ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ২৩ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১

ড. এম মেসবাহউদ্দিন সরকার

প্রধানমন্ত্রীর ভাবনায় শিশু-কিশোর

প্রকাশিত: ২০:৩০, ১৬ মে ২০২২

প্রধানমন্ত্রীর ভাবনায় শিশু-কিশোর

কলাবাগান এলাকার শিশু-কিশোরদের এবারের ঈদ স্মরণীয় হয়ে থাকবে। কারণ, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশে তেঁতুলতলা মাঠটি তাদের জন্য ছেড়ে দেয়া হয়েছে। ফলে, মাঠটিতে শিশু-কিশোররা গত পঞ্চাশ বছর যাবত যেমন খেলাধূলা করত, এখন থেকে সেভাবেই চলবে শিশু-কিশোরদের এই চাওয়া-পাওয়া। বাংলাদেশের প্রত্যেকটি শিশু এক একটি রাসেল। তাই এই আন্দোলনে জয়ী হলেন পরিবেশকর্মী, সমাজকর্মী ও শিশু-কিশোররা। রাসেলের মতো শিশু-কিশোররা এবং প্রধানমন্ত্রী নিজে স্মরণীয় হয়ে থাকলেন মাঠ দখলের বিরুদ্ধে আন্দোলনকারী সৈয়দা রতœা বেগম ও তার কিশোর ছেলের বিনা ওয়ারেন্টে ও বিনা মামলায় থানায় ১৩ ঘণ্টা আটক রাখার ঘটনা। নিষ্পাপ ওই কিশোরকে এভাবে থানার লকআপে আটকে রাখা প্রচলিত শিশু-আইন ও সংবিধানবিরোধী। এটি মানবাধিকার লঙ্ঘনে ফৌদজারি অপরাধ ছাড়াও জাতিসংঘের শিশু সুরক্ষা সনদের পরিপন্থী। সে হিসেবে কলেজ পড়ুয়া ১৭ বছরের কিশোরটি সৌভাগ্যবান। পরিবেশকর্মী রতœা বেগমকেও ছেড়ে দিয়েছে পুলিশ কোন মামলা ছাড়াই। এজন্য পুলিশ প্রশাসনকে ধন্যবাদ দিতেই হয়। ১৭ বছরের কিশোরটিকে লকারে ঢোকানোর সময় ওই পুলিশ একবারও ভাবেনি যে, ঐরকম একটি সন্তান তার নিজেরও আছে। কিশোরটি যখন ১৩ ঘণ্টা বিনা অপরাধে আবদ্ধ ছিল, তার মানসিক অবস্থা কেমন হয়েছিল, কি ধারণা পোষণ করল সে দেশের পুলিশ সম্পর্কে? মা ও ছেলেকে একসঙ্গে একই রুমে রাখার জন্য মা রতœা বেগমের বারংবার অনুরোধও শোনেনি পুলিশ। তাহলে এই ছেলেটি কিভাবে শিখবে যে, পুলিশ জনগণের বন্ধু! উল্লেখ্য, এলাকাবাসীর নিরাপত্তার স্বার্থে কলাবাগানে থানা স্থাপনের জন্য স্থানীয় সাংসদ স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীকে ডিও লেটার দেন। সকল প্রক্রিয়া শেষে পুলিশ প্রশাসন ২৭ কোটি ৫৪ লাখ ৪১ হাজার ৭১০ টাকা পরিশোধ করে সেখানে নির্মাণ কাজে হাত দেয়। জনগণের নিরাপত্তা অবশ্যই গুরুত্বপূর্ণ এবং সেজন্য থানাও দরকার। কিন্তু খেলার মাঠও কি কম জরুরী? তাহলে প্রশাসনের এতটা ধাপে খেলার মাঠটিকে টিকিয়ে রাখার চিন্তা কারও মাথায় আসেনি কেন? আর থানা ভবনের জন্য খেলার মাঠকেই বেছে নিতে হবে কেন? ব্যস্ত রাস্তার মাঝখানে কিংবা ফুটপাথের ওপরও অনেক পুলিশ বক্স নির্মাণ করা হয়েছে। এতে জনগণের নিরাপত্তা কতটুকু নিশ্চিন্ত হয়েছে, তা নিরূপণ করতে না পারলেও পথচলায় যে ভোগান্তি বেড়েছে, তা বলা যায়। নগর পরিকল্পনায় ২ থেকে ৩ হাজার মানুষের জন্য ন্যূনতম একটা খেলার মাঠ লাগে, যার আয়তন ন্যূনতম এক একর (তিন বিঘা) হওয়ার কথা। ঢাকা শহরের পরিকল্পনা অনুযায়ী, একটি পাড়া-মহল্লায় প্রতি ১২,৫০০ মানুষের জন্য দুই থেকে তিনটি খেলার মাঠ থাকা উচিত। কলাবাগান একটি ঘনবসতিপূর্ণ এলাকা। আনুমানিক ৩০ হাজারের মতো মানুষের বসবাস এবং এখানে ৪-৫টি খেলার মাঠ থাকার কথা। এভাবে সমস্ত ঢাকায় দরকার ১৩০০ মাঠ। কিন্তু আছে মাত্র ২৩৫টি। আবার এই মাঠগুলোর মধ্যে মাত্র ৪২টি মাঠে আছে সাধারণের প্রবেশাধিকার, প্রতিষ্ঠানের অধিকারে আছে ১৪১টি এবং কলোনির মাঠ আছে ২৪টি। এর বাইরে ঈদগাহ মাঠ আছে ১২টি। আর ১৬টি মাঠ দখল করে আছে কোন না কোন সাংস্কৃতিক বা সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠান। বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানার্সের (বিআইপি) তথ্যমতে, বর্তমানে ঢাকা উত্তরে ৩৬টি ওয়ার্ডে মাঠের ঘাটতি আছে ৬১০টি, আর দক্ষিণে ৫৬টি ওয়ার্ডে মাঠের ঘাটতি ৪৬১টি। একটিও মাঠ নেই এমন ওয়ার্ডের সংখ্যা ৪। সক্রিয় মাঠগুলোর আরেক বাস্তবতা হচ্ছে, প্রায়ই তাতে আয়োজন করা হয় নানা মৌসুমি মেলার। মেলাকে কেন্দ্র করে বিভিন্ন স্টলের অনুমোদন দেয়া হয়। কিন্তু মেলা শেষে স্টলগুলো উঠিয়ে নিলেও ছোট কিছু দোকান থেকে যায়, যা নিয়ন্ত্রণ করে এলাকার বড় ভাই। এসব কারণেও মাঠের মূল উদ্দেশ্য ব্যাহত হয়। বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার মতে, একটি শহরে প্রতিটি মানুষের জন্য থাকতে হবে ৯ বর্গমিটার খোলা জায়গা, ঢাকায় তা আছে মাত্র ১ বর্গমিটার। জনসংখ্যার হিসাবে যেখানে ঢাকায় থাকার কথা ছিল প্রায় ১ হাজার ৩০০ খেলার মাঠ, সেখানে দুই সিটি কর্পোরেশনের কাছে আছে মাত্র ২৩৫টি। অর্থাৎ, মাঠের ঘাটতি প্রায় ১ হাজার ১০০। এমতাবস্থায় শিশু-কিশোররা নিজেদের এলাকায় খেলার মাঠ না পেয়ে বিভিন্ন পার্কে খেলতে যায়। কিন্তু সেখানেও অনেক জায়গায় সাইনবোর্ড ঝুলিয়ে বিধি-নিষেধ লেখা থাকে। বিভিন্ন পাড়া-মহল্লায় যেসব ছোট ছোট পার্ক আছে, সেগুলো এতই নোংরা ও অপরিষ্কার যে, খেলাধুলার কোন পরিবেশ থাকে না। এখানে ছোট ছোট চায়ের দোকানে পান-সিগারেটের নামে বেচাকেনা হয় মাদকদ্রব্য। আনাগোনা থাকে মাদকসেবী বখাটে ও কিশোর গ্যাংদের। নির্দ্বিধায় চলে ইভটিজিং। অপরিকল্পিত নগরায়ণের ফলে রাজধানীতে খেলার মাঠের সংখ্যা ক্রমেই হ্রাস পাচ্ছে। এটি শিশুদের শারীরিক ও মানসিক বিকাশে নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে বলে সতর্ক করেছেন মনোবিজ্ঞানীরা। তাদের মতে, খেলার মাঠ, পার্ক এবং খোলা জায়গার সঙ্কট কিশোর অপরাধ বৃদ্ধির সঙ্গে নিবিড়ভাবে জড়িত। পরিবেশকর্মী সৈয়দা রতœা বেগম ও তার কিশোর ছেলের মাঠ রক্ষার এই আন্দোলনে প্রধানমন্ত্রীর শুভ দৃষ্টি পড়েছে। শিশু-কিশোররা ফিরে পেয়েছে তাদের প্রাণের মাঠ, সরব হলো তাদের হৈচৈ ও কলরব। দূরদৃষ্টিপূর্ণ প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা নিমেষে জয় করে নিলেন এলাকার মানুষ ও শিশুদের মন। একইভাবে তিনি জয় করতে পারেন সারাদেশের শিশুদের মন, ইচ্ছা-আকাক্সক্ষা ও ভালবাসাকেও। রাজউকের হিসাব মতে, ঢাকায় এখনও দখল হওয়া মাঠ ও পার্কের পরিমাণ ৬ হাজার ৯০০ একর। সারাদেশের অবস্থা কি তা সহজেই অনুমেয়। তাই ঢাকাসহ সারাদেশের দখল হওয়া খেলার মাঠগুলো রক্ষায় প্রধানমন্ত্রী একইভাবে উদ্যোগ নেবেন এবং ক্রিকেট, ফুটবলসহ হারিয়ে যাওয়া গ্রাম-বাংলার সকল খেলাধুলা যাতে চর্চা হয় সেই নির্দেশনাও দেবেন। মাঠে যাতে কোনরকম স্থাপনা তৈরি না হয়, সেদিকে কঠোর হুঁশিয়ারি এবং মাঠগুলো পরিচালনার জন্য নির্দলীয় ক্রীড়ানুরাগী ব্যক্তিদের সমন্বয়ে কমিটি তৈরি করার নির্দেশনা দেবেন। শিশুদের এই অধিকার ফিরিয়ে দেয়ার আন্তরিকতায় বাংলাদেশের সকল শিশু-কিশোরদের মনে তিনি বেঁচে থাকবেন আজীবন। সবশেষে, পুলিশ জনগণের বন্ধু এবং জনগণের জন্যই পুলিশ। জঙ্গী দমনে এবং দেশ গঠনে পুলিশের ভূমিকা খুবই প্রশংসনীয়। কিন্তু মাঝে মধ্যে কিছু পুলিশের নেতিবাচক কর্মকান্ড গর্বিত পুলিশের নানা সাফল্য ও অবদানকে প্রশ্নবিদ্ধ করছে। তাই কোন কর্মকা- যেন পুলিশ ও জনগণকে মুখোমুখি দাঁড় না করায় সেদিকে সজাগ দৃষ্টি রাখতে হবে সকল মহলকে। লেখক : অধ্যাপক, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
×