তাদের প্রতি অন্যায়-অবিচারে অসংহত কার্যকলাপ শ্রমিকদের বিক্ষুব্ধ করতেও সময় লাগে না। সেখানে নারী শ্রমিকের অবস্থা আরও করুণ এবং অসহনীয় দুর্ভোগ। আমার আলোচ্য বিষয় নির্মাণ নারী শ্রমিকদের দুর্দশা এবং তাদের নিত্য অসহনীয় জীবন। আগেই উল্লেখ করা হয়েছে নির্মাণ শ্রমিকরা নিত্য শ্রম বিনিয়োগ করার সুযোগ থেকে প্রায়ই বঞ্চিত। বছরের কোন একটা নির্দিষ্ট সময়ের নির্মাণ কাজে তাদের অংশীদারিত্ব চোখে পড়ার মতো। সেখানে কোন শ্রমিকই তাদের ন্যায্য মূল্য পায় না আন্তর্জাতিক শ্রম আইন নিরিখে। সেখানে অপেক্ষাকৃত দুর্বল ও পিছিয়ে পড়া নারীদের অবস্থা আরও শোচনীয় এবং ভয়াবহ। একে তো শারীরিকভাবে পিছিয়ে পড়ে ইট মাথায় নেওয়া, ভাঙ্গা, মাটি কাটা ও ঝাঁকা মাথায় মাটি এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় নিতে পুরুষ সহকর্মীর তুলনায় কিছুটা পশ্চাৎপদ তো বটেই। আবার শ্রম ঘণ্টায় নারী পুরুষের কোন পার্থক্যও নেই। কাজের ধরনও প্রায়ই অভিন্ন। কিন্তু মজুরির বেলায় নারী শ্রমিক কম টাকা পেয়ে থাকেন পুরুষের তুলনায়। পুরুষরা যদি পায় ৫০০ টাকা নারীর ভাগ্যে জুটে ৩৫০ টাকা। এমন অসাম্য বৈষম্য নিয়ে বহুবার কথা উঠেছে। কিন্তু কর্তৃপক্ষের টনক নড়েনি। শুধু তাই নয়, কোন শ্রমিকই জানে না তাদের যথার্থ মজুরি কি? আইনী অধিকারই বা কতখানি। আর নারীদের বেলায় তো সমস্যা আরও গভীরে। কারণ একজন নারী শ্রমিক তার কাজে আসার আগে সংসারের সমস্ত দায়িত্ব সামলিয়ে তবেই না কর্মক্ষেত্রে হাজির হওয়া। সারাদিনের রান্নাবান্না, সন্তানদের ঠিকঠাক গুছিয়ে দিয়ে আসা সবদিকেই সূক্ষ্ম নজরদারি করাও নারী শ্রমিকের সচেতন দায়বদ্ধতা। সংসারে যদি বৃদ্ধ মা-বাবা কিংবা শ্বশুর, শাশুড়ি থাকেন তাদের দেখভালের সার্বিক দায়িত্বও গৃহের গৃহিণীর ওপর। তেমন গৃহিণীকে যদি কাজে বেরুতে হয় সেখানে তাকে কাকডাকা ভোরে বিছানা ছাড়তে হয়। কিন্তু তার স্বামীটি যদি একই কাজের জায়গায় যায় তাকে কোন কিছুই ভাবতে হয় না। শ্রমিক স্ত্রীটি তার দুপুরের খাবার তাকে বেঁধে দেয়। নিজের জন্য কিছু থাকে কিনা বলা মুশকিল। আবার সন্তানদের যদি স্কুলে পাঠাতে হয় তেমন দায়ও যেন শুধুই মায়ের। আর মা যদি কর্মজীবী হন তাহলে সমস্যা কোথায় গিয়ে দাঁড়ায় ভাবাও যায় না। আবার কাজ বলতে যেমন তেমন কাজ নয়। কঠিন মাটি আর শক্ত ইটপাথর নিয়ে কাজ করার দুর্ভোগ অচিন্তনীয়। এতসব দায়দায়িত্ব সামলে নিয়ে যখন কর্মক্ষেত্রে হাজির হয় তখন দুর্বল শরীর আরও নাজুক হতেও সময় লাগে না। শুধু কি তাই? ভাববারও কি কোন অবকাশ থাকে? কাজের জায়গায় এসে চটজলদি হাত চালানো যেখানে আবশ্যকীয় দায় তেমন দুরবস্থা তো পদে পদে তাদের অসহনীয় করে তোলে। আর পুরুষ সহকর্মীর বাকবিত-া, অশোভন উক্তি এবং পরিস্থিতি বিষময় করে তুলতে অধঃস্তন কর্তৃপক্ষও কম যায় না। হাড়ভাঙ্গা শ্রমের বিনিময়ে যখন প্রাপ্য মজুরির জন্য হাত পাততে হয় সেখানেও জোটে লাঞ্ছনা, গঞ্জনা এবং কঠোর রোষানল। হিসাবের টাকা গুনতে গিয়ে বোধোদয় হয় পুরুষ সহকর্মীর তুলনায় তার মজুরি অপেক্ষাকৃত কম। শ্রম সময় একই এবং কাজের ধরনেও পার্থক্য দেখা যায় না- কিন্তু উপার্জন করা অর্থে কেন যে এত বৈষম্য সেটার কোন কূলকিনারাও পায় না। মনে হয় এটাই বুঝি নারী পুরুষের কাজের নিয়মবিধি। কিন্তু আন্তর্জাতিক শ্রম আইন এমন বৈষম্যপীড়িত নিয়মকে অনুমোদন পর্যন্ত দেয়নি। সবচেয়ে দুঃখজনক সংশ্লিষ্টরা সেভাবে অবগতও নয়। এমনিতে শিল্প কারখানা কিংবা অবকাঠামো নির্মাণ ব্যবসায়ীরা তাদের অত্যধিক মুনাফা অর্জনে শ্রমিক শ্রেণীকে নানা মাত্রিকে বিপন্ন করে তোলে। প্রথমত ন্যায্য পাওনা থেকে বঞ্চিত। তার ওপর আছে অস্বাস্থ্যকর পরিবেশ। স্যানিটেশনের ব্যাপারে নেই কোন সুচিন্তিত কর্ম পদক্ষেপ। তার ওপর নির্মাণ শ্রমিকদের কাজ করতে হয় খোলা আকাশের নিচে। রোদে পুড়ে, বৃষ্টিতে ভিজে তাদের জীবন প্রবাহ চলে এক অনাকাক্সিক্ষত পেষণে। নারীদের তো খাওয়া দাওয়ারও ঠিক থাকে না। তার ওপর শারীরিকভাবে নানা মাত্রিক অসহনীয় অবস্থাও মোকাবিলা করতে হয়। মাসের কয়েকদিন অস্থিরতায় কাটে, আবার গর্ভবর্তী মায়েদের কাজ করে যেতে হয়। ভাল সেনিটেশনের অব্যবস্থায়ও নারীরা চরম দুর্ভোগের শিকার হয়। কিন্তু এতসব ঝামেলা পোহানোর পরও মজুরি নিতে এসে যখন বঞ্চনায় নিপীড়িত হয় তেমন দুঃসময় সংশ্লিষ্টদের কাহিলও করে দেয়। এমন অসম বিভাজনের শেষ পরিণতি কোথায়। সমাধান আছে কি-না ভাবা দরকার।
×