ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ১৭ এপ্রিল ২০২৪, ৩ বৈশাখ ১৪৩১

অভিভাবক ও শিক্ষার্থীদের সচেতন হওয়ার পরামর্শ

উপবৃত্তির ভুয়া এসএমএস, কৌশলে হাতিয়ে নেয়া হচ্ছে অর্থ

প্রকাশিত: ২৩:১৬, ১৭ মে ২০২২

উপবৃত্তির ভুয়া এসএমএস, কৌশলে হাতিয়ে নেয়া হচ্ছে অর্থ

স্বপ্না চক্রবর্তী ॥ ‘প্রিয় শিক্ষার্থী! ঈড়ৎড়হধারৎঁং (ঈঙঠওউ-১৯) এর কারণে তোমাদের উপবৃত্তির ৪,২০০ টাকা দেয়া হচ্ছে। টাকা গ্রহণের জন্য নি¤েœাক্ত শিক্ষাবোর্ডের নম্বরে যোগাযোগ করুন। মোবা : ০১৮৭৬৮০৪৪৩৬. গোপন নম্বর : ১৯৫৮ শিক্ষামন্ত্রী (...) যোগাযোগের সময় সকাল ৯টা থেকে রাত ৯টা’ এমন একটি এসএমএস দেশের বিভিন্ন স্থানের মাধ্যমিক, উচ্চ মাধ্যমিকসহ নানা শ্রেণীর শিক্ষার্থী ও তাদের অভিভাবকের মোবাইলে পাঠিয়ে কৌশলে অর্থ হাতিয়ে নেয়ার চেষ্টা করছে একশ্রেণীর দুর্বৃত্ত। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী এরকম কয়েকটি চক্রকে গ্রেফতার করলেও আইনের ফাঁক গলে বের হয়ে আবারও তারা একইরকম প্রতারণামূলক কাজের সঙ্গে জড়িয়ে পড়ছে। রাজধানীর একটি কোচিং সেন্টারে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষার জন্য প্রস্তুতিমূলক কোচিং করছেন স্বর্ণালী রায় (ছদ্মনাম)। গত শুক্রবার তার বড় বোনের মোবাইলে উপবৃত্তির টাকা সংক্রান্ত এরকম একটি এসএমএস এলে তিনি ওই নাম্বারে কল ব্যাক করলে বিকাশ নাম্বার চেয়ে ফোনের অপর প্রান্তের ব্যক্তিটি বলে, আপনার বোনের দুই বছরের উপবৃত্তির টাকা জমা হয়েছে। আপনারা কি টাকা তুলবেন না?’ তখন তার পরিচয় জানতে চাইলেই অকথ্য ভাষায় কথা বলা শুরু করে লোকটি। শুধু স্বর্ণালী নয় এরকম এসএমএস পেয়েছেন রাজধানীর ইস্পাহানি গার্লস স্কুল এ্যান্ড কলেজের শিক্ষার্থী তিথিও। তবে শুধু এসএমএস করেই ক্ষান্ত হয়নি প্রতারক চক্র। তাকে ফোন করে বলেন, তোমার উপবৃত্তির টাকা পাওয়ার খবরটি আর কারও সঙ্গে আলাপ করা যাবে না। দ্রুত ১৫ থেকে ২০ মিনিটের মধ্যে আমাদের বিকাশ নাম্বারে ১ হাজার টাকা পাঠাও। এ টাকা তোমার এ্যাকউন্টেই থাকবে, কেউ কেটে নিতে পারবে না। ব্যাংক হিসাবের মতো তোমার নামে বিকাশে হিসাব চালু হবে। প্রতারকদের এ কথা বিশ্বাস করে তিথি তার বাবা-মাকে বলে এক হাজার টাকা পাঠালে পরক্ষণেই ওই ফোন নাম্বারটি বন্ধ পাওয়া যায়। শুধু রাজধানী নয় এরকম অভিযোগ পাওয়া গেছে টাঙ্গাইল, পাবনা, সিলেট, রাজশাহী চুয়াডাঙ্গাসহ দেশের নানা জায়গা থেকে। এসব এলাকার বিভিন্ন স্কুল কলেজের শিক্ষার্থীদের কাছে এরকম মেসেজ যাওয়ার পর তারা সরলমনে প্রতারক চক্রের চাহিদামতো টাকা দিচ্ছেন বিকাশ নাম্বারে। এতে করে হাজার হাজার টাকা ওই প্রতারক চক্র শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে হাতিয়ে নিচ্ছে। এ বিষয়ে যথেষ্ট সতর্ক অবস্থায় রয়েছে বলে জানান মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা বোর্ডের সচিব অধ্যাপক তপন কুমার সরকার। জনকণ্ঠকে তিনি বলেন, প্রতিবছরই আমরা স্কুল ও কলেজ পর্যায়ে নির্দিষ্ট সময়ে উপবৃত্তিপ্রাপ্তদের তালিকা পাঠাই। চলতি বছরও একই প্রক্রিয়ায় কাজ চলছে। কিন্তু আমাদের কাছে প্রতিবারই অভিযোগ আসে কিছু অসাধু মানুষ তালিকাগুলো স্কুল-কলেজে যাওয়ার পরপরই শিক্ষা বোর্ডের কর্মকর্তা ও কলেজের শিক্ষক পরিচয় দিয়ে শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের মোবাইল ফোনে বিভিন্ন নম্বর থেকে ফোন করে শিক্ষার্থীদের নাম-ঠিকানা এবং পিতা-মাতার নাম বা কলেজের ক্লাস রোল পর্যন্ত বলে দিচ্ছে। অনেক শিক্ষার্থীর অভিভাবকরা সম্মতি দিলে প্রতারক চক্র তাদের দেয়া বিকাশ নম্বরে নির্ধারিত অঙ্কের টাকা পাঠাতে বলে। এসব অভিযোগ পেলেই সঙ্গে সঙ্গে আমরা গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর কাছে পাঠিয়ে দেই। এরকম অনেকেই ধরাও পড়েছে। আবারও যখন তারা সক্রিয় হয়ে উঠেছে তখন নিশ্চয়ই আমরা ব্যবস্থা নেব। খোঁজ নিয়ে জানা যায় দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর প্রায় ৪০ শতাংশ শিক্ষার্থীকে প্রতারক চক্র ফোন দেয়। এর মধ্যে অন্তত ১০ শতাংশ মানুষ তাদের ফাঁদে পা দিয়ে বড় অঙ্কের টাকা খুইয়েছেন। হবিগঞ্জ সরকারী বৃন্দাবন কলেজের উচ্চ মাধ্যমিকের ছাত্রী তমার (ছদ্মনাম) মোবাইল নম্বরে গত বৃহস্পতিবার ফোন দেয় প্রতারক চক্র। শিক্ষা কর্মকর্তা পরিচয় দিয়ে ওই ফোনে উপবৃত্তির ৫০ হাজার টাকা দেয়ার কথা বলে বিকাশের মাধ্যমে ২৩ হাজার টাকা পাঠাতে বলা হয়। ঘটনার বর্ণনা দিয়ে তমার বড় বোন সোমা বলেন, আজ (বৃহস্পতিবার) বেলা ১১টার দিকে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তা পরিচয়ে ফোন দেন এক নারী। তমার কথা জিজ্ঞাসা করলে তিনি বড় বোন হিসেবে পরিচয় দেন। তমা তখন কলেজে ছিল। ওই নারী তখন তমা ৫০ হাজার টাকা পেয়েছে জানিয়ে একটি বিকাশ নাম্বারে ২৩ হাজার ৫০০ টাকা বিকাশ করে দিতে বলেন। তখন পাশের বাজারে গিয়ে তিনি ওই টাকা প্রতারক চক্রের বিকাশ নম্বরে পাঠান। এ ক্ষেত্রে শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের সচেতন হওয়ার আহ্বান জানিয়ে অধ্যাপক তপন কুমার সরকার বলেন, শিক্ষা বোর্ড কখনও বিদ্যালয় বা কলেজের মাধ্যম ছাড়া উপবৃত্তি দেবে না। এক্ষেত্রে কেউ যদি বিকাশ বা অন্য কোন মোবাইল ব্যাংকিং অথরিটির নাম ব্যবহার করে তাহলে সঙ্গে তাকে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর শরণাপন্ন হওয়ার পরামর্শ দেন তিনি। এসব প্রতারণার সঙ্গে বিকাশের কোন ধরনের সংশ্লিষ্টতা নেই জানিয়ে বিকাশের হেড অব কর্পোরেট কমিউনিকেশন্স শামসুদ্দিন হায়দার ডালিম জনকণ্ঠকে বলেন, এসব প্রতারক শুধু বিকাশ নয় অন্যান্য মোবাইল ব্যাংকিংকেও ব্যবহার করে প্রতারণার কাজে। আমাদের কাছে এরকম অভিযোগ এলে সঙ্গে সঙ্গে আমরা ব্যবস্থা নেই। এ সংক্রান্ত আমাদের একটি টিম রয়েছে যারা সবসময় বিষয়টি পর্যবেক্ষণ করে। বিকাশের নাম ব্যবহার করে প্রতারণা করলে কাউকে ছাড় দেয়া হবে না। তবে এসব প্রতারকদের বিরুদ্ধে অভিযোগ পেলে সঙ্গে সঙ্গে ব্যবস্থা নেয়া হয় উল্লেখ করে পুলিশের গোয়েন্দা শাখার (ডিবি) অতিরিক্ত কমিশনার এটিএম হাফিজ আক্তার জনকণ্ঠকে বলেন, এখন পর্যন্ত আমাদের কাছে শিক্ষার্থীদের উপবৃত্তির টাকা নিয়ে প্রতারণার যত অভিযোগ এসেছে তাদের খুঁজে বের করে আমরা আইনের আওতায় নিয়ে এসেছি। ভবিষ্যতেও তা অব্যাহত থাকবে। আমাদের কোমলমতি শিক্ষার্থীদের সঙ্গে কেউ প্রতারণা করে পার পাবে এমনটি ভাবার সুযোগ নেই।
×