ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ১৬ এপ্রিল ২০২৪, ৩ বৈশাখ ১৪৩১

রণেশ মৈত্র

বিপন্ন নদী ইছামতিকে বাঁচাতে হবে

প্রকাশিত: ২০:৫৪, ১১ মে ২০২২

বিপন্ন নদী ইছামতিকে বাঁচাতে হবে

পাবনার ইছামতি অঢেল সম্পদের, সীমাহীন ঐতিহ্যের এবং বিশাল গৌরবের ঐতিহ্য। নদীটির উৎপত্তির ইতিহাস সঠিকভাবে জানা না গেলেও যতটুকু জানতে পেরেছি- নদীটি প্রকৃতিগতভাবে উৎপন্ন হয়নি। মুঘল সম্রাট জাহাঙ্গীরের আমলে বাংলার তৎকালীন রাজধানী জাহাঙ্গীরনগরের যাতায়াতের সুবিধার কথা চিন্তা করে বাংলার শাসনকর্তা ঈশা খাঁর নির্দেশে তদানীন্তন প্রাদেশিক শাসন কর্মকর্তা ইছামতি নদীটি খনন করেন। স্মৃতি রক্ষার্থে তারই নামানুসারে এ নদীর নামকরণ করা হয় ইছামতি (সূত্র বিবৃতি, ২৯ এপ্রিল, ২০১৯) সাংবাদিক আবদুল হামিদের নিবন্ধ)। যদিও কোন ইতিহাস গ্রন্থ বা গুগল্স সার্চ করে এর প্রমাণ পেলাম না। তবে ইছামতি যে পদ্মার শাখা নদী তা নিয়ে বিতর্ক নেই। বিগত শতাব্দীর প্রথমদিকে পাবনার শিতলাই জমিদারের লালরঙা বহু কক্ষবিশিষ্ট বাড়ি, যেটা শীতলাই জমিদারের বাড়ি বললে সবাই এক ডাকে চিনত (বর্তমানে এডরুক ল্যাবরেটরির কারখানা ও প্রধান কার্যালয়), পদ্মার তীব্র ভাঙ্গনে ওই বিশাল ভবন (এবং কয়েক একর জমিতে নানাবিধ ফুল বাগান, বুদ্ধদেবের শ্বেত পাথরের বিশাল মূর্তি ও সৌন্দর্যবর্ধক বৃক্ষরাজি শোভিত বাগান) নদীতে চলে যাওয়ার আশঙ্কার কথা তৎকালীন প্রকৌশলীগণ জানালে জমিদার পরিবার কয়েক লাখ টাকা খরচ করে শক্ত গাঁথুনি দিয়ে পদ্মার সঙ্গে ইছামতির সংযোগ স্থল বন্ধ করে দেন। তারপর পদ্মা-ইছামতি সংযোগ আজ পর্যন্ত স্থাপিত হয়নি। ফলে বর্ষাকালেও যখন পদ্মা ফুলেফেঁপে ওঠে, তখনও আজকের ইছামতি পদ্মার এক চামচ জলও পায় না। এই সংযোগ মুখটি পাবনা পৌর এলাকারপূর্ব দক্ষিণে অবস্থিত। তখন পদ্মার ভাঙ্গন এতই তীব্র হয়েছিল যে, পাবনা শহরের অস্তিত্বও হুমকির মুখে পড়েছিল। তা সত্ত্বেও বহুদিন পর্যন্ত বর্ষাকালে প্রতিবছর পদ্মার ঘোলা জল ইছামতি দিয়ে প্রবাহিত হয়ে হুড়াসাগরে মিলিত হতো পাবনার সরাসরি পশ্চিমে। আবার যমুনার সংযোগকারী হুড়াসাগর দিয়ে বর্ষাকালে যমুনার কালো জল ইছামতি দিয়ে পদ্মায় গিয়ে মিলিত হতো। এভাবে বছরের মধ্যে প্রায় ছয় মাস ইছামতি বিশাল প্রশান্ত এক নদীতে পরিণত হতো। ছোট ছোট লঞ্চ, গহনার নৌকা, পণ্যবাহী নৌকা, যাত্রীবাহী নৌকা পাবনা-বেড়া নৌরুটে ওই ছয় সাত মাস চলাচল করত। আমাদের গ্রামের বাড়ি পাবনা জেলার সাঁথিয়া উপজেলার ভুলবাড়িয়া গ্রামে। প্রায় ১৪ বছর বয়স পর্যন্ত ওই গ্রামে বাস করেছি। রোজ বন্ধু- বান্ধব মিলে বারো মাস ম্লান করেছি। আমাদের বাড়িটি ছিল ইছামতির তীরে। হাঁটাপথে মাত্র তিন মিনিটের দূরত্বে। তাই ইছামতির সঙ্গে আমাদের প্রাণের সম্পর্ক। গহনা নৌকায় চড়ে বাল্যকালে কতদিন যে ওই নদী দিয়ে বাবার সঙ্গে পাবনা বেড়াতে এসেছি, আবার পাবনা থেকে ফিরে বাড়ি গিয়েছি, এখন আর তা মনে নেই। দিনে কমপক্ষে চারবার ইছামতির সঙ্গে সাক্ষাত হতো নিয়মিত। প্রথমত, ¯œানের সময়; দ্বিতীয়ত এবং তৃতীয়ত আতাইকুলা হাই স্কুলে পড়তে যাওয়া ও আসার সময় এবং বিকেলে নদীর ধারে খেলাধুলার সময়। ১৯৪৭-এ ১৪ বছর বয়সে চলে এলাম পাবনা শহরে স্থায়ীভাবে। বাসা ভাড়া নেয়া হয়েছিল রাধানগরে। সেখান থেকে গোপাল চন্দ্র ইনস্টিটিউশনে পড়তে যাওয়া আসার সময়, বাজার করতে যাওয়ার সময়ও সাক্ষাত হতো ইছামতির সঙ্গে। অতঃপর ওই বাসা ছেড়ে অপর পারে অন্য বাসায় এলাম। ভর্তি হলাম পাবনা এ্যাডওয়ার্ড কলেজে। তখনও যাতায়াতের সময় নতুন ব্রিজ দিয়ে ইছামতি দর্শন হতো রোজ দুবার। তাই শৈশব থেকে যৌবন পর্যন্ত ইছামতির সঙ্গে আত্মীয়তা-শুধু আমাদের নয়, পাবনা জেলাবাসী বেশির ভাগ লোকেরই। নারী-পুরুষ নির্বিশেষে। কোথায় গেল সেই ইছামতি আমাদের নিত্যদিনের সাথী সেই ইছামতি আজ প্রায় অদৃশ্য। স্থান পেয়েছে স্মৃতির পাতায়। অভ্যাসবশত ইছামতিকে দেখতে যাই। হতাশ হই- বেদনার্ত হই। কারণ, সেই প্রিয় ইছামতি আজ আর নেই। তাকে গলাটিপে হত্যা করা হয়েছে। মনে পড়ে, আজ থেকে ৫০ বছর আগেও এ নদীতে পণ্যবাহী যাত্রীবাহী নৌকা চলাচল করেছে। নানা সাজে সাজিয়ে অসংখ্য লম্বা সরু সরু বাইচের নৌকায় নেচে নেচে গান গেয়ে গ্রামের তরুণরা নৌকাবাইচ খেলেছে। বছর বছর মহাসমারোহে নৌকাবাইচের প্রতিযোগিতাও হয়েছে। আশ্বিন মাসে (অক্টোবর) দুর্গাপূজা উপলক্ষে যখন হিন্দুরা প্রতি বাড়িতে কমপক্ষে ১০/১৫টি করে নারিকেল কিনে নাড়–-বড়ি বানাতেন, প্রতিটি পূজাম-পে পাঁচ দিনব্যাপী দুর্গাপূজার ঘটে বা নৈবেদ্যের জন্য ২৫/৩০টি করে নারিকেল কিনতেন, ১০/১৫টা করে নারিকেল দুর্গা প্রতিমা বিসর্জনের পরে দিনকয়েকের মধ্যে লক্ষ্মীপূজা উপলক্ষে- সেসব তারা কিনতেন নতুন ব্রিজের উত্তর পাশে ইছামতি দিয়ে নৌকায় আনা স্তূপকৃত নারিকেল ডিপো থেকে পাইকারি দামে। আজ সে সবই অতীতের বিস্মৃত স্মৃতি মাত্র। ইছামতির হত্যাকারী কারা ইছামতি কি শীর্ণকায় হয়ে পড়েছে? নতুন প্রজন্মের ছেলেমেয়েরা হয়ত তাই ভাবেন। এই ভাবনা সত্যের সম্পূর্ণ বিপরীত। বস্তুত যখন শীতলাই জমিদার বাড়ি এবং পাবনা শহর ইছামতিতে বিলীন হওয়ার উপক্রম, তখন তা থেকে বাঁচতে মজবুত বাঁধ দেয়া হলো। তখন থেকেই পদ্মার শাখানদী ইছামতিতে পদ্মার জল আসা বন্ধ হয়ে গেল। অপরপক্ষে পলি পড়ে বা বাঁধ দিয়েই হোক, যমুনার জল বর্ষাকালেও ইছামতিতে আসা বন্ধ করে দেয়া হয়। ফলে স্রোতস্বিনী ইছামতি স্রোতহীন এক বদ্ধ জলাশয়ে পরিণত হলো। নিজে থেকেই এর সুযোগ গ্রহণ করতে থাকল ভূমিদস্যুরা। ধীরে ধীরে সুকৌশলে তারা প্রথমে নদী তীরে মাটি ফেলে বাঁশের বেড়া দিয়ে ঘিরতে থাকল ইছামতির উভয় পাড়। নদীর প্রস্থ কমে আসতে লাগল। এবার ওই ভূমিদস্যুরা বিশাল বিশাল অট্টালিকা গড়ে তুলল নদীর উভয় তীরে, যেন সেখানে ইছামতির অস্তিত্ব ছিল না কোনদিন। এর আগে তারা সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের অন্যায়ভাবে প্রভাবিত করে নদী তীরবর্তী ওই জমি নিজেদের নামে রেকর্ড করিয়ে নিয়ে মালিক বনে গেলেন। অথচ নদী বিল প্রভৃতি জলাশয়ের মালিক আইনত সরকার- কোন ব্যক্তি বা গোষ্ঠী নয়। এই প্রক্রিয়া বছর বছর বিনাবাধায় চলতে চলতে নদীটি বিলীন হয়ে গেল- অপমৃত্যু ঘটে গেল ইছামতির। আজ ইছামতির দিকে তাকালে একটি নোংরা পাগাড়, দুর্গন্ধময় নর্দমা বলে মনে হয়। যারা খতিয়ান করে মালিক হয়ে গেলেন তারা ছাড়াও অপর অনেকে ভুয়া আমলানামা তৈরি করে আদালতে সরকারের বিরুদ্ধে স্বত্ব প্রতিষ্ঠার দাবিতে মামলা দায়ের করে সরকারী উকিল বা কখনও কখনও অসৎ বিচারককে হাত করে ভুয়া ডিগ্রী হাতিয়ে নিয়ে মালিক বনে যান। অতি ধূর্ত কেউ কেউ আবার এই দুইভাবে অর্জিত মালিকানার স্থায়িত্ব সম্পর্কে সন্দিহান হয়ে তা হয় নিজের আত্মীয়স্বজন বা ভিন্ন লোকদের কাছে বিক্রি করে দেন। ক্রেতারা দলিলমূলে নাম খারিজ করে প্রশ্নাতীতভাবে ওই জমির ‘বৈধ’ মালিক বনে যান। এমন ঘটনা জেলা ও উপজেলা শহরগুলোতে বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই ঘটেছে। যেমন- পাবনা, বেড়া ও সাঁথিয়া। ওই মালিকরা সর্বদা সরকারী দলের নেতাকর্মী থেকে যান। সরকারী কর্মকর্তারাও তাদের সঙ্গে যোগসাজশ করেন। ফলে, সমাজে ভূমিদস্যুদের প্রভাব ব্যাপকভাবে বেড়ে যেতে থাকে। এরপর তাদের আর পায় কে? পাবনার ইছামতি এই ভূমিখেকোদের অসহায় শিকার। কিন্তু ডিএস খতিয়ানকে নির্ভুল বলে উচ্চতম আদালত স্বীকৃতি দিয়েছে। তাই ওই খতিয়ানে উল্লিখিত এলাকার মূল মালিক কে তা স্পষ্টাক্ষরে লিখিত আছে। এই খতিয়ানকে পরিবর্তন করার অধিকারও কারও নেই। তাই ডিএস খতিয়ানে বর্ণিত এলাকাই হচ্ছে ইছামতির প্রকৃত দৈর্ঘ্য ও প্রস্থ সংক্রান্ত চূড়ান্ত এলাকা। সকলকেই এই এলাকা অভ্রান্ত বলে মানতে হবে। ডিএস খতিয়ানভুক্ত সম্পূর্ণ এলাকা যতদিন ইছামতি নদীর এলাকা ছিল, ততদিন ইছামতি দৈর্ঘ্যপ্রস্থে এবং গভীরতায় ছিল বিশাল। কিন্তু ওই খতিয়ানকে আড়াল করে যারা পরবর্তীতে ষাটের দশকের জরিপকালে জরিপ কর্মকর্তাদের অনেককে অবৈধভাবে প্রভাবিত করে নিজ নিজ নামে এসএ রেকর্ড (ষাটের দশকে) এবং পরবর্তীতে আরএস খতিয়ান নিজেদের নামে অবৈধভাবে লিপিবব্ধ করিয়ে ভোগ দখল করছেন, তারা যেই হোন না কেন- তারা সবাই আইনত অবৈধ দখলদার। শাস্তিযোগ্য অপরাধে অপরাধী। সময়মতো জনতা এর বিরুদ্ধে সংগঠিত হতে না পারলেও ধীরে ধীরে এই অবৈধ দখলদারদের উচ্ছেদ, অবৈধ স্থাপনাগুলো ভাঙ্গা, দৈর্ঘ্যে প্রস্থে ইছামতির আগের এলাকা পুরোপুরি পুনরুদ্ধার, নদী খনন এবং ইছামতির সাবেক রূপ ফিরিয়ে আনতে গণআন্দোলনের প্রেক্ষিতে বছর কয়েক আগে হাইকোর্টে মামলা করলে হাইকোর্ট তার প্রদত্ত রায়ে স্পষ্টত উল্লেখ করে ডিএস খতিয়ান অপরিবর্তনযোগ্য। সুতরাং ওই খতিয়ানে বর্ণিত এলাকার কোন অংশ কেউ দখল বা সেখানে কোন স্থাপনা নির্মাণ করে থাকলে তা সম্পূর্ণ অবৈধ। সুতরাং ওই অবৈধ দখল থেকে সংশ্লিষ্ট এলাকা উদ্ধার করতে সকল বেআইনী দখলদারকে উচ্ছেদ বৈধ এবং তা করার নির্দেশও আদালত দিয়েছে। আদালতের বিবেচনায় নদীরও প্রাণ আছে। সুতরাং প্রাণহানিও সম্পূর্ণ অবৈধ ও শাস্তিযোগ্য অপরাধ। তাই উচ্চ আদালত নির্দেশ মেনে পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়সহ সংশ্লিষ্ট প্রশাসনকে নদীর অবৈধ সব দখলদার ও অবৈধ স্থাপনা থেকে উদ্ধার করে ডিএস খতিয়ান অনুযায়ী ইছামতির দৈর্ঘ্য, প্রস্থ ও গভীরতা উদ্ধার করা হোক অবিলম্বে। ইছামতি উদ্ধার আন্দোলন মুক্তিযুদ্ধের পরবর্তীকালে ইছামতি নদী পুনরুদ্ধার ও খননের দাবিতে সৃষ্ট আন্দোলন ও লেখালেখির ফলে কাজ শুরু হয় একটি অবৈধ স্থাপনা ভাঙ্গা ও সামান্য খনন শুরুর মধ্য দিয়ে। এ বিষয়ে তদানীন্তন সরকার কিছু অর্থও বরাদ্দ করেছিল। কিন্তু দু’একদিন কাজ করার পরই অদৃশ্য কারণে তা বন্ধ হয়ে যায়। প্রশ্ন ওঠে তৎকালীন একজন নেতার এ বিষয়ে সততা নিয়েও। কাজ থামার সঙ্গে সঙ্গে আন্দোলনও থেকে যায়। মূলত হতাশা ও প্রভাবশালী নেতাদের ভয়ে। এরপর চলতে থাকে বহু বছর ধরে সকল জাতীয় পত্রিকায় ইছামতি নিয়ে লেখালেখি। দীর্ঘকাল ধরে এই প্রক্রিয়া চলার পরে স্বাভাবিক কারণেই তাও বন্ধ হয়ে যায়। কিন্তু সম্প্রতি কয়েক বছর হলো নতুন কর্মীরা, পরিবেশ আন্দোলন ও কোন কোন এনজিও এ আন্দোলন শুরু করেছে। স্থানীয় একজন পত্রিকা সম্পাদকের নেতৃত্বে ‘ইছামতি উদ্ধার কমিটি’ বা এই জাতীয় নামে গঠিত একটি সংগঠনের নেতৃত্বে। এই শুভ প্রচেষ্টায় শরিক হন অনেক সাধারণ মানুষÑ প্রধানত পাবনা শহরের। অনেক সভা-সেমিনার-আলাপ-আলোচনা-কর্তৃপক্ষের সঙ্গে প্রতিনিধিদল পাঠিয়ে আলোচনা ও স্মারকলিপি প্রদান প্রভৃতি করার পরেও যখন কাজ তেমন একটা হলো না, তখন সকলে বাধ্য হলেন আন্দোলনের পথ ধরতে। করোনার জন্য তাতেও অসুবিধা। কিন্তু তাতেও থেমে থাকছে না রাজপথের সমাবেশ ও মানববন্ধন। সরকারী কিছু উদ্যোগও নেয়া হয়েছিল বলে জানা যায়। ২০০৩ সালে আজ থেকে ১৮ বছর আগে তৎকালীন জেলা প্রশাসক একটি ইছামতি নদী জরিপ কমিটি গঠন করেন, যার সদস্য করা হয়েছিল অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক রাজস্ব (আহ্বায়ক), পানি উন্নয়ন বোর্ডের উপ-বিভাগীয় প্রকৌশলীকে সদস্য সচিব করেন। জেলা পরিষদ, পৌরসভা, সড়ক ও জনপথ, স্থানীয় সরকার ও সদর ভূমি অফিসের প্রতিনিধিদেরও অন্তর্ভুক্ত করা হয়। ১৯২২ সালে প্রকাশিত ডিএস মৌজা ম্যাপ অনুযায়ী জরিপ করা হয়। চিহ্নিত করা হয় নদীর মূল প্রশস্ততা ও নদীর পরিসর। জরিপকালে বেরিয়ে আসে অনেক অবৈধ দখলদার বিভিন্ন অসৎ উপায় অবলম্বন করে ১৯৬২ সালের এস এ রেকর্ড ও সর্বশেষ আর এস রেকর্ডে তাদের নামে জাল কাগজপত্র তৈরি করে ওই খতিয়ানগুলোতে নিজেদের নাম তুলে নিয়ে ‘বৈধ’ মালিক সেজে বসে আছেন। সে সময় জরিপ দল ২৮৫ জন অবৈধ দখলদারের তালিকা, মৌজার ট্রেসিং ম্যাপ তৈরি ও স্পষ্টভাবে অবৈধ দখলদারদের বিস্তারিত প্রতিবেদন প্রকাশ করে। ৯ ডিসেম্বর, ২০০৩ সালে জে.প্র;/পাব/রাজস্ব/জরিপ/২০০৩/১০ (৮) নং স্মারকপত্র তৎকালীন জেলা প্রশাসকের নিকট দাখিল করেন। ইছামতিকে নিয়ে তখন একটি মাস্টারপ্ল্যানও তৈরি হয়েছিল। ওই প্ল্যানের মধ্যে ছিল অবৈধ দখলদার উচ্ছেদ, নদী খনন, গাইড ওয়াল নির্মাণ, নদী প্রশস্তকরণের পর দুধারে ওয়াকওয়ে নির্মাণ করে শহরবাসীর বৈকালিক ও সকালের ভ্রমণের মাধ্যমে স্বাস্থ্য উদ্ধার, উভয় পাশে বৃক্ষরোপণ ও মানুষের সৌন্দর্য উপভোগ বা বিশ্রামের জন্য বহুসংখ্যক ইট সিমেন্টের বড় বেঞ্চ নির্মাণ ইত্যাদি। কিন্তু ওই পর্যন্তই। ইতোমধ্যে ইছামতি নামক খালটিতে মরা গরু, বাছুর, কুকুর, বিড়াল, গোটা পৌর এলাকার বর্জ্য ফেলতে ফেলতে নদীর চিহ্নটুকুও হারিয়ে যেতে বসেছে। পরিবেশ দূষিত হচ্ছে। মানুষ রোগক্রান্ত হচ্ছে। জনপ্রতিনিধিদের ভূমিকা তারা হামেশাই বলে থাকেন বাংলাদেশ এখন উন্নয়নের মহাসড়কে। তাই এ আন্দোলন বা দাবি হয়ত তাদের কাছে অপ্রয়োজনীয়। চলতি বছরের ৩০ মার্চ অবৈধ দখলদারদের উচ্ছেদ অভিযান প্রথম শুরু হয়। কিন্তু অজ্ঞাত কারণে মাত্র তিনদিন যেতে না যেতেই ১ এপ্রিল তা স্থগিত করে দেয়া হয় অবৈধ দখলদার ও জনপ্রিতিনিধিদের চাপে। এক মাসের জন্য। সেই যে বন্ধ হলো, এর আর যেন শেষ নেই। প্রত্যাশিত ছিল জনপ্রতিনিধিরা উদ্যোগী হয়ে কাজ শুরুর তাগিদ দেবেন। কাজ ঠিকমতো হচ্ছে কি না তার নিয়মিত তদারকি করবেন। কিন্তু তা হচ্ছে না। প্রশাসনিক তৎপরতাও দৃশ্যমান নয়। কিন্তু জনগণ থেমে থাকবে না। এতকিছু প্রতিকূলতা সত্ত্বেও মানুষ কিন্তু থেমে নেই। থেমে থাকবেনও না। তারা আন্দোলন অব্যাহত রাখবেন। আন্দোলনকে দিনে দিনে তীব্র করে তুলবেন। এ আন্দোলন সরকারবিরোধী নয়। কাউকে ক্ষমতায় বসানো বা ক্ষমতা থেকে নামানোরও নয়। আন্দোলনটি একান্তই দলমত ধর্ম-বর্ণ-নির্বিশেষে সকল স্তরের মানুষের। ইছামতিকে বাঁচানোর কারণ ভুক্তভোগী তারাই, ওই বিশিষ্টজনরা বা অর্থবিত্তরা বা অবৈধ দখলদাররা নন। তবু আন্দোলনটির সাফল্য যেমন সাধারণ মানুষের, তেমনই আবার ওই বিশিষ্টজন ও তাদের বংশধরদের উপকারে আসবে। ডিএস খতিয়ান অনুযায়ী দৈর্ঘ্য ও প্রস্থ, গভীরতা সব ঠিক হতে হবে। আজ হোক কাল হোক এ আন্দোলনের সাফল্য অনিবার্য। লেখক : একুশে পদকপ্রাপ্ত সাংবাদিক [email protected]
×