ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

ইন্টারপোল থেকে এনসিবিকে ইলেক্ট্রনিক বার্তা ভারতে থাকা তার সম্পদের খোঁজ চলছে দেশে ফিরতে চান পি কে হালদার

পি কে হালদারকে ফেরাতে কাজ করছে দুদক

প্রকাশিত: ২৩:০৭, ১৭ মে ২০২২

পি কে হালদারকে ফেরাতে কাজ করছে দুদক

স্টাফ রিপোর্টার ॥ হাজার হাজার কোটি টাকা আত্মসাত ও পাচার করে দেশ থেকে পালিয়ে ভারতে গ্রেফতার প্রশান্ত কুমার হালদার (পি কে হালদার), স্ত্রী ভাইসহ ৬ জনকে বাংলাদেশে ফিরিয়ে আনতে ভারতের ইন্টারপোল, দেশটিতে বাংলাদেশের হাইকমিশন ও বাংলাদেশের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে কাজ শুরু করেছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। ভারতে থাকা তার সম্পদের খোঁজে নেমেছে সংস্থাটি। ইতোমধ্যে বাংলাদেশে অবস্থিত ইন্টারপোল থেকে ভারতের দিল্লীতে অবস্থিত ন্যাশনাল সেন্টার ব্যুরোতে (এনসিবি) আসামিদের বাংলাদেশে প্রত্যার্পণে ইলেক্ট্রনিক বার্তা পাঠানো হয়েছে। এদিকে অর্থ পাচারের অভিযোগে পশ্চিমবঙ্গে পি কে হালদারকে গ্রেফতারের তথ্য আদালতকে জানিয়েছে রাষ্ট্রপক্ষ। সোমবার বিচারপতি মোঃ নজরুল ইসলাম তালুকদার ও বিচারপতি কাজী মোঃ ইজারুল হকের সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট বেঞ্চে রাষ্ট্রপক্ষ এ সংক্রান্ত রুল শুনানির জন্য উপস্থাপন করেন। এ সংক্রান্ত রুল আজ মঙ্গলবার শুনানির জন্য কার্যতালিকায় থাকবে বলে জানিয়েছেন আদালত। অন্যদিকে অর্থ পাচারের অভিযোগে পশ্চিমবঙ্গে গ্রেফতার পি কে হালদার সাংবাদিকদের বলেছেন, তার বিরুদ্ধে আনা অভিযোগ ভিত্তিহীন। দেশে ফিরতে চান বলেও জানিয়েছেন আলোচিত এ ব্যক্তি। ভারতের কেন্দ্রীয় অর্থ মন্ত্রণালয়ের তদন্তকারী সংস্থা এনফোর্সমেন্ট ডিরেক্টরেট (ইডি) শনিবার পশ্চিমবঙ্গের উত্তর চব্বিশ পরগনার অশোকনগর থেকে পি কে হালদারসহ ছয়জনকে গ্রেফতার করে। তাদের মধ্যে এক নারী রয়েছেন। ওই ছয়জনকে গ্রেফতারের দিনই আদালতে উপস্থাপন করা হলে পাঁচজনকে তিন দিনের হেফাজতে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদের অনুমতি পায় ইডি। গ্রেফতার নারীকে কারা হেফাজতে রাখার নির্দেশ দেয় আদালত। গোয়েন্দা সংস্থাটির হেফাজতে থাকা পি কে হালদারসহ পাঁচ পুরুষকে সোমবার সকালে রুটিন চেকআপের জন্য পশ্চিমবঙ্গের বিধাননগর মহকুমা হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে ঘণ্টাখানেক রাখার পর ইডির সল্টলেকের সিজিও কমপ্লেক্সের অফিসে তাদের ফিরিয়ে আনেন তদন্তকারীরা। ইডির কার্যালয়ে লিফটের এক কোনায় মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে ছিলেন পি কে হালদার। ওই সময় লিফটের বাইরে থাকা সাংবাদিকরা তার কাছে অভিযোগের বিষয়ে জানতে চান। জবাবে পি কে হালদার বলেন, ‘আমি দেশে ফিরতে চাই। আমার বিরুদ্ধে যে অভিযোগ আনা হয়েছে তা ভিত্তিহীন।’ ইডি সূত্র জানিয়েছে, হাজার হাজার কোটি টাকা আত্মসাত, বিভিন্ন দেশে অর্থ পাচারের অভিযোগে পি কে হালদারসহ পাঁচজনকে গত রবিবার দীর্ঘ সময় ধরে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে। ইডি আরও জানায়, ভোটার কার্ড, আধার কার্ড ও নকল পাসপোর্ট ব্যবহার করে ভারতীয় নাগরিক হিসেবে অবৈধভাবে দেশটিতে ছিলেন গ্রেফতার ব্যক্তিরা। তারা জালিয়াতি করে যাচ্ছিলেন। সোমবার পি কে হালদারের বিষয়ে দুদকের ভারপ্রাপ্ত সচিব সাঈদ মাহবুব খান সাংবাদিকদের বলেন, ভারতের পশ্চিমবঙ্গের উত্তর চব্বিশ পরগনা জেলার বারাসাতের অশোকনগর এলাকা থেকে দেশটির কেন্দ্রীয় আর্থিক গোয়েন্দা সংস্থা ইডি প্রশান্ত কুমার হালদার ও তার পাঁচ সহযোগীকে গ্রেফতার করেছে বলে জানতে পেরেছি। আসামিদের দেশে ফিরিয়ে আনার জন্য আইনগত প্রক্রিয়ায় দুদকের চেষ্টা অব্যাহত রয়েছে। তিনি বলেন, প্রশান্ত কুমার হালদারসহ ৬ জন গ্রেফতার হওয়ার তথ্য জানার পর এরইমধ্যে আগে জারি করা রেড এলার্ট নোটিস এবং দুদকের দায়ের করা মামলার সূত্রে বাংলাদেশে অবস্থিত ইন্টারপোলের অফিস থেকে ভারতের দিল্লীতে অবস্থিত ন্যাশনাল সেন্টার ব্যুরোতে (এনসিবি) আসামিদের ভারত থেকে বাংলাদেশে প্রত্যর্পণে ইলেক্ট্রনিক বার্তা পাঠানো হয়েছে। শীঘ্রই আরও কিছু কার্যক্রম নেয়ার কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, আসামিদের দ্রুত দেশে ফিরিয়ে আনার জন্য দুদক শীঘ্রই আরও কিছু কার্যক্রম হাতে নেবে। আসামিদের ফেরাতে ভারতে অবস্থিত বাংলাদেশের দূতাবাসে চিঠি দেয়া হবে। একইসঙ্গে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে চিঠি দেয়া হবে। ভারতে পাচার করা অর্থ ও ব্যাংক হিসাবের তথ্য সংগ্রহের জন্য বিআইএফইউ বরাবর পুনরায় চিঠি দেয়া হবে। ভারপ্রাপ্ত সচিব বলেন, আসামি প্রশান্ত কুমার হালদারের বিরুদ্ধে জ্ঞাত আয়বহির্ভূত প্রায় আড়াইশ’ কোটি টাকার অবৈধ সম্পদ অর্জন ও মানিলন্ডারিং অপরাধের দায়ে তার বিরুদ্ধে দুর্নীতি দমন কমিশন থেকে ২০২০ সালের ৮ জানুয়ারি একটি মামলা রুজু করা হয়। মামলা তদন্তের সময় আসামি প্রশান্ত কুমার হালদারকে গ্রেফতার করার চেষ্টা করা হলে তিনি বিদেশে পালিয়ে যান। বিদেশে পলাতক থাকায় তাকে গ্রেফতার করার জন্য স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে আন্তর্জাতিক সংস্থা ইন্টারপোলের সহযোগিতা চেয়ে চিঠি দেয়া হয়। পরে ইন্টারপোলের চাহিদা অনুযায়ী আদালতের আদেশে আসামির বিরুদ্ধে ওয়ারেন্ট অব এ্যারেস্ট জারি করা হয়। এরপর আদেশসহ আসামির আঙ্গুলের ছাপ এবং অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ তথ্য ২০২১ সালের শুরুর দিকে ইন্টারপোল বরাবর পাঠানো হয়। আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে ইন্টারপোল আসামির বিরুদ্ধে ২০২১ সালের জানুয়ারি মাসে রেড এলার্ট জারি করে। পরে নিয়মিত সংস্থাটির সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করে আসামির অবস্থান ও তথ্য জানার চেষ্টা করা হয়। এর আগে দেশের বিভিন্ন ব্যাংক/ আর্থিক প্রতিষ্ঠান এবং ভারত, কানাডা, যুক্তরাষ্ট্র, সিঙ্গাপুর ও সংযুক্ত আরব আমিরাতসহ বিদেশে আর্থিক লেনদেনের তথ্য সংগ্রহ করে পাঠানোর জন্য বিআইএফইউ বরাবর যথাযথ প্রক্রিয়ায় চিঠি দেয়া হয়েছিল। কতদিনের মধ্যে ফেরত আনা যাবে, এমন প্রশ্নের জবাবে সাঈদ মাহবুব খান বলেন, ভারতে বেশকিছু মামলা হয়েছে, হয়ত আরও মামলা হবে। একটা মামলায় রিমান্ডেও নিয়েছে। এখন আমাদের দিক থেকে প্রেসার ও চেষ্টা থাকবে যে, যত দ্রুত তাকে আমরা আমাদের দেশে নিয়ে আসতে পারি। সেজন্য ভারতীয় কর্তৃপক্ষের কাছে আমাদের অনুরোধ অব্যাহত থাকবে। সেখান থেকে কত দিনের মধ্যে ফেরত আনা যায় সেটা স্পেসিফিক বলা কঠিন। সেখানে মামলা বা এর বিচার কতদিন লাগবে অথবা বিচারের আগে ফেরত আনা যাবে কি যাবে না, এসব কারণে সময়ের বিষয়টি নির্দিষ্ট করে বলা যাবে না। গ্রেফতারের তথ্য জানাল রাষ্ট্রপক্ষ, আজ শুনানির জন্য কার্যতালিকায় থাকবে ॥ হাজার হাজার কোটি টাকা আত্মসাত ও পাচারকারী পি কে হালদারকে গ্রেফতারের তথ্য আদালতকে জানিয়েছে রাষ্ট্রপক্ষ। সোমবার বিচারপতি মোঃ নজরুল ইসলাম তালুকদার ও বিচারপতি কাজী মোঃ ইজারুল হকের সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট বেঞ্চে রাষ্ট্রপক্ষ এ সংক্রান্ত রুল শুনানির জন্য উপস্থাপন করেন। এ সংক্রান্ত রুল আজ মঙ্গলবার শুনানির জন্য কার্যতালিকায় থাকবে বলে জানিয়েছেন আদালত। সোমবার সকালে ডেপুটি এ্যাটর্নি জেনারেল এ কে এম আমিন উদ্দিন বিষয়টি আদালতে উপস্থাপন করেন। দুদকের পক্ষে ছিলেন আইনজীবী খুরশীদ আলম খান। একপর্যায়ে আদালত বলেন, ‘আমাদের মেসেজ ক্লিয়ার। দুর্নীতি ও অর্থ পাচারের অপরাধের বিরুদ্ধে আমরা জিরো টলারেন্স। কাউকে ছাড় দেয়া হবে না, সে যেই হোক। আমরা এ বিষয়ে সিরিয়াস।’ পি কে হালদারকে গ্রেফতার ও দেশে ফিরিয়ে আনা প্রশ্নে দেড় বছর আগে স্বতঃপ্রণোদিত রুল দিয়েছিলেন হাইকোর্ট। এ রুলের চূড়ান্ত নিষ্পত্তি এখনও হয়নি। রুলে পি কে হালদারকে গ্রেফতার ও দেশে ফিরিয়ে আনতে বিবাদীদের নিষ্ক্রিয়তা-ব্যর্থতা কেন বেআইনী হবে না এবং এ ক্ষেত্রে দায়ী ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে প্রয়োজনীয় আইনগত ব্যবস্থা নিতে কেন নির্দেশ দেয়া হবে না, তা জানতে চাওয়া হয়। এ রুল এখন হাইকোর্টে চূড়ান্ত শুনানির জন্য উঠছে। পরে ডেপুটি এ্যাটর্নি জেনারেল এ কে এম আমিন উদ্দিন বলেন, ‘পি কে হালদারকে গ্রেফতার ও দেশে ফিরিয়ে আনার বিষয়ে হাইকোর্টের স্বতঃপ্রণোদিত রুল ছিল। সেই রুলের পরিপ্রেক্ষিতে তাকে গ্রেফতারের বিষয়ে ইন্টারপোলে রেড নোটিস জারি করা ছিল। ইতোমধ্যে মিডিয়ার মাধ্যমে জানতে পেরেছি, পি কে হালদার ভারতের পশ্চিমবঙ্গে গ্রেফতার হয়েছেন। বিষয়টি আদালতের নলেজে এনেছি। রুল শুনানির জন্য মেনশন করেছি। মঙ্গলবার বিষয়টি কার্যতালিকায় আসবে।’ ৩৪ মামলার মধ্যে তিনটির তদন্ত শেষ পর্যায়ে ॥ আলোচিত পি কে হালদার সিন্ডিকেটের বিরুদ্ধে অনুসন্ধান শুরুর চার মাস পর প্রথম মামলা করে দুদক। ২০২০ সালের ৮ জানুয়ারি ২৭৫ কোটি টাকার অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগে মামলা করেন সংস্থাটির উপ-পরিচালক মোঃ সালাউদ্দিন। পরে দুদকের আরেক উপ-পরিচালক গুলশান আনোয়ার প্রধানের নেতৃত্বে একটি টিম আর্থিক কেলেঙ্কারির বিষয়ে অনুসন্ধান শুরু করে। ওই টিম বিগত দুই বছরে অন্তত ৩৪টি মামলা করে। এছাড়া অবৈধ সম্পদ অর্জনের মামলার চার্জশীট ২০২১ সালের নবেম্বরে দাখিল করা হয়। যেখানে ৪২৬ কোটি টাকার জ্ঞাত আয় বহির্ভূত সম্পদ অর্জন ও বিভিন্ন ব্যাংক হিসাবে প্রায় ৬ হাজার ৮০ কোটি টাকা লেনদেনের অভিযোগে এনআরবি গ্লোবাল ব্যাংক ও রিলায়েন্স ফাইন্যান্স লিমিটেডের সাবেক এমডি পি কে হালদারসহ মোট ১৪ জনের বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র দেয় দুদক। অন্যদিকে ৩৪ মামলার মধ্যে তিনটির তদন্ত শেষ পর্যায়ে রয়েছে। বাকিগুলো তদন্তাধীন। এসব মামলার তদন্তে এখন পর্যন্ত ১২ আসামিকে গ্রেফতার করা হয়েছে। তাদের মধ্যে উজ্জ্বল কুমার নন্দী, পি কে হালদারের সহযোগী শংখ বেপারী, রাশেদুল হক, অবন্তিকা বড়াল ও নাহিদা রুনাইসহ ১০ জন আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দী দিয়েছেন। এছাড়া এক হাজার কোটি টাকা সমমূল্যের সম্পদ অবরুদ্ধ ও জব্দ করা হয়েছে। এর মধ্যে আদালতের মাধ্যমে ৬৪ জনের বিদেশ যাত্রায় নিষেধাজ্ঞা দেয়া হয়। একই ইস্যুতে ৩৩ ব্যক্তির সম্পদ বিবরণীর নোটিস জারি করা হয়েছে। এর মধ্যে দুজন সময়মতো জমা না দেয়ায় তাদের বিরুদ্ধেও মামলা করা হয়।
×