ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

ড. মাহবুব মোমতাজ

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অনভিপ্রেত আলোচনা

প্রকাশিত: ২১:৪২, ১৪ মে ২০২২

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অনভিপ্রেত আলোচনা

গত ১৭ এপ্রিল মুজিবনগর দিবস উপলক্ষে আলোচনাসভায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক সমিতির সভাপতি অধ্যাপক রহমতউল্লাহ মুজিব নগর সরকারের মন্ত্রীদের শ্রদ্ধা জানাতে গিয়ে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের খুনী চক্রের অন্যতম হোতা খন্দকার মোশতাককে শ্রদ্ধা নিবেদন করেছেন। সভায় সভাপতিত্ব করেছেন উপাচার্য প্রফেসর আখতারুজ্জামান। প্রোভিসি অধ্যাপক মুহাম্মদ সামাদ সমিতির সভাপতি অধ্যাপক রহমত উল্লাহ সাহেবের বক্তব্যের তীব্র প্রতিবাদ করেন এবং বক্তব্যটি প্রত্যাহার করার জন্য সভার সভাপতি উপাচার্যকে অনুরোধ করেন। মুহাম্মদ সামাদ তাঁর বক্তব্যে বলেন, ‘মুক্তিযুদ্ধের পুরোটা সময় মোশতাক মুক্তিযুদ্ধের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রে লিপ্ত ছিল। পাকিস্তানের সঙ্গে কনফেডারেশন করার প্রস্তাবেও যুক্ত ছিল। কাজেই শিক্ষক সমিতির সভাপতি যে বক্তব্য দিয়েছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন তা গ্রহণ করতে পারে না’ (দৈনিক প্রথম আলো)। সভায় উপস্থিত সকলেই বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন এবং নিন্দাও জানিয়েছেন। উপাচার্য মহোদয় তার বক্তব্যে অধ্যাপক রহমত উল্লাহর বক্তব্য প্রত্যাহার করেন। অধ্যাপক রহমত উল্লাহ পরের দিন অর্থাৎ ১৮ এপ্রিল প্রেস কনফারেন্স করে মুখ ফসকে হয়তো মোশতাকের নাম বলে ফেলেছি বলে উল্লেখ করেছেন, নিজের ভুল স্বীকার করে জাতির কাছে ক্ষমা চেয়েছেন। অধ্যাপক রহমত উল্লাহ বলেন, ‘মুজিব নগর সরকার সম্পর্কে বলতে গিয়ে যদি স্লিপ অব টাং হয়ে মোশতাকের নাম বলে থাকি তাহলে আমি দুঃখিত (দৈনিক যুগান্তর)।’ এর আগেই অবশ্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগ নেতৃবৃন্দ উপাচার্যের কাছে শিক্ষক সমিতির সভাপতির দায়িত্বজ্ঞানহীন বক্তব্যের জন্য জাতির কাছে ক্ষমা চাইতে হবে বলে বিচার দাবি করে স্মারকলিপি দেন। উপাচার্য আখতারুজ্জামান ছাত্রলীগের বক্তব্যের সঙ্গে একমত পোষণ করেন। ১৮ এপ্রিল দৈনিক যুগান্তর পত্রিকাসহ দেশের প্রধান পত্রিকাগুলো ‘মোশতাকের প্রতি ঢাবি শিক্ষক সমিতির সভাপতির শ্রদ্ধা নিবেদন নিয়ে তোলপাড়’ শীর্ষক শিরোনামে সংবাদ প্রকাশিত হয়েছে। বঙ্গবন্ধুর খুনী চক্রের সঙ্গে আঁতাতকারী মোশতাকের প্রতি শ্রদ্ধাজ্ঞাপন বিষয়টি কেউ মেনে নিতে পারেনি। ফলে শিক্ষক নেতা, সুশীল সমাজ ও বিভিন্ন সামাজিক সাংস্কৃতিক ও ছাত্র সংগঠনের পক্ষ থেকে নিন্দা জ্ঞাপন অব্যাহত থাকে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতিও তাৎক্ষণিক সভা ডেকে অধ্যাপক রহমত উল্লাহর বক্তব্যের নিন্দা জানান। ২০ এপ্রিল বুধবার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বোচ্চ নীতিনির্ধারণী ফোরাম সিন্ডিকেটের জরুরী সভায় অধ্যাপক রহমত উল্লাহকে একাডেমিক ও প্রশাসনিক কার্যক্রম থেকে অব্যাহতি দেয়া হয় এবং ঘটনা তদন্তে বিশ^বিদ্যালয়ের সহউপাচার্য (শিক্ষা) এএসএম মাকসুদ কামালকে প্রধান করে পাঁচ সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয় (দৈনিক প্রথম আলো)। ১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় কলকাতায় মোশতাকের নেতৃত্বে মাহবুবুল আলম চাষী, তাহেরউদ্দিন ঠাকুর, শাহ মোয়াজ্জেম হোসেন, জহিরুল কাইউমসহ কতিপয় নেতা বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধকে ব্যাহত ও নস্যাৎ করার জন্য পাকিস্তানের মিত্র যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে যোগাযোগ অব্যাহত রেখে কনফেডারেশন করতে চেয়েছিল। ১৯৫৫ সালে বঙ্গবন্ধু যখন আওয়ামী মুসলিম লীগকে অসাম্প্রদায়িক রাজনৈতিক দল হিসেবে গড়ে তুলতে ‘মুসলিম’ শব্দ বাদ দিয়ে ‘পূর্ব পাকিন্তান আওয়ামী লীগ’ গঠন করার উদ্যোগ নিয়েছিলেন খন্দকার মোশতাক তখন বঙ্গবন্ধুর মতামতের বিরোধিতা করে দল থেকে সরে গিয়েছিল। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট ধানমন্ডির ৩২ নম্বরে বঙ্গবন্ধুর লাশ যখন খুনীচক্রের বুলেটে ছিন্নভিন্ন হয়ে সিঁড়িতে পড়ে ছিল মোশতাক তখন শেরওয়ানি পরে আগামসিহ লেনের বাড়িতে আতর সুরমা মেখে অপেক্ষা করছিল কখন বঙ্গভবন থেকে তার জন্য গাড়ি আসবে। খুনী ফারুক-রশীদ-ডালিম গংয়ের সঙ্গে হাত মিলিয়ে মোশতাক নিজেকে রাষ্ট্রপতি হিসেবে ঘোষণা দিয়েছিল। পাকিন্তানের প্রেসিডেন্ট জুলফিকার আলী ভুট্টো মোশতাককে বাংলাদেশের প্রেসিডেন্ট হিসেবে স্বীকৃতি দিয়ে সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিয়েছিল। মোশতাক ছিল পাকিন্তানের দালাল। ১৯৭৫ সালের ২৩ আগস্ট মোশতাকের নির্দেশে বঙ্গবন্ধুর ঘনিষ্ঠ সহচর জাতীয় চার নেতা সৈয়দ নজরুল ইসলাম, ক্যাপ্টেন (অব) এম মনসুর আলী, তাজউদ্দীন আহমদ, এ এইচ এম কামারুজ্জামান এবং আব্দুস সামাদ আজাদ, শেখ আবদুল আজিজ, এম কোরবান আলী, আব্দুল কুদ্দুস মাখন, গাজী গোলাম মোন্তফাসহ ২৬জন আওয়ামী লীগ নেতাকে গ্রেফতার করে জেলখানায় বন্দী করে রেখেছিল। ২৪ আগস্ট মেজর জেনারেল শফিউল্লাহকে সেনাবাহিনীর চীফ অব স্টাফের পদ থেকে অপসারণ করে জেনারেল জিয়াকে সেনাবাহিনীর প্রধান করেছিল মোশতাক। বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচার চিরতরে বন্ধ করতে এবং খুনীদের রক্ষা করতে মোশতাক ২৬ সেপ্টেম্বর ১৯৭৫ কুখ্যাত ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ জারি করে। মোশতাকের নির্দেশেই ১৯৭৫ সালের ৩ নবেম্বর জেলখানার অভ্যন্তরে জাতীয় চার নেতাকে নিষ্ঠুরভাবে হত্যা করা হয়েছিল। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো একটি প্রতিষ্ঠানে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের হত্যাকারী চক্রের অন্যতম হোতা মোশতাকের নাম যদি শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করা হয় আর তার প্রতিবাদ করার কারণে প্রোভিসি (প্রশাসন) অধ্যাপক মুহাম্মদ সামাদকে উকিল নোটিস পেতে হয় তাহলে জাতির জন্য এর চেয়ে লজ্জার আর কি হতে পারে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের সর্বোচ্চ ব্যক্তিবর্গ, শিক্ষক সমিতির নেতৃবৃন্দ, সম্মানিত অধ্যাপকসহ শিক্ষকদের সামনে উচ্চারিত মোশতাকের প্রতি সম্মান জানানো এবং সাংবাদিক সম্মেলন করে নিজের দোষ স্বীকার (স্লিপ অব টাং) করার পরেও (বিডি নিউজ ২৪ ডটকম) অধ্যাপক রহমত উল্লাহ বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন সম্মানিত প্রোভিসির বিরুদ্ধে উকিল নোটিস পাঠিয়েছেন (দৈনিক প্রথম আলো)। বিষয়টি অত্যন্ত পীড়াদায়ক। অধ্যাপক রহমত উল্লাহ আপনি নিজেই যেখানে স্বীকার করেছেন স্লিপ অব টাং এ মোশতাকের নাম বলে ফেলেছেন তাহলে মুহাম্মদ সামাদ প্রতিবাদ করায় তার কি অপরাধ ছিল? ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো একটি প্রতিষ্ঠানে এমন বিতর্কিত বিষয় নিয়ে আইন আদালত হলে নিজেদের সুনাম ক্ষুণ্ণ হবে। জাতির আশা প্রত্যাশার জায়গা বিশ্ববিদ্যালয়ের সম্মান বিনষ্ট হবে। দুর্ভাগ্য বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের। যখনই এই দলটি জনগণের কল্যাণে কাজ করে তখনই চারদিক থেকে ষড়যন্ত্র শুরু হয়। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব যুদ্ধবিধ্বস্ত একটি দেশকে যখন মাথা তুলে আত্মনির্ভরশীল জাতিতে পরিণত করতে রাতদিন কাজ করছিলেন তখনই ঘাতকের দল বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করে বাঙালীকে আবার পরনির্ভরশীল জাতিতে পরিণত করতে উদ্যত হয়েছে। জননেত্রী শেখ হাসিনা নিজের জীবন বাজি রেখে দেশের উন্নয়নে যখন বিশ্বে একটি মডেল হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে। ২০৪১ সালে একটি উন্নত সমৃদ্ধ জাতি হিসেবে মাথা তুলে দাঁড়াবার জন্য বাঙালী জাতিকে তৈরি করছে তখন আমরা জাতির পিতার খুনীদের সম্মান শ্রদ্ধা আলোচনায় মুখর হয়ে পড়ছি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে এমন ঘটনা জাতি প্রত্যাশা করে না। আমাদের ভাবতে হবে, সতর্ক হতে হবে এখনই, সকল ষড়যন্ত্র মোকাবেলা করে নিতে হবে সাহসী পদক্ষেপ। জননেত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আগামীর বাংলাদেশ হোক সকলের জন্য নিরাপদ ও ষড়যন্ত্রমুক্ত। লেখক : তথ্য ও গবেষণা সম্পাদক বঙ্গবন্ধু ফাউন্ডেশন
×