ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ১৮ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১

সাগর রহমান

লন্ডনের চিঠি ॥ লণ্ডনের ভোটকেন্দ্রে একদিন

প্রকাশিত: ২১:২৭, ১৫ মে ২০২২

লন্ডনের চিঠি ॥ লণ্ডনের ভোটকেন্দ্রে একদিন

৫ মে। এইদিন যে এখানে দেশজুড়ে লোকাল গবর্র্নমেন্টের নির্বাচন, এলাকার কাউন্সিলর এবং মেয়র নির্বাচন- সেটা বেমালুম ভুলে গিয়েছিলাম। মনে পড়ল কাজ শেষে বাড়ি ফেরার পথে স্টেশনে পাওয়া ফ্রি পত্রিকা ইভনিং স্ট্যান্ডার্ডের খবর পড়ে। আমার ভোটকেন্দ্র পড়েছে বাড়ির পাশের চার্চে। ফলে, আয়োজন করে ভোট দিতে কোথাও যাবার বিষয়ও নেই। স্রেফ বাড়ি ফেরার পথে চার্চে ঢুকলাম ভোট দিতে। সময় তখন শেষবিকেল। এ চার্চে যে ভোটকেন্দ্র সেটা বাহির থেকে দেখে কোনভাবেই বোঝার উপায় নেই। কোন পোস্টার নেই, ব্যানার নেই, ফেস্টুন নেই, গেট নেই, প্রহরী নেই, পুলিশ নেই, জনগণের জটলা নেই, প্রার্থীদের উপস্থিতি নেই, সমর্থনদের উপস্থিতি নেই, নিদেনপক্ষে গেটের বাইরে একটা কোন পরিচিতিমূলক ব্যানার বা সাইনবোর্ড থাকা তো উচিত- তাও নেই। যেহেতু দিন কতক আগে কাউন্সিল থেকে বাসায় চিঠি পাঠিয়ে জানিয়ে দিয়েছে যে ভোট দিতে হলে আমাকে এখানে যেতে হবে, সেজন্যই আমি জানি, না হলে জানতামও না কোথায় আমার ভোটকেন্দ্র। ভোটকেন্দ্রের বাইরে একটা মানুষও দাঁড়িয়ে নেই । সরকারের পক্ষ থেকে কেউ একজন তো অন্তত বাইরে দাঁড়িয়ে থাকতে পারত মানুষকে দিকনির্দেশনা দেয়ার জন্য। আমি তো প্রথম ভেবেছিলাম ভোট গ্রহণ কি বন্ধ তবে! কিন্তু যতদূর জানি, এদেশে ভোট গ্রহণ চলে রাত দশটা পর্যন্ত। সুতরাং, এত তাড়াতাড়ি ভোট গ্রহণ বন্ধ হবার প্রশ্নই আসে না। কাঁচের গেটটার ভেতরে নজর করে দেখলাম, হ্যাঁ, সামান্য কয়েকজন মানুষ দেখা যাচ্ছে। গেটের গায়ে কাগজসাঁটা: ধাক্কা দিন। যথারীতি ধাক্কা দিলাম, গেটটা খুলল, আমি ভোটার হিসেবে মুখে আলগা একটা গাম্ভীর্য এনে ভেতরে ঢুকে পড়লাম। কিন্তু ভেতরে ঢুকেই বুঝলাম, গাম্ভীর্যভাব দেখিয়ে নিজের গুরুত্ব প্রকাশ করার কোন রাস্তাই নেই ভেতরে। দরজার ঠিক পরপর, মাত্র এক ফুট মতো দূরত্বে দুটো বড় টেবিল পাতা। একটা ডানে। আরেকটা বামে। প্রতিটি টেবিলে তিন-চারজন করে ভদ্রমহিলা এবং ভদ্রলোক বসে আছেন। তাদের সামনে কাগজপত্র। আমি যে ভেতরে ঢুকলাম, কেউ ফিরেও তাকাল না। এখন বামে না ডানে যাবÑ সে দ্বিধা-দ্বন্দে¦ ভুগতে শুরু করেছি। আমার সামনে একজন মাত্র ভোটার, তিনি বামের টেবিলে গিয়ে নিজের নাম-পরিচয় দিচ্ছেন। আমি ইতস্তত দাঁড়িয়ে আছি দেখে বোধহয় ডানের টেবিলের (যেখানে ঐ মুহূর্তে কোন ভোটার নেই) ভদ্রমহিলার মনে দয়া হলো। তিনি আমার দিকে তাকিয়ে হাসলেন এবং সামনে এগিয়ে যেতে বললেন। ইতোমধ্যে আমি বুঝে ফেলেছি ঘটনা। দুই টেবিলের সামনেই টেবিল ক্লথের বর্ধিত অংশের মতো করে বেশ লম্বা একটা কাগজ টানানো। তাতে আট দশটা করে রাস্তার নাম লেখা। অর্থাৎ, আমি যে রাস্তায় থাকি (যেখানে আমার বাসা), সেটা যে টেবিলে লেখা- আমাকে সে টেবিলে যেতে হবে। একটু চোখ বুলিয়েই বুঝলাম, ডানের টেবিলই আসলে আমার উদ্দিষ্ট। এগিয়ে গিয়ে ভদ্রমহিলাকে আমার রাস্তার নাম বললাম। তিনি ঝট করে চোখ বোলালেন তার হাতে রাখা কাগজটার ওপর। তারপর সম্মতিসূচক মাথা নেড়ে নাম জিজ্ঞেস করলেন। নাম বললাম। সেটাও হাতের ছাপানো কাগজটাতে লিখে রাখা লিস্টটার সঙ্গে মেলালেন। তারপর ওটাতে ছোট্ট একটা টিক দিয়ে বললেন, তার পরবর্তী যে কলিগ বসে আছেন তার ঠিক পরপরই তার সামনে যেতে। গেলাম। সে ভদ্রমহিলা দুটো ব্যালট পেপার আমার হাতে ধরিয়ে দিলেন। সঙ্গে কোন্ ব্যালটে কয়টা ভোট দিতে হবে সেটাও বলে দিলেন। একটা কাউন্সিলর নির্বাচন করার, অন্যটা মেয়র নির্বাচন করার। তারপর সামনে কোথায় গিয়ে সিল মারতে হবে সে জায়গাটার দিকে অঙ্গুলি নির্দেশ করলেন। তা সিল যে মারব, সিলমোহর কই? এদিক ওদিক খুঁজতে শুরু করার আগেই ভদ্রমহিলা একটা ছোট্ট পেন্সিল হোল্ডার দেখালেন। আমি একটা পেন্সিল তুলে নিলাম। বুঝলাম, এই পেন্সিল দিয়েই ভোট দিতে হবে। যা বাবা! এদের কেউই আমার আইডি কার্ড কিংবা কোন ধরনের পরিচয়পত্র কিছু জানতে কিংবা দেখতে চাইলেন না। আমিই যে সেই ব্যক্তি যার পরিচয় আমি দিচ্ছি, সেটা বোঝার বা জানার বা প্রমাণ করার বিন্দুমাত্র কোন ব্যবস্থা নেই কোথাও। গেলাম, নাম বললাম, নামের জায়গায় টিক চিহ্ন দিয়ে দুটো ব্যালট হাতে ধরিয়ে দিল! দুই রঙের দুটো ব্যালট পেপার। সেগুলো হাতে করে সামনে দু’কদম আগালাম। আরেকটা বড় টেবিল। টেবিলটার ওপরে দুটো বড় কার্ডবোর্ড আড়াআড়ি বসিয়ে চারটা খোপ তৈরি করা হয়েছে। একজন ভোটার থেকে আরেকজন ভোটারের আড়াল বলতে এটুকুনই। বাকি তিন পাশে কিন্তু কোন আড়াল নেই। চাইলে কেউ পাশ থেকে কিংবা পেছন থেকেও একটু মাথা বাড়িয়ে উঁকিঝুঁকি মারলে দিব্যি বুঝতে পারবেন আমি কাকে ভোট দিচ্ছি। যাই হোক, ব্যালট হাতে নিয়ে পড়াশোনা না করে পরীক্ষা দিতে আসা ছাত্রের মতো অনুভূতি হতে লাগল আমার। কোন প্রার্থীকেই তো চিনি না। একটা নামও পরিচিত লাগল না। অবশ্য আমি রাজনীতি সচেতন মানুষ না। কিন্তু তাই বলে এত বড় নির্বাচন হয়ে যাচ্ছে, এলাকায় কারা কাউন্সিলর হবে, কে মেয়র হবে- সেসব তথ্য যারা ভোটে দাঁড়িয়েছেন, তাদেরও কি দায়িত্বের মধ্যে পড়ে না আমাদেরকে জানিয়ে দেবার। এই যে এতদিন গেল ভোটের আগে, কোথাও একদিনের জন্যও জনসমাগম হলো না। কেউ ভোট চাইতে বাসায় এলো না, রাস্তায় কোন লিফলেট ধরিয়ে দিল না, দেয়ালে কোথাও কোন পোস্টার লাগাল না। ধাওয়া পাল্টাধাওয়া জ¦ালানো পোড়ানো দেখা গেল না। রাস্তা বন্ধ করা তো দূরের কথা, রাস্তার পাশের জায়গাগুলোতেও নিদেনপক্ষে ছোটখাটো নির্বাচনী সভা হতে পারত, গাছে গাছে শাখে শাখে ল্যাম্পপোস্টে ব্যানার দেখা যেতে পারত, রাস্তার মোড়ে মোড়ে গেট, আলোকসজ্জা, অমুক ভাইয়ের চরিত্র বিষয়ক সার্টিফিকেট, তমুক ভাইকে ভোট দিলে কি কি পাওয়া যাবে- সেসব তথ্য, সমুক ভাইকে গতবার ভোট দেয়াতে কি কি কাজ হয়নি সেসব উপাত্ত- এগুলো তো থাকা উচিত ছিল। কিন্তু, ছিল না। কিচ্ছু না। দেশজুড়ে নির্বাচন হচ্ছে। তাতে হাজার হাজার প্রার্থী লড়াই করছেন কাউন্সিলর কিংবা মেয়র হওয়ার জন্য। ঐ প্রার্থীদের কূপম-ূকতা কিংবা আলস্যের কারণে আমার মতো ভোটারের ব্যালট পেপার হাতে কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে দাঁড়িয়ে থাকা। এদেশের প্রধান দুটো দলÑ লেবার এবং কনজারভেটিভ। এছাড়া আরও যে কয়টা দল আছে, সেগুলোর নাম কালেভদ্রে কানে আসে বলে মনেও থাকে না। আমি কোন বিশেষ কারণ ছাড়াই লেবারকে সমর্থন করি (সম্ভবত নামটার কারণে)। তাই ব্যালট পেপারে তাকিয়ে যেখানে প্রার্থীর পাশে তার দলীয় লোগো আঁকা, সেখানে লেবার থাকলেই ভোট দিতে মনস্থ করলাম। ভোট দেয়া হয়ে গেলে এদিক ওদিক তাকিয়ে ব্যালটটা কোথায় ফেলব সেটা খুঁজতেই দেখলাম সবার সামনে দুটো বড় বাক্স (খুব সম্ভবত কাঠের তৈরি)। সেটার দুই রকম রঙ। ঠিক যেরকম রঙ ব্যালট পেপার দুটোর। আমি পেপার দুটো এক ভাঁজ করে বাক্সের ভেতরে ঢুকিয়ে দিলাম। সেগুলো ভেতরে অদৃশ্য হয়ে গেল নিমেষে। এবারে নিশ্চয়ই আঙুলে অমোচনীয় কালি লাগাবে। সেজন্য পূর্বের টেবিলটার দিকে এগিয়ে গেলাম। ওমা, কেউ আমার দিকে আর ভ্রƒক্ষেপই করছে না দেখি। তার ওপর কালি লাগানোর কোন সাজসরঞ্জামও চোখে পড়ল না। ইতস্তত দাঁড়িয়ে আছি দেখে সেই পূর্বের ভদ্রমহিলা জিজ্ঞেস করলেন, তোমাকে আর কোন সাহায্য করতে পারি? আমি কালির কথা জিজ্ঞেস করব কি না, সেটা দেয়া ওদের গরজ না আমার গরজ- সেসব যখন বিবেচনা করছি, দেখলাম আরেকজন ভদ্রলোক আমার সামনেই বাক্সে ব্যালট দুটো ঢুকিয়ে দিয়ে সোজা গটগট করে বের হয়ে গেলেন। তার মানে, কালির বিষয়-টিষয় নেই কোথাও। আমি ঝট করে হাতের পেন্সিলটা দেখিয়ে বললাম, এটা কোথায় রাখব? ভদ্রমহিলা হেসে বললেন, ওটা চাইলে বাসায় নিয়ে যেতে পার। আমি দ্বিধা না করে পেন্সিলটা নিয়ে বের হয়ে এলাম। এমন নিরুত্তেজ, নিরামিষ, ম্যাড়ম্যাড়ে নির্বাচনের ভোটে অংশগ্রহণের স্মারকস্বরূপ পেন্সিলটা নিয়ে আসা। কেন্দ্র থেকে বেরুতে বেরুতে ভাবছিলাম, আচ্ছা, আমার ভোট যদি অন্য কেউ দিয়ে যেত আমার নাম আর রাস্তার নাম বলে, কিংবা, আমার প্রতিবেশী খায়রুল ভাই (বাঙালী, আমাদের একই রাস্তায় বাড়ি) তো এ মুহূর্তে দেশে বেড়াতে গেছেন, আমি যদি ওনার নাম আর রাস্তার নাম বলে ভোট দিতে যাই- তবে এরা আটকাবে কী ভাবে? তার উত্তর পেলাম দুইদিন পরে। সমগ্র ইংল্যান্ডে যে নির্বাচনটা হয়ে গেল, তার ফল বের হয়েছে। কোথাও কোন একটি কেন্দ্রেও, কোন একটি জায়গাতেও, কেউ কোন রকম ভোট জালিয়াতি, কারচুপি, জালভোট প্রদান গ্রহণ, ধাক্কাধাক্কি, গোলাগুলি, মারপিট, আহত-নিহত হওয়া, অগ্নিসংযোগ, ধাওয়া পাল্টাধাওয়া, পারস্পরিক দোষারূপ করা, ফল না মানা, ফল প্রত্যাখ্যানসহ পুনঃ ভোটগণনা মোট কথা, সারাজীবন যে নির্বাচনী কালচার দেখে দেখে বড় হয়েছি- এমন কোন সংবাদ অনেক পত্রিকা তন্ন তন্ন করে খুঁজেও দেখতে পাইনি। এসব এরা নিশ্চয় কোন না কোনভাবে আটকায়- সেটা সুনিশ্চিত। কীভাবে? খোদা মালুম। লেখক : কথাসাহিত্যিক [email protected]
×