ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

অমূল্য কুমার বৈদ্য

ভরসাস্থল যখন বৃদ্ধাশ্রম

প্রকাশিত: ২১:০১, ১৩ মে ২০২২

ভরসাস্থল যখন বৃদ্ধাশ্রম

এ কোন সমাজ, সভ্যতা-সংস্কৃতির মধ্য দিয়ে আমাদের জীবন প্রবহমান, যেখানে প্রিয়তম সন্তান কোন এক সময়ে তার বৃদ্ধ মা-বাবাকে বৃদ্ধাশ্রমে একরকম নির্বাসনে পাঠিয়ে দিয়ে নিজেরা স্বস্তি লাভ করছে বলে মনে করছে। মনুষ্যত্ববোধহীন, নীতিহীন, স্বার্থান্ধ এক শ্রেণীর মানুষ কেবল আত্মসুখের কারণে এহেন নিষ্ঠুর দায়দায়িত্বহীন আচরণ করে থাকে অত্যন্ত প্রিয়জনদের সঙ্গে। এ ধরনের কাজে সমাজও সার্বিকভাবে কলুষিত হয়। ধনবাদী সমাজ ব্যবস্থার এক নিদারুণ ব্যাধি, যার থেকে মুক্তির যেন আর কোন উপায় মানুষ ইচ্ছাকৃতভাবেই খুঁজে নেয় না বা নিতে চায় না। বস্তু তথা ধন-সম্পত্তিই যেন তাদের একমাত্র চাওয়া-পাওয়া। বিশেষত, তৃতীয় বিশ্বের দরিদ্র দেশগুলোর কোন কোনটিতে অত্যন্ত হৃদয়স্পর্শী বেদনাবিধুর এ ব্যবস্থা চালু রয়েছে দীর্ঘ সময় ধরে। ভারতীয় উপমহাদেশে এটি বহুকাল ধরে প্রতিষ্ঠিত। অনেকক্ষেত্রে পিতা-মাতাও নিজ সন্তানদেরও এরূপ পরিস্থিতির মধ্যে ঠেলে দেয়। এর ফলে সন্তানদের জীবন তলিয়ে যায় গভীর অন্ধকারে। মানবিক মূল্যবোধের অবক্ষয়ী এক সংস্কৃতির কারণেই সমাজের একদল মানুষ নির্দ্বিধায় অমানুষী এ কর্মটি করে যাচ্ছে। কোন অপরাধ বোধই যেন তাদের হৃদয়ে, চিন্তায়-চেতনায় একটি বারের জন্যও জাগরিত হয় না। কেবল স্বার্থান্ধতার শৃঙ্খলে আটকে গেছে তাদের মানস কাঠামো। একটি বিষয় অত্যন্ত প্রণিধানযোগ্য। প্রধানত সমাজের তথাকথিত ডিগ্রীধারী শিক্ষিত মানুষের ক্ষেত্রেই দানবিক এ কর্মটি পরিলক্ষিত হয়ে থাকে বেশি। তাহলে কি শিক্ষা পদ্ধতির মধ্যেই কোন না কোন জায়গায় গলদ নিহিত রয়েছে? ন্যায়-অন্যায়ের বিশুদ্ধ আদর্শ আমাদের শিক্ষায় অনুপস্থিত কিনা, সেটিও ভাবনার বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। অতীব গুরুত্ব দিয়ে বিষয়টি নিয়ে সমাজের সর্বস্তরের মানুষকে ভেবে দেখতে হবে। সংবিধান পাঠ্যপুস্তকে বয়স্ক পিতা-মাতার অধিকারের বিষয়টিও অন্তর্ভুক্ত করা প্রয়োজন। বিশেষত সমাজ এবং রাষ্ট্রের নীতিনির্ধারণী শক্তিকে এ সমস্যা সমাধানের অগ্রণী ভূমিকা পালনের মধ্য দিয়ে এটিকে একটি সুষ্ঠু সমাধানের পর্যায়ে নিয়ে আসতে হবে। মানবিক সমাজ গঠনে শিক্ষা-কাঠামোতে তাৎপর্যপূর্ণভাবে ও সদর্থকভাবে সংশোধনের আবশ্যকতা থেকে থাকলে সেটিকেও ভাবনার মধ্যে আনাতে হবে। এ জীবন প্রবাহে যে সমস্ত ভাগ্যহীন মা-বাবাকে এ রকম পরিস্থিতির মধ্যে পড়তে হয়, কেবল তারাই মর্মে মর্মে অনুধাবন করে থাকেন তাদের গভীর মনোবেদনা। জীবনের শেষদিন পর্যন্ত এ জীবন বহন করে যেতে হবে। মুক্তি যেন কোনদিন আর আসবে না। দিন যায় রাত আসে, কিন্তু কোন আশাই যেন আর ফিরে আসে না। মুক্তি তাদের জীবনে মাত্র একবারই আসে, আর সেটি হলো জীবনাবসান। সমাজের প্রতিটি মানুষ তার বিবেক, বিচারবোধ এবং মানবত্ব দিয়ে এসব মানুষের এ অব্যক্ত বেদনার অবসান ঘটাতে এগিয়ে এলে তবেই এ সমস্যার সমাধান হতে পারে। এ জগতকে, এ সমাজকে সুন্দরভাবে সুষ্ঠুভাবে নির্মাণ করার দায়িত্ব আমাদের সকলের। সমাজ শৃঙ্খলা যাতে নষ্ট না হয়, সেটিকে নিশ্চিত করার অঙ্গীকার কেবল মানুষকেই নিতে হবে। তবেই তো এ পৃথিবী বাসযোগ্য হবে সবার জন্য। সংবেদনশীল মানুষ আমাদের হতেই হবে। এর কোন ব্যত্যয় হওয়া কোনল্ডমেই যেন গ্রহণযোগ্য হবে না। মানুষকে মানুষ হওয়ার মধ্য দিয়ে এ নির্মমতার পরিসমাপ্তি ঘটবে বলে আমরা অত্যন্ত আশাবাদী। একটি শিশুর জন্মের শুরুতেই যে বিষয়টি সবচেয়ে গুরুত্ব বহন করে সেটি হলো- যথার্থ মানবিক মানুষ হিসেবে তাকে গড়ে তোলা। একটি পরিবারের এটি প্রাথমিক দায়িত্ব এবং কর্তব্য। পরিবার থেকেই তার মানস কাঠামো সুন্দরভাবে তৈরিতে হাত দিতে হবে পরিবারের সকল সদস্যকে। অত্যন্ত সচেতনভাবে সুদূরপ্রসারী ভাবনা থেকে এ কাজটি করার মধ্য দিয়ে আমরা একটি কাক্সিক্ষত সমাজ নির্মাণ করতে পারব। কেবল বিদ্যালয় পাঠ্যগ্রন্থের শিক্ষায় শিক্ষিত কোন শিশু যে সত্যিকারভাবে একজন ভাল মনের মানুষ হিসেবে বেড়ে ওঠে না, এটি প্রমাণিত। উদার ও মহৎ মন-প্রাণ সৃষ্টিতে মানবিক মানুষ তৈরিতে সমাজের পরিবার ও শিক্ষালয়গুলো কতটা ইতিবাচক এবং সহায়ক ভূমিকা রাখছে? ঙঁঃ ইড়ড়শং পড়ার সুযোগও শিক্ষার্থীদের করে দিতে হবে। শিল্প, সাহিত্য এবং সংস্কৃতি চর্চার বিষয়টি অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। কেবল ডিগ্রী সর্বোচ্চ উচ্চ শিক্ষার মাধ্যমে সমাজদেহের নানা বিচিত্রমুখী অনাচার-অসঙ্গতি দূরীভূত হবে না। বিদ্যমান সিলেবাস এবং কারিকুলাম এমনভাবে বিন্যস্ত করা যাতে সত্য, ন্যায়বোধ, নীতিবোধ এবং চৈতন্যের জাগরণ ঘটে। সেদিকে রাষ্ট্রযন্ত্রকে কার্যকরভাবে হাত দিতে হবে। প্রশাসনিক ব্যবস্থা গ্রহণের মধ্য দিয়ে হয়তবা বিভিন্ন চরিত্রের এ দুষ্ট ক্ষতের কিছুটা উপশম হয়, কিন্তু মূলোৎপাটিত হয় না। রোগের শিকড়ে আঘাত করেই চিরস্থায়ী একটি সমাধানের পথে এগিয়ে আসতে হবে। আমাদের মা কৈশোর জীবনে অত্যন্ত নিষ্ঠুর-মর্মান্তিক একটি গল্প শুনিয়েছিলেন। প্রাসঙ্গিক এ গল্পটি অদ্যাবধি ভুলে যাইনি। গল্পটি এ রকম- কোন এক মায়ের পুত্র সন্তান তার মাকে বাড়ি থেকে বিতাড়িত করার অভিপ্রায়ে দূরে কোথাও এক গহীন জঙ্গলে রেখে আসার জন্য নিয়ে যায়। জঙ্গলে রেখে আসার ওই মুহূর্তে পরিত্যক্ত অসহায় মা আকাশে ঘনকালো মেঘের ঘনঘটা এবং ঝড়ের পূর্বাভাস দেখতে পেয়ে দুর্ভাগা মা সন্তানের জীবননাশের ভয়ে অত্যন্ত বিচলিত হয়ে পড়েন। নিজের জীবন রক্ষার কোন রকম চিন্তা ভাবনা না করেই আদরের সন্তানের জীবন যাতে বিপন্ন না হয়, সেই অভিপ্রায়ে দ্রুত ওই স্থান ত্যাগ করার জন্য বলেন তাকে। এই তো মা, যে মায়ের একমাত্র আবেগ-অনুভূতি, ভাবনা কেবলই সন্তানের মঙ্গল কামনা। ওই মা তার জীবন রক্ষার বিষয়টি একটিবারের জন্যও ভাবেননি, ভেবেছেন তার সন্তানের জীবন বিপন্নের কথাটি। সমাজের আরও এক অন্ধকার দিক হলো- পরিবারের শিশু, নারী সদস্য এবং বয়স্ক মা-বাবার ওপর মানসিক ও শারীরিক সহিংসতার নিত্যনৈমিত্তিক ঘটনা। এটি সমাজ অভ্যন্তরের এক নির্মমতা ও নিষ্ঠুরতার প্রতিচ্ছবি। আর এ বিষয়টির ওপর প্রতিনিয়ত কোন না কোন গণমাধ্যম সচিত্র প্রতিবেদন প্রকাশ করে থাকে। বিষয়টি দুর্বলের প্রতি সবলের অত্যাচারেরই নামান্তর। এটি সামাজিক শৃঙ্খলা ভঙ্গের জন্যও অনেকাংশে দায়ী। এ সহিংসতা নিরোধকল্পে তো দেশে ২০১০-এ পারিবারিক সহিংসতা প্রতিরোধ সুরক্ষা আইন প্রণীত হয়েছে। এই আইনে মা-বাবার ভরণ-পোষণের অধিকার এবং শারীরিক, মানসিক ও অর্থনৈতিক নির্যাতনের বিষয়টি রয়েছে। আশার কথা এই যে, ২০১৩ সালে পিতা-মাতার ভরণপোষণের বিষয়ে পৃথক একটি আইন করা হয়েছে। যদিও এটি একটি প্রতিরোধমূলক আইন এবং এ আইন অমান্যে শাস্তির ব্যবস্থাও বিদ্যমান। অন্যায়কারী বা নির্যাতনকারীকে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির আওতায় আনার মধ্য দিয়ে অপরাধের নিরসন অনেকটা সম্ভব হতে পারে। লেখক : সমাজকর্মী
×