ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১

মনিরুল ইসলাম রফিক

প্রসঙ্গ ইসলাম ॥ প্রকৃত আভিজাত্য

প্রকাশিত: ২০:৫৭, ১৩ মে ২০২২

প্রসঙ্গ ইসলাম ॥ প্রকৃত আভিজাত্য

আভিজাত্যের সংজ্ঞা কি? কারা প্রকৃত মান-সম্মানসম্পন্ন মানুষ? এ ব্যাপারে যুগে যুগে চিন্তাশীল ও দার্শনিকদের কাছে বিভিন্ন সংজ্ঞা পাওয়া যায়। পবিত্র ইসলাম ধর্ম এ বিষয়ে সুস্পষ্ট আদর্শিক মাপকাঠি দাঁড় করিয়েছে। ‘ইন্না আকরামাকুম ইন্দাল্লাহি আতক্বাকুম’-অর্থাৎ ‘নিঃসন্দেহে আল্লাহর দরবারে তোমাদের মাঝে ওই ব্যক্তিই অধিক সম্মানিত, যিনি সবচেয়ে খোদাভীরু।’ মহানবী হযরত মুহাম্মদ (সা.) এর যুগে যখন অবহেলিত মজলুম মানুষগুলো ইসলামের ছায়াতলে আশ্রয় নিয়ে ধন্য হন, তখন মক্কার তথাকথিত অভিজাত শ্রেণী সর্দারবর্গ অভিমত ব্যক্ত করল- মুহাম্মদের (সা.) পাশে নীচ-হীন অভাবি মানুষগুলো না থাকলে আমরা তার কথা শুনার জন্য আগ্রহ প্রকাশ করতাম। পবিত্র কুরআনুল কারিমে সে ঘটনাটি ইঙ্গিত করে মক্কার সর্দারগণের অভিপ্রায় নাকচ করে দেয়া হয় এবং প্রকৃত মান-অপমান আর ধনী-দরিদ্রের মাপকাঠি ঘোষণা করে। এ সঙ্গে আর্থিক দিক দিয়ে গরিব অথচ সৎচরিত্র সম্পন্ন মুসলমানদের উদ্দেশে এমন সান্ত¡নাবাণী এসেছে প্রলয়কাল পর্যন্ত যা অম্লান অক্ষয় হয়ে থাকবে এবং সৎ সরল মানুষদের অনুপ্রেরণা জোগাবে। (দ্র : সূরা আনআম-৫৪)। আসলে মান-সম্মান কিভাবে নিরূপণ করব? যারা মানুষ হওয়া সত্ত্বেও মনুষ্যত্ব কাকে বলে জানে না, বরং মানুষকে জগতে অন্যান্য জন্তু-জানোয়ারের মতো একটি জানোয়ার হিসেবে ধরে নিয়ে শুধু প্রাচুর্য না থাকার কারণে দাস-দাসী বানিয়ে পশুদের মতো ব্যবহার করে, তাদের কাছে আভিজাত্যের মাপকাঠি হলো ভোগবিলাসের সামগ্রীর আধিক্য। যার কাছে এসব বস্তু স্বল্প মাত্রায় আছে সে লাঞ্ছিত ও অকৃতকর্মা। এ মতবাদ অনুযায়ী সম্ভ্রান্ত হওয়ার জন্য সচ্চরিত্র ও সৎকর্মের কোন প্রয়োজন নেই, বরং যে কর্ম এবং চরিত্র পার্থিক জৈবিক লক্ষ্য অর্জনের সহায়ক, তাই সচ্চরিত্র। পক্ষান্তরে মহান নবী-রাসূলগণের শিক্ষা হলো, এ জীবন স্থায়ী নয়। এটি পরীক্ষাগার মাত্র। এরপরে আসছে এক অনন্ত জীবন-যে কালের সুখ-শান্তি যেমন পূর্ণ ও চিরস্থায়ী, তেমনি কষ্ট, শাস্তিও চিরস্থায়ী। সে পরজীবনের উপকারী বিষয়সমূহ সংগ্রহে ব্যস্ত থাকাই এ ক্ষণস্থায়ী জীবনের আসল লক্ষ্য। মানুষ ও জন্তু জানোয়ারের মধ্যে পার্থক্য এই যে, জন্তু-জানোয়ারকে পরজীবনের চিন্তা করতে হয় না। কিন্তু জ্ঞানী ও সচেতন ব্যক্তিদের মতে, পরজীবনের সুখ-স্বাচ্ছন্দ্যই মানুষের সর্ববৃহৎ চিন্তা। এ বিশ্বাস ও মতবাদ অনুযায়ী ভদ্রতা ও নীচতা এবং সম্মান-অপমানের মাপকাঠি অধিক পানাহার কিংবা ধন-সম্পদ আহরণ হবে না। বরং সচ্চরিত্র ও সৎকর্মই হবে আভিজাত্যের মাপকাঠি। যুগে যুগে পার্থিব জীবনের গোলক ধাঁধায় আবদ্ধ মানুষ বিত্তবানদের সম্ভ্রান্ত এবং ভদ্র ও দীন দরিদ্র বিত্তহীনদের সম্মান হীন ও নীচ বলে ধারণা করেছে। এ মাপকাঠির ভিত্তিতে হযরত নূহ (আ.)- এর জাতি বিশ্বাস স্থাপনকারী ঈমানদার দরিদ্রদেরকে নীচ বলে আখ্যা দিয়ে বলেছিল- আমরা এ নীচদের সঙ্গে একত্রে বসতে পারি না। আপনি যদি আমাদেরকে কোন পয়গাম শুনাতে চান, তবে দরিদ্র ও নিঃস্বদেরকে আগে দরবার থেকে বহিষ্কার করুন। মহানবী (সা.) এর আমলে এ প্রশ্ন আবার দেখা দেয়। কুরআনের পূর্বোল্লেখিত আয়াতে এরই উত্তর বিশেষ নির্দেশসহ বর্ণিত হয়েছে। ওতবা, শায়বা, ইবনে রাবীয়া মুতএম ইবনে আদী, হারেছ ইবনে নওফেল কতিপয় কুরাইশ সর্দার মহানবীর (সা.) চাচা আবু তালিবের নিকট এসে বলল- আপনার ভাইপো মুহাম্মদের (সা.) কথা মেনে নিতে আমাদের সামনে একটি বাধা। তা এই যে, তার চারপাশে সর্বদা এমন সব লোকের ভিড় লেগে থাকে, যারা হয় আমাদের ক্রীতদাস ছিল, এরপর আমরা মুক্ত করে দিয়েছি; না হয় আমাদেরই দান দক্ষিণায় যারা লালিত পালিত হতো। এমন নিকৃষ্ট লোকদের উপস্থিতিতে আমরা তার মজলিসে যোগদান করতে পারি না। আপনি তাকে বলে দিন, যদি সে আমাদের আসার সময় তাদের মজলিস থেকে সরিয়ে দেয়, তবে আমরা তার কথা বিবেচনায় সম্মত রয়েছি। আবু তালিব মহানবীকে (সা.) তাদের বক্তব্য জানিয়ে দিলে হযরত উমর (রাদি.) মতপ্রকাশ করে বললেন- এতে অসুবিধা কি? আপনি কিছুদিন তাই করে দেখুন। এরা তো অকপট বন্ধুবর্গই। কোরাইশ সর্দারদের আগমনের সময় এরা না হয় সরেই যাবে। এরই পরিপ্রেক্ষিতে উপরোক্ত আয়াত অবতীর্ণ হয়। এতে উল্লেখিত পরিকল্পনা বাস্তবায়িত করতে কঠোর ভাষায় নিষেধ করা হয়েছে-(তাফসিরে ইবনে কাসির)। এখান থেকে আমরা এ শিক্ষা নিতে পারি যে, কারও ছিন্ন বস্ত্র কিংবা বাহ্যিক দুরবস্থা দেখে তাকে নিকৃষ্ট ও হীন মনে করার অধিকার কারও নেই। এ ধরনের পোশাকে এমন লোকও থাকেন যারা আল্লাহর কাছে অত্যন্ত সম্মানিত ও প্রিয়। কবির ভাষায়- দারিদ্র্য,তুমি মোরে করেছো মহান; তুমি মোরে দানিয়েছ খ্রীস্টের সম্মান। মানুষ ধনের বড়াই করে, জনের বড়াই করে, জ্ঞানের বড়াই করে। কিন্তু দারিদ্র্যের বড়াই করে না। কারণ, দারিদ্র্য দেখাবার মতো, বড়াই করার মতো কিছু নয়। কিন্তু এরপরও দারিদ্র্যের বড়াই কদাচিৎ হলেও দেখা যায়। দীনহীনতা নিয়ে অনেকের আত্মতুষ্টি লক্ষ্য করা যায়। মহত্ত্বর দরবারে, সেরা মানুষের জীবনে এটি ভূরি ভূরি চোখে পড়ে। যারা লোভ-লালসার উর্ধে উঠতে পেরেছে, জীবনকে অন্যের জন্য বিলিয়ে দিতে শিখেছে, দুনিয়ার জীবনের বদলায় অনন্ত আখিরাত জীবনের স্বপ্ন দেখে, তাদেরকেই এ দারিদ্র্যের বড়াইয়ে চমৎকার মানিয়েছে। ওপরের কবিতার দুটি লাইন বিদ্রোহী কবি নজরুল ইসলামের। দরিদ্র পরিবারের সন্তান হওয়াকে তিনি নিজের বিখ্যাত হওয়ার কারণ হিসেবে দারিদ্র্যকে গণ্য করেছেন। মহানবী হযরত মুহাম্মদ মুস্তাফা (সা.) বলতেন- হে আল্লাহ আমাকে মিসকিন করে রেখো এবং মিসকিন (নিঃস্বদের) সঙ্গে হাশরের দিন সমবেত করো। আঁ-হযরতের (সা.) শিক্ষা, ধনপ্রতিপত্তির উর্ধে উঠে লোভ-লালসার আর আমিত্বের ধ্বংস সাধন করে ত্যাগ ও আত্মলীনের মধ্য দিয়ে মানুষকে, মুমিনকে কামালিয়াতের (পূর্ণতার) প্রমাণ রাখতে হবে। কিন্তু এ দরজায় বা এ মর্তবায় পৌঁছানো অনেকের পক্ষে সম্ভব হয় না। সুফী সাধক আউলিয়া কেরামই এ পথে সাফল্য অর্জন করেন। কারণ, তারা নবীজীর (সা.) নূরের আলোকধারায় সন্তরণ করেন। তাদের কাছে ধন-সম্পত্তি, তখতে শাহী সবই তুচ্ছ। গুরুত্বের হচ্ছে শুধু আল্লাহর ইবাদত ও রিয়াজতের আঙ্গিনা প্রশস্ত করা। এ জন্যই হয়ত নিজাম উদ্দীন আউলিয়াকে (রহ.) সুলতান আলাউদ্দীন হাজারো অনুরোধ উপরোধ করেও সর্বশেষ পর্যায়ে নির্যাতনের ভয় দেখিয়েও আপন দরবারে নিতে পারেননি। আমরা কি পারি না এমন নিরহঙ্কার দরিদ্রের আবরণে থাকতে? পারি না দরিদ্র সমাজের সঙ্গে সুখে-দুঃখে একাত্ম হয়ে চলতে? লেখক : অধ্যাপক, টিভি উপস্থাপক ও জাতীয় পুরস্কারপ্রাপ্ত খতিব [email protected]
×